বিশ্ব পানি দিবস
পৃথিবীতে পানি এল কোথা থেকে?
আজ বিশ্ব পানি দিবস। দিবসটি উদ্যাপন করার কারণ, পানি ছাড়া জীবন কল্পনা করা যায় না। পৃথিবীতে পানি আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি। এমনকি সব প্রাণীর জীবনও পানির ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, পৃথিবীর প্রায় ৭১ শতাংশ পানি দিয়ে মোড়ানো। একজন নবজাতকের শরীরের প্রায় ৭৮ শতাংশ পানি থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের থাকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত। বুঝতেই পারছো, মানবদেহের সিংহভাগই পানি। এ কারণেই পানি পান না করে মানুষ কয়েক দিনের বেশি বাঁচতে পারে না। তাই পানি দিবসে আমরা জানব, পৃথিবীতে পানি এল কোথা থেকে?
পৃথিবীতে পানি কীভাবে এসেছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। বেশিরভাগ তত্ত্ব দুটি প্রধান ধারণার ওপর ভিত্তি করে—
১. পৃথিবী গঠনের সময়ই পানির মূল উপাদানগুলো এর সঙ্গে ছিল।
২. পানিবাহী মহাকাশের কোনো বস্তু, যেমন ধূমকেতু ও গ্রহাণুর মাধ্যমে পানি পৃথিবীতে এসেছে।
অনেক তত্ত্বে পৃথিবীতে একাধিক উৎস থেকে পানি আসতে পারে বলে দাবি করা হয়েছে। এটি বিষয়টিকে কিছুটা জটিল করে তোলে।
পৃথিবীর শুরু থেকেই কি পানি ছিল?
প্রায় ৪.৫৪ বিলিয়ন বছর আগের ঘটনা। গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘের সংকোচনের ফলে তৈরি হয় সূর্য। এই প্রক্রিয়ায় অবশিষ্ট উপাদান থেকে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ গঠিত হয়। এর মধ্যে পৃথিবীও আছে। তখন থেকেই কি পৃথিবীতে সব মহাসাগর, হ্রদ ও নদীগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় পানি ছিল?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—প্রথম দিকে সৌরজগতের মধ্যকার জায়গা ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত। যদি তখন পৃথিবীতে তরল পানি থাকত, তবে তা বাষ্পীভূত হয়ে মহাকাশে উড়ে যেত। তাহলে যদি পানি পাথরের মধ্যে আটকে থাকে, তবে? সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এনস্টাটাইট কনড্রাইট নামক উল্কাপিণ্ড—যা পৃথিবী গঠনের কাঁচামাল হিসেবে বিবেচিত—তাতে যথেষ্ট হাইড্রোজেন রয়েছে। গবেষকদের মতে, এটি পৃথিবীর মহাসাগরগুলোতে থাকা পানির তিনগুণ পরিমাণ পানি সরবরাহ করতে পারত। তবে এই উল্কাপিণ্ড কখন পৃথিবীতে পানি সরবরাহ করেছিল, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে এই উল্কাপিণ্ডের ভেতরের গঠন পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ শিলার সঙ্গে মিলে যায়।
যদি পৃথিবীর অভ্যন্তরে পানি আটকে থেকেও থাকে, তাহলে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে এই পানি বাষ্প হিসেবে বের হয়ে যাবে। এরপর তা আবারও ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টির আকারে পৃথিবীতে ফিরে আসবে।
থিয়া কি পৃথিবীতে পানি এনেছিল?
প্রায় ৪.৫১ বিলিয়ন বছর আগে থিয়া (Theia) নামে মঙ্গল গ্রহের আকারের একটি গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষে হয়। এর ফলে পৃথিবীর আবরণ আংশিকভাবে গলে যায়। অনেকের মতে, এই সংঘর্ষের ফলে তৈরি উপাদান থেকে চাঁদ গঠিত হয়। প্রশ্ন হলো, এই সংঘর্ষের সময় কি থিয়া পৃথিবীতে পানি এনেছিল? অন্তত একটি গবেষণায় এই প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন বিজ্ঞানীরা।
পৃথিবীতে কি নিজে নিজে পানি তৈরি হয়েছে?
আরেকটি তত্ত্ব বলছে, পৃথিবীতে আপনা-আপনি পানি তৈরি হতে পারে। শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে শিশু এক্সোপ্ল্যানেটকে হাইড্রোজেন পরমাণু দিয়ে আবৃত দেখা গেছে। একদল বিজ্ঞানীর মডেলিং অনুযায়ী, এই হাইড্রোজেন যদি গলিত ম্যাগমার সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তবে প্রচুর পরিমাণে পানি তৈরি হতে পারে।
পৃথিবীতে কি গ্রহাণুগুলো পানি এনেছিল?
একসময় সৌরজগৎ ছিল প্রচণ্ড অশান্ত। প্রায় ৪.০ থেকে ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের কক্ষপথের পরিবর্তন ঘটে। এদের মহাকর্ষীয় টানাপোড়নের ফলে বরফাচ্ছন্ন শিলা সৌরজগতের দিকে ছুটে আসে। এভাবে মহাকাশের অনেক বস্তু পৃথিবীতে আছড়ে পড়তে থাকে। সম্ভবত এভাবে পৃথিবীতে পানিও আসে।
প্রথমে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, ধূমকেতু পৃথিবীর পানির প্রধান উৎস। পরে দেখা গেছে ধূমকেতুর পানির রাসায়নিক গঠন পৃথিবীর পানির সঙ্গে মেলে না। এতে বোঝা যায়, পৃথিবীতে পানি আনার প্রধান ভূমিকা ছিল গ্রহাণু ও উল্কাপিণ্ডের।
গ্রহাণু রিউগু ও পৃথিবীর পানি
জাপানের হায়াবুসা২ মহাকাশযান গ্রহাণু রিউগু থেকে সংগ্রহ করা নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনেছিল। এই নমুনার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এর পাথরের মধ্যে থাকা পানি পৃথিবীর মহাসাগরের পানির সঙ্গে মেলে। রিউগুর গঠন সিএল কনড্রিটস নামে পরিচিত একধরনের উল্কাপিণ্ডের মতো, যা পৃথিবীর মোট মহাসাগরীয় পানির ৩০ শতাংশ সরবরাহ করতে পারত।
বেনু গ্রহাণু ও পানি রহস্য
নাসার ওসিরিস-রেক্স মহাকাশযান ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বেনু নামের একটি গ্রহাণু থেকে সংগ্রহ করা নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনে। প্রাথমিক বিশ্লেষণে সেখানে পানি ও জৈব যৌগের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, এটিও ইঙ্গিত দেয় যে গ্রহাণুগুলোই পৃথিবীতে প্রচুর পানি এনেছিল। বিজ্ঞানীরা এখনো বেনুর নমুনাগুলোর বিশদ বিশ্লেষণ চালিয়ে যাচ্ছেন, যা পৃথিবীতে পানি আসার ইতিহাস নিয়ে আরও নতুন তথ্য প্রকাশ করতে পারে।
সবশেষে, পানিকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কারণ পানি আছে বলেই আমরা আজও পৃথিবীতে বেঁচে আছি। এই পানি দূষিত করে ফেললে, বিশেষ করে মিষ্টি পানির উৎস দূষিত হলে আমাদেরও জীবন বিপন্ন হবে।
সূত্র: দ্য প্লানেটরি সোসাইটি