চকলেটের ইতিহাস: চকলেট পেলাম কীভাবে

নতুন বিশ্ব আবিষ্কৃত হওয়ার আগে পুরোনো বিশ্বের কেউ চকলেটের স্বাদ পায়নিপ্রতীকী ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

চকলেটের ইতিহাস অনেক পুরোনো

চকলেটের ইতিহাস অনেক বছরের পুরোনো। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, দক্ষিণ আমেরিকার এই খাবারের স্বাদ সেখানকার নাগরিকেরা পেয়েছিলেন এখন থেকে প্রায় ৫ হাজার ৩০০ বছর আগে। এরপর মেজোমেরিকা মানে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার নাগরিকেরা এই পানীয়ের স্বাদ পান। তবে চকলেটের লিখিত ইতিহাস প্রায় ১ হাজার ১০০ বছর আগের

পুরোনো বিশ্বের কাছে চকলেট নতুন খাবার

নতুন বিশ্ব আবিষ্কৃত হওয়ার আগে পুরোনো বিশ্বের কেউ চকলেটের স্বাদ পায়নি। নতুন বিশ্ব মানে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা। আর পুরোনো বিশ্ব মানে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা। তার মানে আমেরিকায় যাওয়ার জলপথ আবিষ্কারের আগে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার কেউ চকলেটের স্বাদ পায়নি।

আরও পড়ুন

দক্ষিণ আমেরিকা চকলেটের গুরু

কোকোগাছ যখন চাষ করা শুরু হয়, তখন মানুষ প্রথম চকলেটের স্বাদ লাভ করে। কারণ, কোকোগাছের বীজ থেকে চকলেট তৈরি হয়। ধারণা করা হয়, দক্ষিণ আমেরিকার এখন যে রাষ্ট্রের নাম ইকুয়েডর, সেখানে কোকো চাষের শুরু। এরপর সেটা আমেরিকার অন্য অনেক অংশে ছড়িয়ে পড়ে। মায়া ও অ্যাজটেকদের কাছে চকলেট ছিল এক বিশেষ খাদ্য।

খাবার নয়, পানীয়

প্রথমে চকলেট পানীয় হিসেবে পান করা হতো। আমেরিকায় সব আদিবাসী চকলেট পান করত পানীয় হিসেবে। শুধু তা–ই নয়, তারা এটি পান করত স্বর্গীয় পানীয় হিসেবে। চকলেট থেকে বিভিন্ন ধরনের পানীয় তৈরি করত তারা। তবে মজার ব্যাপার হলো যে এসব পানীয় ছিল তিতা। মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতা চকলেটকে মিষ্টি করে বানাতে শেখেনি। আর সেটার জন্য বিশ্ববাসীকে ৪ হাজার ৫০০ বছরের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।

‘চকলেট’ নামটাও আদিবাসীদের দেওয়া

আমেরিকার আদিবাসীরা বিশ্বকে কেবল মজাদার স্বাদের এই খাবার উপহার দেয়নি, সেই সঙ্গে দিয়েছে ‘চকলেট’ নামটাও। একদল পণ্ডিতের মতে, অ্যাজটেকদের ভাষা নাহুতালেতে আছে ‘কাকাহুতাল’ নামের এক শব্দ। এই কাকাহুতাল থেকে চকলেট শব্দটি এসেছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এই ভাষার ‘শাকোতাল’ থেকে চকলেট কথাটি এসেছে, যার মানে তিতা স্বাদের পানীয়। আবার কারও কারও মতে, মায়াদের ভাষায় ‘চকোলাতাল’ শব্দটি স্প্যানিশ চকলেটে পরিণত হয়েছে, যার মানে গরম পানীয়।

আরও পড়ুন

স্প্যানিশদের হাত ধরে সারা বিশ্বে

আমেরিকার আদিবাসী ছাড়া বিশ্বের প্রথম যে নাগরিক চকলেটের স্বাদ পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন বলে ধারণা করা হয়, তাঁর নাম হার্নান কোর্টেজ। ১৫২০ সালে অ্যাজটেক রাজা দ্বিতীয় মান্টেজুমার দরবারে তিনি চকেলট পান করেন। তবে অ্যাজটেকদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনেন কোর্টেজ। তাঁর হাতে অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। শুরু হয় স্প্যানিশদের ঔপনিবেশিক শাসন। ১৫৪৪ সালে একদল সম্ভ্রান্ত মায়ান আদিবাসী স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের রাজদরবারে এসেছিলেন। উপহার হিসেবে অনেক কিছুর মধ্যে কোকো বীজ বা চকলেটের গুঁড়া নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। স্প্যানিশরাই ইউরোপে চকলেট নিয়ে যায়। ১৫৮৫ সালে প্রথম কোকো বীজভর্তি একটি জাহাজ মেক্সিকোর ভেরক্রুজ থেকে স্পেনের সেভিয়া বন্দরে পৌঁছায়। এরপর স্পেন থেকে চকলেটে ইতালি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনে পৌঁছায়।

কোকো বীজের রূপকথা

মায়া ও অ্যাজটেকরা কোকোগাছকে স্বর্গের গাছ হিসেবে বিবেচনা করত। অ্যাজটেকদের দেবতা কোয়েকজালকোটাল স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতে আসে। এই কোকোগাছ পৃথিবীকে দিয়ে সে আবার স্বর্গে চলে যায়। আর বলে যায় যে সে সাদা দাড়িওয়ালা এক মানুষের বেশে আবার পৃথিবীতে আসবে। এ কারণে অ্যাজটেকরা হার্নান কোর্টেজকে দেবতা হিসেবে গ্রহণ করেছিল।

আরও পড়ুন

কোকো বীজ যখন টাকা

তিনটি কোকো বীজে একটা টার্কি মুরগির ডিম কিনতে পাওয়া যায়
প্রতীকী ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীরা কোকো বীজকে টাকা হিসেবে ব্যবহার করত। তারা এটা দিয়ে পণ্য কিনত, সরকারকে ট্যাক্স দিত, শ্রমিকদের বেতন দিত, এমনকি জুয়াও খেলত। হার্নান কোর্টেজ যখন অ্যাজটেক রাজ্যে প্রবেশ করেন, তখন তিনি দেখেন যে ১০০ কোকো বীজ দিয়ে একজন দাস কেনা যায় অথবা টার্কি নামের বিশাল মুরগি কিনতে পাওয়া যায়। তিনটি কোকো বীজে একটা টার্কি মুরগির ডিম কিনতে পাওয়া যায়। ১০টা কোকো বীজে একটা খরগোশ কিনতে পাওয়া যায়। চকলেট খেয়ে কোর্টেজের ভালো লাগেনি। কিন্তু কোকো বীজ দিয়ে কেনাকাটার বুদ্ধিটা কোর্টেজের ভালো লেগেছিল। তাই তিনি দক্ষিণ আমেরিকায় স্পেনের নামে একটা কোকোগাছের খামার গড়ে তোলেন। কারণ, তাঁর কাছে সেটা ছিল টাকার গাছ।

তিতা থেকে মিঠা

কোর্টেজ এই তিতা স্বাদের পানীয়কে মিষ্টি পানীয়তে পরিণত করার চেষ্টা করেন। তিনি এতে মধু ও মিষ্টি যোগ করেন। ফলে দক্ষিণ আমেরিকায় আসা স্প্যানিশদের কাছে চকলেট ক্রমে জনপ্রিয় হতে থাকে। তারা চকলেটের মধ্যে বাদাম, ভ্যানিলা, দারুচিনি ও নানা রকম মসলা মেশাতে থাকে। শুধু তা–ই নয়, এরপর তারা এটাকে স্পেনে নিয়ে যায়। ইউরোপের অন্য কেউ যাতে চকলেটের স্বাদ না পায়, সে জন্য তারা চকলেটের রেসিপি ও কোকো বীজের গুঁড়া অতি গোপনে স্পেনে নিয়ে যেত। প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত তারা এই গোপনীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়।

কোকো বীজকে মল ভাবা

১৫৮৭ সালে ব্রিটিশরা একটি স্প্যানিশ জাহাজ দখল করে (সে সময় স্পেনের জাহাজে সোনা ও বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী ভর্তি করে সেগুলো দক্ষিণ আমেরিকা থেকে স্পেনে নিয়ে যাওয়া হতো আর সমুদ্রে ব্রিটিশরা সেগুলো দখল করে সেসব সামগ্রী লুটে নিত)। জাহাজ ব্রিটেনে নিয়ে আসার পর তারা আবিষ্কার করে যে জাহাজে কোনো সোনা নেই, কোনো দামি জিনিস নেই, তার বদলে জাহাজভর্তি কালো একধরনের গুঁড়া। ব্রিটিশরা ভেবেছিল, এগুলো বুঝি কোনো প্রাণীর বিষ্ঠা বা মল। আর এগুলো স্পেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সার হিসেবে। তাই তারা রেগে গিয়ে পুরো জাহাজে আগুন লাগিয়ে সেটা ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু তারা জানত না যে সেটা ছিল চকলেট বা গুঁড়া কোকো বীজভর্তি জাহাজ।

কোকোগাছ

সাধারণত একটি কোকোগাছ প্রায় ২০০ বছর বাঁচে। এটি চাষের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত, তাপ আবার ছায়ার প্রয়োজন হয়। চারা জন্মানোর চার থেকে পাঁচ বছর পর কোকোগাছে ফল ধরা শুরু হয়। তবে মাত্র ২৫ বছরে এই গাছ থেকে উপযুক্ত ফল পাওয়া যায়। একটা কোকোগাছ থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোকো বীজ পাওয়া যায়।

আমেরিকা থেকে আফ্রিকা

যদিও চকলেটের জন্ম দক্ষিণ আমেরিকায়। তবে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কোকো বীজ তথা চকলেটের উপাদান আসে আফ্রিকা থেকে। বর্তমানে বিশ্বের তিনটি স্থানকে কোকো চাষের উপযুক্ত বিবেচনায় সেখানে কোকো চাষ করা হয়। মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া এবং আফ্রিকা। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি কোকো বীজ আসে আফ্রিকা থেকে। আফ্রিকার আইভরি কোস্ট ও ঘানায় সবচেয়ে বেশি প্রায় ৬০ শতাংশ কোকো বীজ উৎপন্ন হয়। শুধু আইভরি কোস্ট থেকে বছরে প্রায় ৪০ শতাংশ কোকো পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

কোকোগাছের প্রজাতি

কোকো শব্দটিও আমেরিকান। আমেরিকার আদিবাসী একটি ভাষা ‘তেজালতাল’। সেটাতে ‘কাকাও’ বলে একটি শব্দ আছে। এর থেকে কোকো শব্দটি এসেছে। কাকাও মানে হচ্ছে কোকোগাছের বীজ। সাধারণত দুই ধরনের কোকোগাছ থেকে কোকো বীজ সংগ্রহ করা হয়—ফরাস্টেরো বিন ও ক্রিল্লো বিন। ফরাস্টেরো বিনের ফলন প্রচুর, কিন্তু স্বাদ কম। আর ক্রিল্লো বিনের স্বাদ বেশি কিন্তু এই গাছ থেকে ফলন কম হয়।

পানীয় থেকে খাবার

১৮৩০ সাল চকলেটের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ইতিহাসে এর আগে যারা চকলেট খেয়েছে, তারা সবাই পানীয় হিসেবে একে পান করেছে। ১৮৩০ সালে ব্রিটিশ নাগরিক জোসেফ স্টোরস ফ্রাই প্রথম চকলেটকে শক্ত আকার দেন। অর্থাৎ পৃথিবী পেল প্রথম চকলেট বার। তবে এর প্রায় ১৭ বছর পর ১৮৪৭ সালে মসৃণ চকলেট বাজারে আসে। আর সেটা আনে এমন দুই ভাইয়ের গড়া কোম্পানি যার নাম শুনলে চকলেট ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। এই দুই ভাই এর নাম জন ও বেনজামিন, আর তাঁদের নামের শেষে উপাধি ছিল চকলেটের নামে। দুই ভাইয়ের গড়া বিখ্যাত সেই কোম্পানির মালিকানা বদলে গেছে, কিন্তু ব্র্যান্ড নামটি এখনো টিকে আছে। বিখ্যাত সেই চকলেট কোম্পানি ও ব্র্যান্ডের নাম ক্যাডবেরি।

আরও পড়ুন