যে হাতি প্রতিদিন নিজে পাইপ দিয়ে গোসল করে
হাতি যে বুদ্ধিমান প্রাণী, এ তো সবাই জানে। এ কথাও অজানা না, হাতি সব সময়ই নিজের যত্নের ব্যাপারে খেয়াল রাখে। শরীর শীতল রাখার জন্য গোসল করে নিয়মিত। ত্বক রক্ষা করতে কাদায় ডুবে থাকে। অনেক সময় ত্বকের যত্ন নিতে শরীরে ধুলাও মাখে। এসব কাজে ব্যবহার করে নিজের শুঁড়।
বার্লিন চিড়িয়াখানার বাসিন্দা মেরি নামে এক এশিয়ান হাতি গোসল করার নতুন কৌশল দেখিয়েছে। গোসলের জন্য মেরি ব্যবহার করে একটি লম্বা হোস বা পাইপ।
কারেন্ট বায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে গবেষকেরা বলেছেন, মেরির পাইপ ব্যবহার প্রাণীদের টুল বা সরঞ্জাম ব্যবহারের সর্বশেষ উদাহরণ বলে মনে করা হচ্ছে। বার্লিনের হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী মাইকেল ব্রেখট বলেছেন, ‘মেরি খুব সুন্দর করে গোসল করে।’
মেরিই একমাত্র হাতি না, যে পাইপ ব্যবহার করতে পারে। অঞ্চলি নামে একটি কম বয়সী হাতি পাইপ দিয়ে পানি বের হওয়াকে বাধা দেওয়ার কৌশল শিখেছে। মেরির গোসল করাকে বাধা দিত অঞ্চলি।
এই পর্যবেক্ষণ থেকে গবেষকেরা দুইটি সম্ভাবনার কথা বলেছেন। এর মধ্যে একটি হলো, মজা করে অঞ্চলি মেরির গোসলে বাধা দেয়। গবেষকেরা অবশ্য একমত নন যে একটি হাতি অন্যটির সঙ্গে মজা করছে কিনা।
সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, হাতি সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারে। কলার খোসা ছাড়ানো বা গাছের ডাল ব্যবহার করে মাছি তাড়ায় হাতি।
মেরিকে নিয়ে লেখা গবেষণাপত্রের লেখক লেনা কাউফম্যান বলেছেন, ‘আমাদের কাছে পাইপ দিয়ে গোসল করা খুব সহজ কাজ মনে হতে পারে, তবে একটি প্রাণীর জন্য এটি “খুব জটিল”। পাইপ ব্যবহার করা হাতির জন্য তুলনামূলক সহজ; কারণ, হাতির শুঁড়ের সঙ্গে পাইপের খুব মিল আছে।’
কাউফম্যান চিড়িয়াখানায় ঘুরতে গিয়ে প্রথম মেরির গোসলের দক্ষতা দেখতে পান। তিনি দেখেছিলেন, চিড়িয়াখানার কর্মীরা সকালে ঘুরে ঘুরে হাতিদের গোসল করাচ্ছিলেন পাইপ ব্যবহার করে। তখন মেরির কাছে গিয়ে দেখলেন, অন্য হাতিদের মতো করে গোসল করাতে হচ্ছে না। মেরিকে শুধু পাইপটা দিয়ে দিলেই হয়ে যাচ্ছে।
পাইপ দিলে মেরি নিজে নিজে গোসল করতে শুরু করে। সারা শরীরে নিজে নিজে পানি ছিটিয়ে নেয়। মেরির তত্ত্বাবধায়কেরা কাউফম্যানকে বলেছেন, তাঁরা মেরিকে পাইপ ব্যবহার করা শেখাননি।
গবেষকরা মেরিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। একদিন দেখেছেন, মেরির গোসলের সময় অঞ্চলি পাইপের মাঝখানে ধরে মাটি থেকে তুলে নিয়েছিল এবং একটি প্যাঁচ তৈরি করার জন্য এটি ভাঁজ করেছিল। তারপর অঞ্চলির গোসলে বাধা দেওয়ার জন্য প্যাঁচ বরাবর চেপে ধরে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছিল।
পানির প্রবাহ বাধা দেওয়াটা প্রাণীর জন্য একটি জটিল কৌশল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কৌশলে অঞ্চলি আরও দক্ষ হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ সময়ের জন্য অঞ্চলি পানির প্রবাহ বন্ধ করে দিতে পারে। তবে এই আচরণের আসল অর্থ কী, তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।
মেরি অঞ্চলির প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণ শুরু করার কিছুক্ষণ পরেই অঞ্চলি এই আচরণ করেছে। এটা কি মেরির প্রতি অঞ্চলির প্রতিক্রিয়া? গবেষকদের হাইপোথিসিস তাই বলেছিল।
বিজ্ঞানীরা অঞ্চলিকে দুইটি পানির পাইপ দিয়ে হাইপোথিসিসটি পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। গবেষকদের ধারণা ছিল, সাধারণ পাইপের পরিবর্তে মেরি গোসলের জন্য যে পাইপ ব্যবহার করে, সেটিই প্যাঁচ দিতে পছন্দ করবে অঞ্চলি। তবে ঘটেছে বিপরীত ঘটনা। অঞ্চলির সামনে যে পাইপই দেওয়া হয়েছে, সেটাকেই সে প্যাঁচ দিতে চেয়েছে।
গবেষকেরা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে রাজি হননি। এই গবেষণায় অল্প কিছু ট্রায়ালের ভিত্তিতে ফলাফলে বা কোনো সিদ্ধান্তে যাননি তাঁরা। এ ছাড়া আরও বিবেচনার ব্যাপার হলো, চিড়িয়াখানার তত্ত্বাবধায়কেরা অঞ্চলিকে মেরির পানির পাইপ চেপে ধরার জন্য তিরস্কার করেছিলেন।
কয়েকটি সম্ভাবনাকে সামনে রেখে এই গবেষণায় বলা হয়েছে, পানির প্রবাহ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পাইপে চাপ দিতে অঞ্চলি শুঁড় ব্যবহার করেছে। ডক্টর মাইকেল ব্রেখটের মতে, ‘এর সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা হলো, পানির ধারাকে বন্ধ করতে চেষ্টা করেছে অঞ্চলি।’
কাউফম্যান অবশ্য বলেছেন, তিনি এই সিদ্ধান্তকে আরও দূরের বিষয় মনে করেন। পানির পাইপ চেপে ধরাটা হাতির মজা করা এবং কৌতূহলবশত করা কাজ হতে পারে। মেরির দিকে মনোযোগ দেওয়ার কারণে গবেষকদের মনে হতে পারে, ইচ্ছা করে অঞ্চলি এটি করেছে। তবে পানি বন্ধ হয়ে যাওয়াকে দুর্ঘটনাজনিত বলে মনে করেন কাউফম্যান। অঞ্চলির ইচ্ছাকৃত ঘটনা কিনা, এটি জানতে আরও গবেষণা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস