অদ্ভুত মানুষ ছিলেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। বড় বড় গবেষণা করতেন, শিক্ষকতা করতেন, আবার একটু ফুরসত পেলেই কলকাতা থেকে এসে ঢুঁ মারতেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে যেন তাঁর নাড়ির টান। শিলাইদহে এসে রবীন্দ্রনাথের গোটা পরিবার নিয়ে বেড়িয়ে আসতেন কোনো অজানা চরে। দু-চার দিন সেখানে থাকতেন বেদেদের মতো করে। চরের কচ্ছপ ধরা তাঁর নেশা। মাঝরাতে ভরা জোছনায় বসে সেই কচ্ছপের রেজালা সাবাড় করতেন রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েদের নিয়ে।
আবার শীতের দুপুরে চরের বালিয়াড়িতে কবরের মতো গর্ত করে রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে থাকতেন সেই গর্তে। শীতের হিমেল বাতাসকে পরাজিত করে যখন সোনা রোদ গা ঘামিয়ে দিত, তখন এক দৌড়ে পদ্মায় নেমে গোসলটা সেরে নিতেন জগদীশচন্দ্র বসু।
এহেন মজার মানুষ, কিন্তু ছিলেন বড় পদার্থবিজ্ঞানী। স্কটিশ পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের। এই তরঙ্গের মধ্যে আছে বেতার তরঙ্গও। কিন্তু সেই বেতার তরঙ্গ প্রথম শনাক্ত করেন বাংলাদেশের জগদীশচন্দ্র বসু। সেটাকে কাজে লাগানোর প্রথম প্রচেষ্টা তাঁরই ছিল। তিনিই প্রথম বেতারযন্ত্র আবিষ্কার করেন। কিন্তু আমরা সবাই জানি ইতালিয়ান বিজ্ঞানী মার্কনির কথা। আসল সত্যি হলো মার্কনির আগেই জগদীশ বসু বেতারযন্ত্র তৈরি করেছিলেন। তাঁর সেই যন্ত্রের কথা জানতেন ইউরোপের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীও। জগদীশ বসুকে তাঁরা প্রশংসাও করেছেন এ জন্য। সে সময় ইউরোপের এক বিখ্যাত ইলেকট্রনিকস কোম্পানি জগদীশ বসুর বেতারযন্ত্রের নকশাটা কিনতে চায়। কিন্তু সেটা বিক্রি করতে রাজি হননি তিনি। এর কিছুদিন পরই মার্কনিও বেতারযন্ত্র আবিষ্কার করেন। তখন সেই ইলেকট্রনিকস কোম্পানি মার্কনির যন্ত্রের নকশাটা কিনে নেয়। ফলে মার্কনির তৈরি বেতারযন্ত্রই ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। আবিষ্কারকের মর্যাদা তিনিই পেয়ে যান। এ নিয়ে অবশ্য জগদীশ বসুর মনে কোনো দুঃখ ছিল না। তিনি মনে করতেন, বিজ্ঞান হলো সাধনা, ব্যবসার বস্তু নয়।
তিনিই নাকি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন, গাছেরও প্রাণ আছে। এ কথাটা ঠিক নয়। তিনি ১৯১০ সালে লেখেন ‘জীব ও জড়ের সাড়া’ নামের একটি প্রবন্ধ। সেই প্রবন্ধে দেখালেন, বিদ্যুত্প্রবাহের ফলে উদ্ভিদ উত্তেজনা অনুভব করে। এ জন্য তিনি বেশ কিছু যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। জগদীশ বসু প্রমাণ করেছিলেন, উদ্ভিদেরও মানুষের মতো অনুভূতি আছে। বাংলা ভাষার প্রথম সায়েন্স ফিকশন পলাতক তুফান-এর লেখক কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসু। অব্যক্ত নামে একটা কালজয়ী বিজ্ঞান বইও লিখেছেন তিনি। পেয়েছেন নাইটহুড উপাধি। হয়েছিলেন ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির ফেলোও।
জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম ৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ সালে। ময়মনসিংহ শহরে। কিন্তু তাঁদের বাড়ি ছিল বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলার রাঢ়ীখাল গ্রামে। ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর জগদীশচন্দ্র বসু ঝাড়খন্ডের গিরিডিতে মৃত্যুবরণ করেন।