পাখিরা হলো প্রকৃতির এক আশ্চর্য সুন্দর সৃষ্টি। উড়ে-ঘুরে ওরা যেমন নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরিয়ে তোলে প্রকৃতিকে, তেমনি গান গেয়ে গেয়ে আর নেচে নেচে মানুষের চোখ-মন জুড়িয়ে দেয়। পাখির গানে ভোর নামে, পাখির ডানায় ভর করে সন্ধ্যা নামে আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে।
আমাদের দেশে পাখি আছে প্রায় সাত শ রকমের। এর ভেতর আছে গায়ক পাখি, নাচুনে পাখি, আমুদে-খেলুড়ে পাখি, শিকারি পাখি, নিশাচর পাখি, নিরীহ পাখি ও লড়াকু পাখি। ধবধবে সাদা রঙের পাখি যেমন আছে, তেমনি আছে কুচকুচে কালো রঙের পাখি। টকটকে হলুদ রঙের পাখি আছে, একেবারে নীল রঙের পাখিও আছে। হলুদ, লাল, বাদামি ও বেগুনি রঙের পাখিও আছে আমাদের দেশে।
দিনভর ব্যস্ত থাকে পাখিরা। খাবার সন্ধান করে। বন-বাগানে উড়ে-ঘুরে বেড়ায়। গান গায়। ডাকে। দল বেঁধে মজাদার সব খেলায়ও মাতে। কিন্তু পাখিরা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নানান রকম মজার কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে—তাতে ওরা হয়তো আনন্দ-মজা তেমন পায় না। মানুষ দারুণ উপভোগ করে। ওদের জন্য যেটা হয়তো কষ্টের, সেটাও মানুষের জন্য মজার কাণ্ড হতে পারে।
আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে তেমনই কয়েকটি মজার কাণ্ডের কথা উল্লেখ করছি।
শঙ্খচিলের ছানা
শিরীষগাছের মগডালে শঙ্খচিলের বাসা। সে বাসায় তিনটি ছানা। শরীরে ওদের কেবল সুতো-পালক গজিয়েছে। মা-বাবা পাখি খাবার মুখে বাসায় এলেই তিন ভাইবোনে ‘কার আগে কে খাবে’ তাই নিয়ে ঠেলাঠেলি-গুঁতোগুঁতি লাগায়। মা-বাবা পাখি কিন্তু সমানভাবে বাটে।
সেদিন দুপুরবেলায় মা-পাখি দূরের হাওর থেকে ছোট ছোট দুটি টাকি মাছ নিয়ে উড়ে এসে বসল বাসার কিনারে। ঠোঁটে ধরা মাছ দুটি নড়ছে তখনো। ওই মাছ মায়ের মুখ থেকে নেওয়ার জন্য একটি ছানা এগিয়ে এল বাসার প্রান্তে, মা-মাছ দুটি ছেড়ে দিল ছানাটির সামনে। একটি মাছ লাফ দিয়ে অল্প একটু ওপরে উঠল—ছানাটি যেই না লাফ দিয়ে ধরতে গেল ওটিকে, অমনি পড়ে গেল নিচের দিকে। পড়বি পড় গাছতলার একটা বড়সড় মানকচুর পাতার ওপর, তারপর গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। মা সন্তানের বিপদ বুঝেছিল, চিৎকার দিয়ে নিচের দিকে এসেছিল বটে, করার তো কিছু ছিল না। মাটিতে পড়ে যাওয়া ছানাকে বাসায় তুলে নিতে পারে না পাখিরা।
বোকাসোকা ছানাটি মাটিতে বসে টিউ টিউ সুরে চেঁচাচ্ছে কেবল। ব্যাপার বুঝে একটি বড়সড় গুইসাপ ধেয়ে আসছে ছানাটিকে গাপুস করার জন্য। বাড়ির একটি ছেলের নজরে পড়ল তা। সে এসে ছানাটিকে তুলে দিল বাসায়।
শঙ্খচিল হলো কবি জীবনানন্দের সেই সোনালি ডানার চিল। ইংরেজি নাম Brahminy Kite।
ভুতুম পেঁচার ছানা
এটিও নিশাচর পাখি। মূল খাবার এদের মাছ। উঁচু একটা মেঘশিরীষের মগডালে খোঁদল মতো জায়গায় বাসা, সে বাসায় দুটি উড়ু উড়ু ছানা। উড়তে শিখবে আরও সপ্তাহ খানেক বাদে।
চাঁদনি রাত। মা গেছে খাবার আনতে, নিচের পুকুরটাতেই। চুপচাপ বসে আছে পুকুরপাড়ের একখানা মরা ডালের ওপর। ছানা দুটি দেখছে অস্থির চোখে। পেটে খিদে তো!
মা দু-তিনবার ছোঁ মেরে ব্যর্থ হলো। আবারও চুপচাপ বসে। যেই না মাথা ভাসিয়েছে একটি মাছ, অমনি উত্তেজনায় ওই অত উঁচু থেকে লাফ দিল একটি ছানা—নখরে গাঁথবে! লাফ দিয়েই নিজের বোকামিটা বুঝতে পারল ছানাটি। পিচ্চি দুই ডানা মেলে বাতাসে ভারসাম্য রক্ষা করে পড়ল এসে মাটিতে। সকালে বাড়ির ছেলেপুলেরা ওকে ঘিরে আনন্দ-উল্লাসে মাতল।
ভুতুম পেঁচার ইংরেজি নাম Brown Fish Owl।
জলমোরগের ছানা
উঠোনের পাশের ধানখেতে চরছিল জলমোরগের ছানাটি। একটি পোষা মোরগ তেড়ে এল ওটার দিকে। ঠোকর মারার চেষ্টা করছে। ছানাটিও রুখে দিচ্ছে বারবার। খাবার খেতে ব্যস্ত সে, মোরগটা তাতে এসেছে বাগড়া দিতে।
ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে জলমোরগের ছানাটি এক লাফে জল থেকে উঠে এসে মোরগটিকে যেই না আক্রমণ করতে চাইল, অমনি পুঁচকে পাখিটার সাহস দেখে মোরগটি দিল ঝেড়ে দৌড়। ছানাটি খেপে একেবারে আগুন। তেড়ে চলল মোরগটির পেছনে পেছনে।
জলমোরগের ইংরেজি নাম Water Cock। ছানা অবস্থায় ধরে এদের পোষ মানানো যায়।
কাণ্ড যখন মুরগি ছানার
সুপারিবাগানের ভেতরে চরছে একটি মুরগি, সঙ্গে তার এক ডজন পিচ্চি পিচ্চি ছানা। আশপাশে ঝোপঝাড়, মুরগি মাতা তাই সতর্ক খুব। বনবিড়াল-বেজি-গুইসাপ বা শিকারি পাখি আসতে পারে। ছানাদের ওপর হামলা করতে পারে।
মরা একটি সুপারিগাছের গোড়ায় উইপোকার ঢিবি দেখে খুশিতে মুরগিমাতা কটকট করে ডেকে দুপায়ে আঁচড়ে ঢিবি দিল ভেঙে। অমনি উইপোকারা বেরিয়ে পড়ল, খেপেও গেল। রসাল উইপোকা আর ওদের ডিম মুরগিছানাদের কাছে তো বটেই—অন্যান্য বহু পোকাখেকো পাখির কাছে পোলাও ভাতের মতো সুস্বাদু। আমরা যেমন মজা করে পোলাও খাই, পাখিরা খায় উইপোকা ও ওদের ডিম।
ওই পোকা দেখে উড়ে এল লম্বা লেজের একটা দুধসাদা দুধরাজ পাখি। আহা রে সৌন্দর্য ওটির! ওটারও প্রিয় খাদ্য উইপোকা। ওটি উড়ে-ঘুরে মুরগিমাতার ঠোকর এড়িয়ে খাচ্ছে উইপোকা। ওমা! এ সময়ে একটি জেব্রারঙের পাখি উড়ে এসে মাটিতে বসেই মাথার ওপর ফুটিয়ে দিল চমৎকার একটি ফুল। ফুল ফুটানো পাখিটির দিকে তেড়ে গেল দুধরাজ—খাবারে ভাগ বসাতে দেবে না ওটিকে। জেব্রারঙের পাখিটিও রুখে দাঁড়াল ঠোঁট ফাঁক করে। দুধরাজ দোলাচ্ছে ওর লেজের লম্বা দুটি পালক, জেব্রারঙের পাখিটি মাথার ওপরের ফুলটি নাচাচ্ছে। একটি মুরগিছানা পালকের নড়া দেখে খাবার ভেবে ঠোকর দিয়ে মুখে পুরল—আতঙ্কে দুধরাজটি দিল খাড়া লাফ, মুরগিছানাসহ উঠে গেল ফুট দুয়েক ওপরে। বিপদ বুঝে মুরগিমাতা যেই না গেল তেড়ে, অমনি লেজের একখানা পালক মুরগিছানার মুখে রেখেই পালাল দুধরাজ। ব্যাপার সুবিধের নয় বুঝে উড়াল দিল জেব্রারঙের পাখিটিও। ওই পাখিটির নাম হুদহুদ। ইংরেজি নাম Hoopoe। দুধরাজের ইংরেজি নাম Paradise Flycatcher।
শিঙ্গেল পেঁচার ছানা
বয়সী কাঁঠালগাছটার খোঁড়লে ছিল শিঙ্গেল পেঁচার তিনটি পুতুলছানা। গোলগাল স্ফটিকের মতো চোখ, দুষ্টু-মিষ্টি চাহনি। শরীরে কেবল তুলো-পালক গজিয়েছে ওদের।
বাসার ভেতরে জায়গা কম। মা-বাবা পাখি তাই ওপাশের বাঁশঝাড়ের কঞ্চিতে বসে সারা দিন ঘুমায়-ঝিমায়। বাচ্চা তিনটিও পড়ে পড়ে ঘুমায়। এরা নিশাচর পাখি তো! রাতে বেরোয়।
কাঁঠালগাছটার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো একটি নারকেলগাছ। এক জোড়া বাদামি কাঠবিড়ালি অনেক চেষ্টায় বড়সড় একটা ডাবের মুখ ফুটো করেছে—ডাবের জলপানের আশায়, কিন্তু মুখ খসে ডাবটি প্রচণ্ড শব্দে এসে পড়ল কাঁঠালগাছটার মাথায়, পেঁচার ছানা তিনটি ভাবল বোধ হয় যে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়েছে—ঘাবড়ে গিয়ে দিল লাফ, মাটিতে পড়ল মুখ থুবড়ে। পড়েই ওরা বোকার মতো তাকাতে লাগল এদিক-ওদিক। তখন ওদের মুখখানা হলো দেখার মতো!
শিঙ্গেল পেঁচার ইংরেজি নাম Collared Scops Owl।