মানুষের সমুদ্র জয়ের ইতিহাস অনেক পুরোনো। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়ার জন্য এখন মানুষের প্রথম পছন্দ উড়োজাহাজ। অথচ মাত্র ১০০ বছর আগেও এ ধরনের যাত্রায় মানুষের একমাত্র বাহন ছিল জাহাজ। আর এই জাহাজ তৈরিতে মানুষ এতটাই সিদ্ধহস্ত হয়ে গিয়েছিল যে জাহাজ যে সমুদ্রে ডুবতে পারে, এমন ঘটনা কেউ বিশ্বাসই করতে চাইত না। টাইটানিকের নাম তোমরা সবাই শুনেছ। টাইটানিকের ক্যাপ্টেন নিশ্চিত ছিলেন যে জাহাজটি ডুববে না। তিনি বলেছিলেন, ‘স্বয়ং ঈশ্বরও এই জাহাজকে ডোবাতে পারবে না।’ কিন্তু প্রকৃতি মানুষের এই দম্ভ ভেঙে দিয়েছে বারবার, বিশাল বিশাল জাহাজ চোখের পলকেই হারিয়ে গেছে সাগরের তলদেশে। মানুষও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে, প্রকৃতির কাছে তারা কতটা ক্ষুদ্র! আজকে এমনই সাতটি বিখ্যাত জাহাজডুবির ঘটনা সম্পর্কে জানবে তোমরা। সেকালের শক্তিশালী এই জাহাজগুলো ডুবে যাওয়ার আগে কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি যে এই জাহাজগুলোও ডুবতে পারে।
দ্য এন্ডুরেন্স
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের অন্যতম আলোচিত জাহাজ দ্য এন্ডুরেন্স। ১৯১২ সালে নরওয়ের একটি জাহাজের কারখানায় তৈরি করা হয় এটি। বাষ্প ও বাতাসের শক্তি ব্যবহার করে চলা জাহাজটি নিয়ে ১৯১৪ সালে ২৭ জন নাবিক নিয়ে অ্যান্টার্কটিকার উদ্দেশে রওনা হন স্যার আর্নেস্ট শ্যাকলেটন। সব ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু বিপত্তি বাধে অ্যান্টার্কটিকা-সংলগ্ন ওয়েডেল সাগরে আসার পর। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশটি পুরোটা বরফে ঢাকা, আশপাশের সমুদ্রও এর ব্যতিক্রম নয়। ওয়েডেল সাগরে এসেই বিশাল সব বরফের চাঁইয়ের মধ্যে আটকা পড়ে যায় এন্ডুরেন্স। চাঁইগুলোর ক্রমাগত চাপে একসময় জাহাজটির তলদেশ ফুটো হয়ে যায়। জাহাজটি তলিয়ে যায় গভীর সমুদ্রে। অ্যান্টার্কটিকার মাঝখানে ডুবে যাওয়া এই জাহাজের কোনো নাবিকেরই বেঁচে থাকার কথা নয়, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এন্ডুরেন্সের কেউই মারা যাননি। ডুবে যাওয়ার আগেই সবাই লাইফবোটে করে জাহাজ থেকে নিরাপদে বেরিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে ওই জাহাজের একজন নাবিক ওই সমুদ্র সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের জাহাজটি যেখানে ডুবেছে, সেটি পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে সমুদ্রের সবচেয়ে বাজে অংশ।’
ডুবে যাওয়ার প্রায় ১০৭ বছর পর, এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে জাহাজটি খুঁজে বের করার জন্য অভিযান চালায় ‘এন্ডুরেন্স ২২’ নামের একটি দল। এন্ডুরেন্সকে সমুদ্রের তলদেশে চিহ্নিত করতে সক্ষমও হয় দলটি। পরবর্তী সময়ে অভিযানটির পরিচালক এ সম্পর্কে জানান, ‘এখন পর্যন্ত যত জাহাজ সমুদ্রের তলদেশে পাওয়া গেছে, তার মধ্যে এন্ডুরেন্সকেই সবচেয়ে দুর্গম জায়গায় পাওয়া গেল। ফলে এই অভিযানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ধার অভিযান বলা যেতে পারে।’
এইচ এম এস এরেবাস এবং এইচ এম এস টেরর
উনিশ শতকের দিকে মানুষের কাছে সমুদ্র ছিল অনেকটাই অজানা। সমুদ্রপথে কীভাবে আরও কম সময়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্রে যাওয়া যায়, তা খুঁজে বের করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল মানুষ। স্যার জন ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন এমনই একজন ব্রিটিশ অনুসন্ধানকারী। সে সময়ে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে কীভাবে আরও কম সময়ে যাওয়া যায়, এমন একটি রাস্তা নিয়ে খুব আলোচনা চলছিল। এমন কোনো রাস্তা আদৌ আছে কি না, সেটি জানার জন্য ১২৮ জন নাবিক নিয়ে এরেবাস ও টেরর নামের দুটি যুদ্ধজাহাজে করে অভিযানে বের হন ফ্রাঙ্কলিন। কিন্তু আবার বিপত্তি বাধায় বরফ। দুটি জাহাজই বরফের কবলে পড়ে ডুবে যেতে শুরু করে। জীবন বাঁচাতে জাহাজগুলো ছেড়ে যেতে বাধ্য হন নাবিকেরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাতেও কোনো লাভ হয়নি। জাহাজের কোনো নাবিকই বেঁচে ফিরতে পারেননি।
এই দুর্ঘটনার প্রায় ১৬০ বছর পর উত্তর মহাসাগরের তলদেশে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় জাহাজ দুটিকে। এরেবাসকে পাওয়া যায় ২০১৪ সালে। ২০১৬ সালে পাওয়া যায় টেররকে।
দ্য এস এস এডমুন্ড ফিতজগেরাল্ড
জাহাজডুবি বলামাত্রই হয়তো তোমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে একটি জাহাজ, এমন কোনো দৃশ্য। কিন্তু সমুদ্র ছাড়াও হ্রদ বা লেকেও যে বিশাল জাহাজ ডুবে যেতে পারে, সেটা কি জানো? এমনটাই ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ১০ নভেম্বর। ২৯ জন নাবিক নিয়ে উত্তর আমেরিকার লেক সুপিরিয়র পার হচ্ছিল ফিতজগেরাল্ড বা ‘হ্রদের রানি’ হিসেবে পরিচিত মালবাহী জাহাজটি। কিন্তু মাঝপথেই ভয়ংকর ঝড়ের মধ্যে পড়ে যায় ফিতজগেরাল্ড। প্রচণ্ড ঝড়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে সব নাবিককে নিয়ে হারিয়ে যায় হ্রদের গভীরে। ২৯ জন নাবিকের একজনও বেঁচে ফিরতে পারেননি, মারা যান প্রত্যেকে। ঠিক কী কারণে জাহাজটি ডুবে গেল, তা কেউই সঠিকভাবে জানতে পারেনি এখন পর্যন্ত।
দ্য কুইন অ্যানস রিভেঞ্জ
কুইন অ্যানস রিভেঞ্জের সঙ্গে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সেটি হলো, ব্ল্যাকবিয়ার্ড। হ্যাঁ, কুখ্যাত জলদস্যু ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কথাই বলছি, যাঁর আসল নাম এডওয়ার্ড টিচ। কুইন অ্যানসের আসল নাম ছিল, ‘লা কনকর্ড’। ১৯১৭ সালে জলদস্যু ব্ল্যাকবিয়ার্ড জাহাজটি দখলে নিয়ে নাম দেন কুইন অ্যানস রিভেঞ্জ। ব্ল্যাকবিয়ার্ড এই জাহাজে করে বেশ কিছুদিন চলাফেরা করেন, করেন অনেকগুলো ডাকাতিও। কুখ্যাত এই জলদস্যুর হাতে পড়ার প্রায় এক বছর পর, ১৮১৮ সালের ১০ জুন জাহাজটি ডুবে যায়। ধারণা করা হয়, ব্ল্যাকবিয়ার্ড নিজেই জাহাজটিকে ধ্বংস করে দেন। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, জাহাজটি বিভিন্ন কারণে বেশ ভালোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মেরামতের অযোগ্য বলে ধরে নিয়ে ধ্বংস করে দেওয়াকেই সহজ কাজ ভেবেছিলেন ব্ল্যাকবিয়ার্ড। ১৯৯৬ সালে ইন্টারসাল নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কুইন অ্যানস রিভেঞ্জের ধ্বংসাবশেষ সমুদ্রের নিচে চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়।
দ্য আর এম এস লুসিতানিয়া
১৯০৬ সালে লুসিতানিয়াকে চলাচলের উপযুক্ত হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। সে সময়কার সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী জাহাজগুলোর একটি ছিল দ্য আর এম এস লুসিতানিয়া। প্রায় ৩১ হাজার ৫০০ টনের এই ব্রিটিশ জাহাজ ২ হাজার যাত্রীকে একই সঙ্গে বহন করতে সক্ষম ছিল। বিশাল এই জাহাজ সে সময়ের অন্যতম দ্রুতগতিসম্পন্ন জাহাজ হিসেবেও পরিচিত ছিল। কিন্তু বিশ্বজুড়ে দ্য আর এম এস লুসিতানিয়া খ্যাতি পায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু দিকে, ১৯১৫ সালের ৭ মে। সেদিন শেষবারের মতো সমুদ্রে নামে বিশাল এই জাহাজ। দক্ষিণ আয়ারল্যান্ড পাড়ি দেওয়ার সময় একটি জার্মান যুদ্ধজাহাজ বা ইউ বোটের কবলে পড়ে যাত্রীবাহী লুসিতানিয়া। ইউ বোটটির আক্রমণে একসময় লুসিতানিয়া তলিয়ে যায় সমুদ্রে। অকালমৃত্যু হয় প্রায় ১ হাজার ১০০ নিরীহ যাত্রীর। এই ১ হাজার ১০০ জনের মধ্যে ১২৮ জন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকও ছিলেন এবং এই ঘটনার ফলেই পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের মিত্রপক্ষ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়।
দ্য আর এম এস টাইটানিক
১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল, সকাল। ততক্ষণে সবাই খবর পেয়ে গেছে যে ৮৮৩ ফুট দৈর্ঘ্যের টাইটানিক ধাক্কা খেয়েছে বিশাল এই বরফের চাঁইয়ের সঙ্গে। এটি ছিল উদ্বোধনের পর টাইটানিকের প্রথম যাত্রা। জাহাজটি ইংল্যান্ড থেকে রওনা দিয়েছিল নিউইয়র্কের পথে। কিন্তু এই খবর পাওয়ার পরও ইংল্যান্ডের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা ছিলেন নির্ভার। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোনো দুর্ঘটনাই টাইটানিককে ডোবাতে পারবে না।’ কিন্তু তিনি তখন জানতেন না যে ইতিমধ্যেই ডুবে গেছে তাঁর সাধের টাইটানিক, এর সঙ্গে ঝরে গেছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ মানুষের জীবন। টাইটানিক ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী জাহাজ। তখনকার সময়ের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে বানানো এই জাহাজও যে ডুবে যেতে পারে, তা ছিল মানুষের ধারণারও বাইরে। কিন্তু প্রকৃতির কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজটিও যে ক্ষুদ্র ও নগণ্য, তা আরেকবার প্রমাণ করে দিয়ে ডুবে যায় টাইটানিক।
এই দুর্ঘটনার প্রায় ৭০ বছর পর ১৯৮৫ সালে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করা হয়। এখন পর্যন্ত আরও অনেক বিশালাকার জাহাজ তলিয়ে গিয়েছে সমুদ্রে, কিন্তু টাইটানিকের মতো আর কোনো জাহাজ মানুষের মনে এভাবে দাগ কাটতে পারেনি।