রসিক রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের রসিকতা
মুখে ইয়া বড় দাড়ি, মাথায় লম্বা চুল আর ঋষির মতো চেহারা দেখে ভেবো না রবীন্দ্রনাথ রোবটের মতো গম্ভীর ছিলেন। বরং তাঁর সূক্ষ্ম রসিকতা কিংবা রসাল কাণ্ড যেমন সেকালে তাঁর বন্ধু-স্বজনদের হাসিয়েছে, সে গল্প শুনলে তোমাদেরও হাসি পাবে।
আবার ধরো ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো কাজী নজরুল ইসলাম কিন্তু সব সময় বিদ্রোহের আগুনে পোড়েননি। তেমনি তাঁর ডাকনাম ‘দুখু মিয়া’ নাম বলে ভেবো না তিনি রসিকতা করতে জানতেন না। আজ এই দুই মহান লেখকের রসিকতার গল্প শুনলে কেমন হয়?
রবীন্দ্র-রসিকতা
কবিগুরুর দাড়ির কথা তো জানোই। দুষ্টু ছেলের দল এই দাড়ি নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়ে না। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে দাড়ি নিয়ে রসিকতার কথা শুনলে কী ভাবতেন? রেগে যেতেন?
মনে হয় না, কবিগুরু নিজেই একবার নিজের দাড়ি নিয়ে রসিকতা করেছিলেন।
একবার এক সংগীতানুষ্ঠানে অতিথি হয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। ধ্রুপদি সংগীতের আসর। গলা কাঁপিয়ে নানা ভঙ্গিমায় গাওয়া হয় এসব গুরুগম্ভীর শাস্ত্রীয় সংগীত। যাঁরা গুপী গাইন বাঘা বাইন দেখেছ, তার সুন্ডির রাজদরবারে সেই গানের বাজির কথা ভেবে দেখত পারো। গুপি-বাঘা ছাড়া বাকি সব বড় বড় ওস্তাদ ধ্রুপদি গান গেয়ে রাজাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
কবিগুরুর সেই সংগীতানুষ্ঠানে গান গাইছিলেন তখনকার বিখ্যাত ধ্রুপদি গানের শিল্পী গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর গানের মূর্ছনায় দর্শকেরা আচ্ছন্ন। আচ্ছন্ন রবীন্দ্রনাথও।
কবিগুরুও খুব ভালো গান গাইতেন। এ কথা কারও অজানা ছিল না। সেদিন গোপেশ্বরের গান গাওয়া শেষ হলে আয়োজকেরা ধরলেন কবিগুরুকে। তাঁকেও গান গাইতে হবে। গানের প্রস্তুতি সেদিন নিয়ে যাননি কবি। কিন্তু আয়োজকেরা নাছোড়বান্দা।
অগত্যা রবীন্দ্রনাথ রসিকতা করে বললেন, ‘বুঝেছি, গোপেশ্বরের পর এবার দাড়িশ্বরের পালা।’
কবিগুরুর এ কথা শুনে উপস্থিত লোকজন হা হা করে হেসে উঠল।
একদিন নিজের ঘরে বসে লিখছিলেন কবিগুরু। বড় একটা টেবিলের ওপর অনেকটা ঝুঁকে বসে চলছিল লেখালেখি। এ সময় তাঁর ঘরে ঢুকলেন আরেক বিখ্যাত সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুল। রবীন্দ্রনাথের এই অবস্থা দেখে বনফুলের মায়া হলো। ভাবলেন ফ্রিতে একটু জ্ঞান দিয়ে যাই। তাতে কবিগুরু হয়তো উপকার হবে। এমনভাবে ঝুঁকে লেখা তো কষ্টের। কোমরে ব্যথা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কবির মনোযোগ নষ্ট করাও ঠিক হবে না। তাই বনফুল কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। কবির লেখা শেষ হলে বনফুল বললেন, ‘গুরুদেব, অত ঝুঁকে লেখা কি ভালো? আপনার কষ্ট হয় না?’
রবীন্দ্রনাথ চুপ করে রইলেন, বনফুলের উপদেশ কী—সেটাই শুনতে চান।
বনফুল তখন বললেন, ‘আজকাল তো কত রকমের চেয়ার বেরিয়েছে। সেগুলোর থেকে সুবিধামতো একটা কিনে নিলেই হয়।’
মুচকি হেসে রবীন্দ্রনাথ এবার মুখ খুললেন। বললেন, ‘জানি। এ ধরনের সব চেয়ারই আমার আছে। কিন্তু সেগুলোতে বসে লিখে শান্তি পাই না। ঝুঁকে বসে না লিখলে আমার লেখা ঠিক আসে না। আসলে কুঁজোর জল কমে গেছে কিনা, তাই উপুড় করতে হয়।’
এ কথা শুনে বনফুল হেসে ফেললেন।
রসিক নজরুল
কাজী নজরুল এসেছেন সিরাজগঞ্জে। সেখানে আয়োজন করা হয়েছে নিখিলবঙ্গ মুসলিম সম্মেলন। সেই সম্মেলনের সভাপতি তিনি। আয়োজকদের একজনের বাড়িতে নজরুলের খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। খাবার বেশ ভালো। তৃপ্তি করে খেলেন বিদ্রোহী কবি। শেষ পাতে দেওয়া হলো দই।
দই মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের মুখ বিকৃত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘এটা কী?’
পরিবেশনকারী জবাবে বললেন, ‘দই। খেয়ে দেখুন না। দারুণ স্বাদ।’
‘বুঝলাম এটা দই, কিন্তু এই দই কি তেঁতুলগাছে ধরে?’ নজরুল পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
পরিবেশনকারী বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘না, তা হবে কেন। কিন্তু এ কথা কেন বলছেন?’
কবি বললেন, ‘তাহলে এত টক যে!’
সিরাজগঞ্জেই আরেকটা কাণ্ড ঘটেছিল। সেটাও খাওয়ার সময়। দুপুরের খাবার। সে এক মহাযজ্ঞ! সবাই খেতে বসেছেন। বসেছেন বিদ্রোহী কবিও। খাওয়া শুরুর পর পরিবেশনকারী নজরুলের পাতে ইলিশের টুকরো তুলে দিলেন। পদ্মার ইলিশ। বড়ই সুস্বাদু। কবি তৃপ্তি করে খেলেন। প্রথম টুকরোটা শেষ হলে আরেক টুকরো তুলে দিলেন পরিবেশনকারী। এরপর তৃতীয় টুকরো যখন দেওয়ার চেষ্টা করছেন, নজরুল তাঁকে থামিয়ে বললেন, ‘আর দিয়ো না।’
পরিবেশনকারী জোর করে তবু আরেক টুকরো দিতে চাইছেন, তখন নজরুল বললেন, ‘আরে, করছ কী? এত মাছ খেলে শেষকালে আমাকে বিড়ালে কামড়াবে যে!’
কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। সুফিয়া কামালের বাড়িতে প্রায়ই গানের আসর বসত। নজরুলের নিমন্ত্রণ থাকত সেই আয়োজনে। একদিন এমনই এক আয়োজনে নজরুলও গিয়েছেন। কিন্তু নজরুলের পেছনে ফেউ লেগেছে। মানে ব্রিটিশদের গোয়েন্দা আরকি। নজরুলের ওপর চোখ রাখার জন্য সেখানে হাজির লোকটা। তাঁকে দেখে নজরুল ছড়া কাটলেন, ‘তুমি টিকটিকি, জানি ঠিকঠিকই।’ এ কথা শুনে গোয়েন্দা লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ওদিকে সুফিয়া কামাল নজরুলকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দাদু। তুমি একে চিনলে কী করে?’
‘গায়ের গন্ধে। বড়কুটুম যে!’ নজরুলের উত্তর।