চিংড়ি বা কাঁকড়া কি ব্যথা অনুভব করে
ধারাবাহিক একটি গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা বলছেন, কাঁকড়া, লবস্টারসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী ব্যথা অনুভব করে। এ কারণে বিজ্ঞানীরা এসব প্রাণীদের প্রতি আরও মানবিক আচরণের জন্য মানবিক হতে বলছেন।
বিশ্বজুড়ে কাঁকড়া ও লবস্টারকে জীবন্ত ফুটন্ত পানিতে ফেলে রান্না করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে ধারণা ছিল, এই প্রাণীগুলোর ব্যথা অনুভবের ক্ষমতা নেই। কারণ এদের মস্তিষ্কে ব্যথা অনুভব করার সুনির্দিষ্ট অংশ নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা।
২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বায়োলজি জার্নালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সৈকতের কাঁকড়া (Carcinus maenas) ব্যথা অনুভব করতে সক্ষম। এই কাঁকড়াদের নোসিসেপ্টরস (nociceptors) রয়েছে, যা শরীরের ক্ষত বা আঘাত শনাক্ত করে মস্তিষ্কে ব্যথার সংকেত পাঠায়।
গবেষণায় ২০টি কাঁকড়ার ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। এদের চোখ, অ্যান্টেনা, নখরের সংযোগস্থল ও সংবেদনশীল অংশে হালকা ব্যথাদায়ক উপাদান (যেমন—ভিনেগার) প্রয়োগ করা হয়। এরপর বৈদ্যুতিক ইলেক্ট্রোডের মাধ্যমে কাঁকড়াদের স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষকরা দেখতে পান, এই প্রতিক্রিয়াগুলো ব্যথার সংবেদনশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
নোসিসেপ্টরস মানুষের দেহেও থাকে। এটি এমন এক ধরনের সংবেদনশীল রিসেপ্টর, যা শরীরের ক্ষতির আশঙ্কা বুঝতে পারে এবং মস্তিষ্কে ব্যথার অনুভূতি পাঠায়। এই অনুভূতি পাঠানোর কারণ, যেন আমরা সতর্ক হতে পারি।
তবে শুধু নোসিসেপ্টরস থাকার অর্থ এই না যে কাঁকড়াগুলো আমাদের মতো করে ব্যথা অনুভব করে। গবেষণার সহ-লেখক ও সুইডেনের গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী এলেফথেরিয়স কাসিউরাস বলেছেন, ‘নোসিসেপ্টরস থাকলেই ব্যথা অনুভূত হয় এমনটা বলা যাবে না, তবে এটি ব্যথা উপলব্ধির গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ।’
কাসিউরাস আরও জানান, কাঁকড়া ও লবস্টারের ব্যথা অনুভব করার বিষয়টি আগেও গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে এদের আচরণগত প্রতিক্রিয়াগুলো থেকে বোঝা যায়, এরা ব্যথা এড়ানোর চেষ্টা করে।
একটি প্রাণী সত্যিই ব্যথা অনুভব করে কিনা তা বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা কয়েকটি মানদণ্ড অনুসরণ করেন। এর মধ্যে রয়েছে, প্রাণীর শরীরে নোসিসেপ্টরস থাকা, ব্যথা সম্পর্কিত মস্তিষ্কের অঞ্চল থাকা, ব্যথা কমানোর জন্য অ্যানেস্থেটিকের (চেতনানাশক) প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখানো, ব্যথা বা আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার আচরণ দেখানো ইত্যাদি।
২০১৬ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হার্মিট কাঁকড়াগুলো (যারা খোলসের ভেতর থাকে) বৈদ্যুতিক শক পেলে খোলস ছেড়ে পালিয়ে যায়। তবে যদি শক পাওয়ার সময় আশেপাশে শিকারির গন্ধ থাকে, তাহলে এরা পালানোর পরিবর্তে ঝুঁকি গ্রহণ করে খোলসেই থাকে। এর মানে হলো, এরা ব্যথা ও নিরাপত্তার মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করে, যা নিছক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং ব্যথা অনুভবের সম্ভাব্য প্রমাণ।
এই গবেষণাগুলোর ফলাফলের পর বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, কাঁকড়া ও লবস্টারকে জীবন্ত ফুটন্ত পানিতে রান্না করা নিষ্ঠুরতা এবং এটি নিষিদ্ধ করা উচিত। যুক্তরাজ্যে এই বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য আলোচনা হয়েছে। যদিও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে এবং নিউজিল্যান্ডে এই নিষেধাজ্ঞা ইতিমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বর্তমানে স্কুইড, ঝিনুক ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর ব্যথা অনুভবের ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা করছেন। যদিও অনেক সামুদ্রিক প্রাণীর নোসিসেপ্টরস রয়েছে, এবং এরা ব্যথা এড়ানোর চেষ্টা করে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিতভাবে বলতে পারেননি এরা ঠিক কীভাবে ব্যথা অনুভব করে।
গবেষক কাসিউরাস বলেন, ‘আমরা মানুষ বিভিন্ন কারণে প্রাণীদের ব্যবহার করি—খাদ্যের জন্য, গবেষণার জন্য এবং অন্যান্য উদ্দেশ্যে। কিন্তু যদি এরা ব্যথা অনুভব করে, তাহলে আমাদের অবশ্যই এদের প্রতি ন্যায়সংগত আচরণ করতে হবে এবং এদের কষ্ট কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এই গবেষণাগুলো সামুদ্রিক প্রাণীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সাহায্য করতে পারে। ভবিষ্যতে আইন ও নীতিমালা তৈরি করে এদের প্রতি আরও মানবিক আচরণ নিশ্চিত করা যেতে পারে।