জাহাজ দেখে বেড়ে উঠেছেন
জুল ভার্ন জন্মেছিলেন সাগরপারের শহরে। ফ্রান্সের পশ্চিমে বিস্কে উপসাগরের তীরে অবস্থিত নাতার বন্দর। এই বন্দরনগরীতে শৈশব কাটে জুল ভার্নের। তখন ফ্রান্সের লোকজন একটু রোদ উঠলেই বেড়াতে যেতেন। গরমের দিনে লম্বা সময়ের জন্য ছুটিতে কোথাও যাওয়া ছিল ফ্রান্সবাসীর বিনোদন। জুল ভার্নের পরিবার গ্রীষ্মকালে সময় কাটাতে যেত কাছের ব্রে শহরে। সেখানে জুল ভার্ন ও তাঁর ভাই পল প্রায়ই ফ্রান্সের মুদ্রা এক ফ্রাঁ দিয়ে পুরো দিনের জন্য নৌকা ভাড়া করতেন। ভার্ন নিজেই বলেছেন, নদীতে প্রচুর নৌযান চলার দৃশ্য তাঁর কল্পনার দরজা খুলে দিয়েছে। বাড়ির কাছের বন্দরটি ছিল ফরাসি জাহাজ নির্মাতা আর ব্যবসায়ীদের সমাগমের জায়গা।
মজার ব্যাপার হলো, ১২ বছর বয়সে জাহাজের কেবিন বয় হিসেবে কাজ করার জন্য বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন মায়ের কাছে। মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন, নিজের মনের মধ্যেই ঘুরে বেড়াবেন, জাহাজে চেপে বসবেন না। কিন্তু পরে এই প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেননি। কিনেছিলেন তিনটি নৌযান।
লেখক কল্পনার জাহাজে চেপে ছেলেবেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন বন্দর থেকে বন্দরে। আর এভাবে তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি শ্রেষ্ঠ কিছু লেখা। সাগরতলের গল্প, বিশ্বভ্রমণের গল্প খুব বিখ্যাত হয়ে আছে। ছেলেবেলার কল্পনায় যার শুরু, শত বছর ধরে পাঠক এর ফল ভোগ করছেন।
পালতোলা ইয়ট ছিল জুল ভার্নের
১৮৬০-এর দশকে ভার্নের কর্মজীবন শুরু হয়। টাকাপয়সা বেশ ভালোই উপার্জন করেছিলেন। জমানো অর্থ দিয়ে ১৮৬৭ সালে ছোট একটি ইয়ট কিনে ফেলেন। ছেলে মিশেলের নামে ইয়টের নাম রাখেন সেন্ট মিশেল। তখন তিনি বাস করতেন অ্যামিয়েন্সে। ইউরোপের চারপাশে চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জ, ইংলিশ উপকূল আর বিস্কে উপসাগরে সময় কাটাতেন। সমুদ্রে ঘুরে শান্তি পেতেন জুল ভার্ন। নিরিবিলি পরিবেশ উপভোগ করতেন। এই পালতোলা ইয়টে ভ্রমণের সময়ই লিখেছেন সেরা সব লেখা। অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ, টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সির মতো রোমাঞ্চকর উপন্যাস লিখেছেন।
আয় বেড়ে গেলে সেন্ট মিশেলের বদলে নিলেন আরও বড় এক ইয়ট। নাম দেন সেন্ট মিশেল টু। কয়েক বছর পর কেনেন আরেকটি ইয়ট। নাম তো তুমি অনুমান করতেই পারছ। সেন্ট মিশেল থ্রি। আগের দুটি ছিল পালতোলা ইয়ট। শেষেরটি স্টিম ইঞ্জিনের। এই ইয়টে চেপে তিনি গিয়েছেন স্কটল্যান্ড আর ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায়। ইয়টে নিয়োগ দিয়েছিলেন ১০ জন ক্রুকে।
লিখেছিলেন বড়দের কথা ভেবে
না, জুল ভার্নের লেখা সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হয়নি। তিনি লিখতেন ফরাসি ভাষায়। তাঁর লেখা সব সময় আন্তর্জাতিক পাঠকের মনোযোগ পেয়েছে। ১৮৫০–এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত তাঁর লেখা প্রায় ১৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এভাবে তিনি হয়েছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অনূদিত লেখক। শেক্সপিয়ারের চেয়ে বেশিবার অনুবাদ হয়েছে জুল ভার্নের লেখা। ১ নম্বর অবস্থান লেখক আগাথা ক্রিস্টির। এরপরই আছেন জুল ভার্ন।
জুল ভার্ন মূলত লিখেছিলেন বড়দের কথা ভেবে। কিন্তু ইংরেজি ভাষার প্রকাশকেরা তাঁর বিজ্ঞান কল্পকাহিনিকে প্রচার করেন কিশোরপাঠ্য বলে। ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাঁর বই শিশুদের কাছে বিক্রি করা হয়। অনুবাদে গল্পগুলোকে সহজ করা হয় । কেটেছেঁটে ছোট করা হয় অনুচ্ছেদগুলো। সংলাপগুলোও সংক্ষেপ করা হয়েছে অনেক সময়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমালোচনা হিসেবে মনে হতে পারে, এমন লেখাও কেটেছেঁটে বাদ দেওয়া হয়েছে। অনেক অনুবাদে প্লট আর টোন দুটোই পাল্টে গেছে। তবে কিছু পাঠক এখন জুল ভার্নের মূল লেখা বা আসল লেখার খোঁজ করেন।
দুই সন্তানসহ বিধবা নারীকে বিয়ে করেন জুল ভার্ন। খরচ জোগাড় করতে চাকরি নেন স্টক ব্রোকারের। চাকরির আগে তিনি কাজ করতেন থিয়েটারে। নাটক লিখতেন। খরচের চাপে এই চাকরি ছেড়ে নেমে পড়েন ব্রোকারের কাজে। তবে এই চাকরি লেখালেখি থেকে জুল ভার্নের মন সরিয়ে নিতে পারেনি। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাওয়ার আগে কয়েক ঘণ্টা ধরে লিখতেন, পড়তেন আর ঘাঁটাঘাঁটি করতেন।
আধুনিক কালে পাঠক মনে করেন, জুল ভার্নের বিখ্যাত বইগুলো বুঝি আলাদা কোনো বই। তবে তাঁর দুঃসাহসিক উপন্যাসগুলো আসলে একটি সিরিজের অংশ। ১৮৬০-এর দশকের শুরুতে জুল ভার্নের পরিচয় হয় প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক ও ম্যাগাজিন সম্পাদক পিয়েরে-জুলস হেজেলের সঙ্গে। ৬২টি উপন্যাস ও ১২টি গল্প প্রকাশ করেন এই প্রকাশক। এর আগে ১৫ জন প্রকাশক জুল ভার্নকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। যিনি জুল ভার্নের প্রথম উপন্যাস ফাইভ উইকস ইন আ বেলুন প্রকাশ করতে সাহায্য করেন। উপন্যাসটি জুল ভার্নের লেখা ও হেজেলের প্রকাশ করা কয়েক ডজন বইয়ের সিরিজের শুরুর বই ছিল। এই সিরিজের উপন্যাসের বেশির ভাগই বই আকারে প্রকাশ হওয়ার আগে হেজেলের ম্যাগাজিনে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। বিখ্যাত বই টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সির ক্ষেত্রেও তা–ই।
অসুস্থ ছিলেন দীর্ঘ সময়
জুল ভার্নের বয়স যখন ২০–এর দিকে, হঠাৎ পেটে তীব্র ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেন। পরিবারের সদস্যদের চিঠি লিখে যন্ত্রণাদায়ক পেটের ব্যথার কথা লিখেছিলেন। কিন্তু চিকিৎসকেরা তখন সঠিক রোগ নির্ণয় করতে পারেননি। তাঁর ব্যথা কমানোর চেষ্টা করতে খাবারদাবার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছিল শুধু ডিম আর দুগ্ধজাত খাবার খেতে। ইতিহাসবিদেরা বিশ্বাস করেন, ভার্নের কোলাইটিস বা হজমব্যাধি ছিল।
পেটের ব্যথার চেয়ে বাজে অসুখে পড়েছিলেন তিনি। সারা জীবন ভুগেছেন মুখের পক্ষাঘাতে। এই পক্ষাঘাতের আবার পাঁচ পর্ব ছিল। একপর্যায়ে তাঁর মুখের একপাশ হঠাৎ অচল হয়ে যায়। প্রথম অবস্থায় চিকিৎসকেরা মুখের স্নায়ুকে বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা দিয়ে চিকিত্সা করেছিলেন। কিন্তু পাঁচ বছর পর আবারও মুখ পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়। সম্প্রতি গবেষকেরা বের করেছেন, তাঁর মুখের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কানের সংক্রমণ বা প্রদাহের ফলে এই অবস্থা হতে পারে।
৫০ বছর বয়সের পর টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন জুল ভার্ন। জীবনের শেষ দশকে তাঁর স্বাস্থ্য বেশ খারাপ হয়। উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘস্থায়ী মাথা ঘোরা, টিনিটাসসহ আরও কিছু রোগে ভুগছিলেন। শেষ পর্যন্ত আংশিক অন্ধ হয়ে যান লেখক।
গুলি লেগেছিল পায়ে
১৮৮৬ সালের মার্চ মাসে ভার্নের জীবনে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। তখন বয়স ৫৮ বছর। বাকি জীবনে ভুগতে হয় এই ঘটনায়। ভার্নের ভাইয়ের ছেলে গ্যাস্টন। বয়স তখন ২০–এর কোঠায়। মানসিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন গ্যাস্টন। হঠাৎ খেপে জুল ভার্নকে আঘাত করতে চান। জুল ভার্ন একদিন বাড়ি ফিরছিলেন। গ্যাস্টন তাঁকে পিস্তল দিয়ে দুবার গুলি করেন। সৌভাগ্যক্রমে ভার্ন বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু গ্যাস্টনের ছোড়া দ্বিতীয় গুলিটি ভার্নের বাঁ পায়ে লাগে। বাকি জীবন এই গুলির ক্ষত বয়ে বেড়ান জুল ভার্ন।
এই ঘটনার পর গ্যাস্টনকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। তিনি নির্দিষ্ট কোনো রোগে আক্রান্ত ছিলেন না। তবে বেশির ভাগ ইতিহাসবিদ মনে করেন, গ্যাস্টন প্যারানইয়া বা সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছিলেন। জুল ভার্ন কখনোই গুলির ক্ষত থেকে পুরোপুরি সেরে ওঠেননি। বুলেটটি তাঁর বাঁ পা–কে বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। ডায়াবেটিস থাকায় সেরে ওঠা কঠিন ছিল। ক্ষত বা সংক্রমণ ছিল ১৯০৫ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত।
জুল ভার্নের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছিল
জুল ভার্ন তাঁর কল্পকাহিনিতে যে প্রযুক্তি কল্পনা করেছিলেন, কিছুকাল পর তার অনেকগুলো বাস্তবে পরিণত হয়। ভার্ন যে যন্ত্রের কথা বলেছিলেন, এর মধ্যে একটি নটিলাস, টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি উপন্যাসে বৈদ্যুতিক সাবমেরিনের কথা—তিনি এই সাবমেরিন নিয়ে লেখার কয়েক বছর পর সত্যি হয়েছিল। ১৮৬৯ সালে টোয়েন্টি থাইজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সির প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৮০-এর দশকে প্রথম ব্যাটারিচালিত সাবমেরিন চালু হয়। একই রকম সাবমেরিন এখনো ব্যবহার করা হয়।
এ ছাড়া প্যারিস ইন দ্য টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরিতে বেশ কিছু প্রযুক্তির ভবিষ্যদ্বাণী পরে সত্যি হয়েছে। ১৮৬৩ সালে লেখা ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসে তিনি ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির শহর প্যারিসের কল্পনা করেন। ভার্ন আকাশছোঁয়া ভবন, লিফট, গাড়ির ভেতরে ইঞ্জিন, ট্রেন, শহরের বৈদ্যুতিক লাইটের কথা লিখেছেন। তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। এমনকি তিনি কিছু যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর (যেমন কম্পিউটার) নিয়ে লিখেছেন, যা একটি নেটওয়ার্কের (যেমন ইন্টারনেট) মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। ১৮২৮ সালে জন্মগ্রহণ করা একজন লোকের কল্পনায় এই ধারণা আসা অভাবনীয়।
অবাক করা বিষয়, জুল ভার্ন কখনো বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। বিজ্ঞান অনুশীলনও করেননি। অ্যামিয়েন্সের একটি লাইব্রেরিতে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা পড়তেন। অনেক নোট নিতেন। ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য কার্ডে তথ্য লিখে রাখতেন। তবে তাঁর বন্ধু ও পরিবারের মধ্যে বিজ্ঞানীদের কাছে তাঁর অনেক প্রশ্ন ছিল। তাঁদের বিজ্ঞানের কথা জিজ্ঞেস করতেন। বিখ্যাত হওয়ার পর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে দেখা করা বা সাক্ষাৎকার নেওয়া তাঁর জন্য খুব সহজ হয়ে যায়।
হেলিকপ্টার, ভিডিও কনফারেন্স, ড্রোন, বৈদ্যুতিক চেয়ার, নির্দেশনা দেওয়া যায়। এমন মিসাইলসহ আরও কিছু প্রযুক্তির ধারণা ভার্নের লেখায় ছিল। নিজের বাসা ও লাইব্রেরিতে সময় কাটানো এক লোকের মাথা থেকে অসাধারণ বিশ্বভ্রমণের কল্পনা বের হয়েছে। বিস্ময়কর বটে!