গরমে খেয়াল রেখো প্রাণীদের প্রতিও

কী গরমটাই না পড়েছে! গরমের তীব্রতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধও রাখা হয়েছে। গরমে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন কেউ কেউ। আর অনেকেই পানিশূন্যতায় ভোগেন, অবসন্ন হয়ে পড়েন। বাদ যায় না প্রাণিকুলও। হয়তো তোমাদের বাড়ির সামনেই একটা কুকুর বসে আছে এ মুহূর্তে। বেশ হাঁপাচ্ছে। তৃষ্ণার্ত প্রাণে একটু পানি দেবে, এমন কেউ হয়তো নেই সেখানে। সবাই ব্যস্ত নিজের জগৎ নিয়ে। তোমাদের কারও পোষ্য না হলেও সে কিন্তু তোমাদের এলাকারই কুকুর। বাড়ি বা দোকানের সামনে, সিঁড়ির গোড়ায়, গ্যারেজে, গাছের নিচে—একটু ছায়ার জন্য আশ্রয় নেওয়া কোনো প্রাণীকে তাড়িয়ে দিয়ো না যেন। মনে রেখো, আমাদের আশপাশে থাকা কোনো প্রাণীই আমাদের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং উপকারী।

তোমাদের মধ্যে যাদের বাড়িতে পোষা প্রাণী রয়েছে, তারা হয়তো লক্ষ করেছ, গরমে ওদের খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলার সব নিয়ম বদলে যাচ্ছে। খাবারে রুচি নেই, হাঁ করে হাঁপাচ্ছে কেবল। আর বাড়ির শীতলতম কোণটা খুঁজে নিয়ে সেখানে হাত-পা (নাকি চার পা!) ছড়িয়ে শুয়ে থাকছে। প্রচণ্ড গরমে অনেক প্রাণীরই হিটস্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যান্য অসুস্থতার ঝুঁকি তো থাকেই। এই সময়টায় ওদের সুস্থতার জন্য তোমরা কী করতে পারো, জেনে নাও আজ। গরমে বিড়াল, কুকুর আর খরগোশের যত্নে কী করতে হবে, জানালেন রাজধানীর গুলশান বাড্ডা লিংক রোডে অবস্থিত বিশ্বাস ভেটেরিনারি ক্লিনিকের প্রাণিচিকিৎসক সুশ্যাম বিশ্বাস।

আরও পড়ুন

পানি, পানি, পানি

গরমে ওদের খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলার সব নিয়ম বদলে যাচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

প্রাণীদের জন্য পানির ব্যবস্থা রাখাটা এই গরমে ওদের জন্য আমাদের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। এই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করলে ওরা ভুগবে পানিশূন্যতায়। তখন ওরা হাঁপাবে খুব। মুখ থেকে লালাও ঝরতে পারে। প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাবে, খুব ঘন প্রস্রাব হবে। আর প্রস্রাব করতে কষ্টও হবে খুব। পানিশূন্যতায় ভুগলে আমাদের যেমনটা হয়, ঠিক তেমনই। আমরা যেমন গরমের সময় বারবার পানি খাই, ওদেরও প্রয়োজন তেমনটাই। তাই ওদের জন্য সুবিধাজনক জায়গায় পানি রেখে দিতে হবে। দুই-তিন বেলা পানি বদলেও দিতে হবে। পানিতে ময়লার স্তর পড়লে আরও ঘন ঘন বদলে দিতে হবে পানি। পানির পাত্রটা পরিষ্কার রাখাও জরুরি। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়া ওদের ওরস্যালাইন দেওয়া যাবে না, তাতে শরীরের লবণের তারতম্য হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

খাবারেও পানি

এলাকার কুকুর-বিড়াল বা অন্যান্য প্রাণীও কিন্তু পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ
ছবি: প্রথম আলো

ওদের খাবারে পর্যাপ্ত পানি থাকাটাও জরুরি। তোমরা যদি ওদের মাছ-মাংস খেতে দাও, তাহলে যিনি খাবারটা তৈরি করেন, তাঁকে বলে রেখো, খাবারে যাতে পাতলা ঝোল থাকে বেশ খানিকটা। তবে মনে রেখো, প্রাণীদের জন্য রান্নায় কখনোই পেঁয়াজ-রসুন দিতে নেই। পানি দিয়ে সেদ্ধ করা খাবারই ওদের জন্য সবচেয়ে ভালো। তবে ওরা পানি কম খাচ্ছে বলে মনে হলে সামান্য লবণ দিয়ে সেদ্ধ করা যেতে পারে। সেদ্ধ করার পর মাছ বা মাংসের টুকরা হাত দিয়ে থেঁতো করে ঝোলসহ খেতে দিতে পারো ওদের। যদি প্যাকেটের খাবার (ক্যাট ফুড, ডগ ফুড) দিয়ে থাকো, তাহলে নরম বা ভেজা খাবার দিয়ো। শুকনা খাবার দিতে চাইলেও তা সারা দিনে একবারের বেশি নয়।

আরও পড়ুন

উত্তাপে সুস্থতা

তিন-চার দিন অন্তর গোসল করিয়ে দিতে পারো পোষা প্রাণীকে। এ কাজে বড়দের সাহায্য নিতে পারো। ওদের জন্য নির্দিষ্ট যে শ্যাম্পু কিনতে পাওয়া যায়, সেগুলোই ব্যবহার করতে হবে, নইলে ওদের ক্ষতি হয়। তা ছাড়া প্রতিদিন অন্তত এক-দুবার ওদের মাথায় ভেজা হাত বুলিয়ে দিয়ো, শরীর এবং থাবার নিচটা মুছে দিয়ো নরম, ভেজা কাপড় দিয়ে; খরগোশের হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বলে ওদের ক্ষেত্রে সারা দিনে অন্তত তিন-চারবার এই ভেজানোর কাজটুকু করতে হবে। আর সব সময় খেয়াল রেখো, কোনো প্রাণীর খাওয়া, গোসল করা কিংবা শরীর-মাথা-থাবা ভেজানোর জন্য একেবারে ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা ঠিক নয়। স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিই ওদের জন্য ভালো। আরও খেয়াল রেখো, ওদের কানে যেন পানি না ঢোকে। তবে তোমাদের বাড়িতে যদি এসি থাকে, আর পোষা প্রাণীটি যদি এসিতেই থাকে অধিকাংশ সময়, তাহলে পাঁচ-সাত দিন অন্তর গোসল করালেই চলবে। এসিতে থাকলে একাধিকবার মাথা, শরীর বা থাবা ভিজিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

শরীর গরম হয়ে গেলেও ওদের মাথায় ভেজা হাত বুলিয়ে দিতে হবে
ছবি: প্রথম আলো

আর শরীর গরম হয়ে গেলেও ওদের মাথায় ভেজা হাত বুলিয়ে দিতে হবে। শরীর এবং থাবার নিচটাও মুছে দিয়ো ভেজা কাপড় দিয়ে।

তোমার বিড়াল বা কুকুরের লোম যদি খুব ঘন হয় (কিছু বিদেশি বিড়াল-কুকুরের ক্ষেত্রে এমন লোম দেখা যায়), তাহলে লোম ছাঁটিয়ে নিতে পারো। তবে পুরোপুরি চেঁছে দিয়ো না যেন।

আরও পড়ুন

রান্না বা সেদ্ধ করা খাবার এবং প্যাকেটের নরম খাবার সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট খাবার খেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে ওরাও। তাই এসব খাবার খেতে দেওয়ার পর আধঘণ্টার মধ্যে তা খাওয়া হয়ে গেলে ভালো। নইলে তা ফ্রিজে উঠিয়ে রেখো। পরে যখন ফ্রিজ থেকে বের করা হবে, তখন রান্না বা সেদ্ধ করা খাবার গরম করে দিতে হবে। প্যাকেটের নরম খাবার ফ্রিজে তুলে রাখা হলেও অবশ্য গরম করার সুযোগ নেই। সেটি খাওয়ানোর বেশ খানিকক্ষণ আগে ফ্রিজের বাইরে বের করে রাখলে ঠান্ডা ভাবটা কেটে যাবে। এরপর খাওয়ানো যাবে।

ঘরের যে জায়গাটায় ওরা বেশি থাকে, সেই জায়গার মেঝে একাধিকবার পানি দিয়ে মুছে দিতে পারো।

খেলার জন্য বরফের ছোট্ট কিউব দিতে পারো রোজ, তাতে ওরা খানিকটা আরাম পাবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, একটু পর বরফ গলতে শুরু করলে মেঝে পিচ্ছিল হয়ে পড়বে। তাই গলতে শুরু করলে ওই বরফটা সরিয়ে দিতে হবে এবং মেঝে মুছে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে আরও একবার বরফ বের করে দিতে পারো ফ্রিজ থেকে। তবে প্রতিবারই এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে।

প্রাণীদের বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এমন সময় বেছে নিতে হবে, যখন তাপমাত্রা তুলনামূলক কম থাকে। ভোরবেলা, বিকেল বা সন্ধ্যায় বাইরে নিতে পারো ওদের।

গ্রামে যাওয়ার সময় সঙ্গে যাচ্ছে পোষা বিড়াল
ছবি: প্রথম আলো

কোনো প্রাণী যেন কোথাও রাখা চলন্ত ফ্যানের নাগাল না পায়, সেদিকে খেয়াল রেখো।

প্রচণ্ড গরমে তোমার পোষা প্রাণীর কোনো টিকা নেওয়ার তারিখ চলে এলে আগে কাছের কোনো প্রাণিচিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করে নেবে।

কোনো প্রাণীকে কখনোই গাড়িতে একলা রেখে দিতে নেই। কোনো ঋতুতেই নয়।

পানিশূন্যতা হচ্ছে না তো?

সব সময় খেয়াল রেখো, পোষা প্রাণী খুব বেশি হাঁপাচ্ছে কি না কিংবা পানিশূন্যতার অন্যান্য লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি না। এ রকম কিছু লক্ষ করলে পানির চাহিদা পূরণ করতে ওদের একেবারে সামনেই পানি দিয়ে দেখতে পারো। যদি পানি খেয়ে নেয়, তাহলে তো খুবই ভালো। নইলে ড্রপারে করে মুখের একপাশ দিয়ে পানি দিতে পারো ফোঁটায় ফোঁটায়। তবে কাজটা করতে হবে খুবই সাবধানে। নইলে পানি চলে যাবে শ্বাসনালিতে। তাই এ কাজে বড়দের সহায়তা নেওয়া ভালো। আর নিকটস্থ প্রাণিচিকিৎসকের কাছ থেকে ড্রপারে পানি দেওয়ার নিয়মটা শিখে রাখতে পারো।

আরও পড়ুন

পোষা নয়, তবু আপন

অসুস্থতার অন্য কোনো লক্ষণ দেখা দিলে তাকে প্রাণিচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে
ছবি: প্রথম আলো

এলাকার কুকুর-বিড়াল বা অন্যান্য প্রাণীও কিন্তু পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ওদের ছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। প্রচণ্ড গরমে ওদের প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। বাড়ির নিচে, পথের ধারে কিংবা অন্য যেখানে সম্ভব, পানির পাত্র রেখে দিয়ো ওদের জন্য। বন্ধুরা মিলে এই গরমে এই একটা ভালো কাজ করতেই পারো। একটা জায়গায় এ রকম পানির পাত্র রাখা থাকলে সেখানকার তাপমাত্রাও কিন্তু খানিকটা কমে। অর্থাৎ, পথপ্রাণীর জন্য রাখা পাত্রের পানির কারণে পরোক্ষভাবে মানুষও উপকার পায়। এলাকার নিরাপত্তাকর্মী এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীকেও জানিয়ে রাখতে পারো, ওদের জন্য পানি রাখছ তোমরা। তাহলে পানির পাত্রগুলো কেউ সরিয়ে নেওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। বারান্দায় বা ছাদেও পানির পাত্র রেখে দিয়ো তৃষ্ণার্ত পাখিদের জন্য। পানির পাত্র হিসেবে প্লাস্টিকের পাত্র কিন্তু খুব একটা ভালো নয়। নিতান্ত নিরুপায় হলে কেবল তখনই প্লাস্টিকের পাত্র দেবে। আর একটা কথা, যেখানেই পানির পাত্র রেখে থাকো না কেন, বাহাত্তর ঘণ্টার আগেই পানি বদলে দিয়ো। নইলে জন্মাবে মশা। আর সবচেয়ে ভালো হয় রোজ দুই বেলা পানি বদলে দিতে পারলে। তাহলে পানিতে ময়লা জমবে না। সেটা সম্ভব না হলেও বাহাত্তর ঘণ্টার চেয়েও যতটা আগেভাগে পারা যায়, পানি বদলে দেওয়ার চেষ্টা করো। পানি রাখা হলে পাত্রের ভেতরটা পিচ্ছিল হয়ে যায়। তাই পানি বদলে দেওয়ার সময় পাত্রের ভেতরটা পরিষ্কার করে দেওয়া ভালো। সম্ভব হলে কিছুটা খাবারও দিয়ো। এই যেমন, সামান্য কেক-বিস্কুট কিংবা বাড়ির খাবারের উচ্ছিষ্ট দিতে পারো পথপ্রাণীদের। একটু খাবার, একটু পানি আর একটু আশ্রয় পেলে ওরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে তোমার প্রতি। তোমাকে বিপদে পড়তে দেখলে নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও তোমাকে বাঁচাতে ছুটে আসবে, এমন অনেক প্রাণী রয়েছে তোমার আশপাশেই।

অসুস্থ হয়ে পড়লে

কোনো প্রাণীর খাওয়াদাওয়া একেবারে কমে গেলে কিংবা অসুস্থতার অন্য কোনো লক্ষণ দেখা দিলে তাকে প্রাণিচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। মারাত্মক অসুস্থতা, যেমন হিটস্ট্রোক হলে প্রাণীটি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। এ রকম ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।

আরও পড়ুন