ক্যালেন্ডারের পাতায় কিংবা মোবাইল স্ক্রিনে হয়তো অদ্ভুত এই কাঠামো অনেকেই দেখেছ। ইংল্যান্ডের ওয়াইল্টশায়ারের সালসবারি প্লেইনে অবস্থিত স্টোনহেঞ্জ প্রাচীন মানুষের তৈরি অন্যতম বড় কাঠামো। হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা তৈরি করেছিলেন এটি। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও বিখ্যাত এই সৌধ ঘিরে রয়েছে রহস্যের জাল। চলো, তারই কিছুটা জানার চেষ্টা করি।
আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে নিওলিথিক যুগে এই বিশাল কাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। চারটা লম্বা ধাপে প্রায় এক হাজার বছর সময় লেগেছিল শেষ করতে। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, স্টোনহেঞ্জের সর্বশেষ পরিবর্তন ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে। ব্রোঞ্জযুগের শুরুর সময় ছিল সেটা।
তুমি যদি স্টোনহেঞ্জ দেখতে যাও, তাহলে দেখবে, অনেকগুলো বিশাল পাথর দাঁড়িয়ে আছে বৃত্তাকারভাবে। প্রায় ২৬ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে এসবের অবস্থান। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, স্টোনহেঞ্জের কাঠামোটা বদলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। প্রাচীন মানুষেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একে তৈরি করেছে, সংস্কার করেছে।
বারো শতকের গোড়ার দিকে ধর্মযাজক জিওফ্রে অব মনমাউথ স্টোনহেঞ্জের উৎপত্তি নিয়ে এক কিংবদন্তি প্রচার করেন। সেই কিংবদন্তি অনুযায়ী, আয়ারল্যান্ডের এক পাহাড়ের ওপর দৈত্যরা তৈরি করেছিল এই সৌধ।
৩০টি পাথর দিয়ে স্টোনহেঞ্জের বাইরের বৃত্ত তৈরি হয়েছিল প্রায় চার হাজার বছর আগে। এসব পাথরকে বলা হয় সারসেনস। এগুলো আবার ঘোড়ার খুরের মতো দেখতে পাঁচটি বড় পাথর দিয়ে বেষ্টিত। এখানেই শেষ নয়; ব্লুস্টোন নামের ছোট ছোট পাথর দিয়ে তৈরি আরও দুটি বৃত্ত আছে। একটি আছে বাইরের বড় বৃত্তের ভেতরে। আরেকটি ঘোড়ার খুরের মতো আকৃতির পাথর দিয়ে তৈরি বৃত্তের ভেতরে। পাশাপাশি চারটি স্টেশন স্টোন আছে মূল কেন্দ্রীয় সৌধের বাইরে। পুরো এলাকা একটি বড় বৃত্তাকার খাদের মধ্যে, যার চারপাশে পাড় ছিল, আজও আছে।
এখন হয়তো মনে প্রশ্ন জাগছে, বিশাল এই সৌধ বা কাঠামো কীভাবে তৈরি করেছিলেন প্রাচীন মানুষেরা। এ প্রশ্নের উত্তর প্রত্নতাত্ত্বিকেরা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখনো কোনো তথ্য জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। হাজার বছর আগে কীভাবে মানুষ বিশাল বিশাল পাথর বহন করে এনেছেন? কীভাবেই–বা সাজিয়েছেন, তা নিয়ে আছে রহস্য।
বারো শতকের গোড়ার দিকে ধর্মযাজক জিওফ্রে অব মনমাউথ স্টোনহেঞ্জের উৎপত্তি নিয়ে এক কিংবদন্তি প্রচার করেন। সেই কিংবদন্তি অনুযায়ী, আয়ারল্যান্ডের এক পাহাড়ের ওপর দৈত্যরা তৈরি করেছিল এই সৌধ। পরে মার্লিন নামের এক জাদুকর জাদুবিদ্যার মাধ্যমে পাথরের এই চক্রাকার সৌধ লন্ডনে নিয়ে আসেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দৈত্যদের কোনো জাদুকর ছিল না, তাই বেচারারা তাদের সৌধটি ফিরিয়ে নিতে পারেনি। থেকে গেছে ইংল্যান্ডেই। এর পাশাপাশি ভিনগ্রহবাসীরা এসে তৈরি করেছিল স্টোনহেঞ্জ—এমন গল্পও ছড়িয়েছে অনেক সময়।
তবে এসব নিছকই গল্প বলে মনে করেন বর্তমান বিশেষজ্ঞরা। বাস্তবে নিশ্চয়ই এমনটা ঘটেনি। কোনো জাদুকরের সাহায্যও পাননি প্রাচীন মানুষেরা। প্রচণ্ড পরিশ্রম আর জটিল প্রকৌশলবিদ্যা খাটিয়ে তাঁরা নির্মাণ করেছেন এই স্টোনহেঞ্জ। সেখানে জাদুকরকে পুরো কৃতিত্ব দিলে ওই অঞ্চলের মানুষকে ঠিক প্রাপ্য সম্মানটা দেওয়া হয় না।
স্টোনহেঞ্জের সবচেয়ে হালকা ব্লুস্টোনগুলোর ওজনই প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কেজি। বর্তমান সময়ে দুটি ছোট গাড়ির সমান ধরতে পারো। অন্যদিকে বড় সারসেন স্টোনের ওজন ২২ টনের মতো। গড়ে চারটি আফ্রিকান হাতির সমান।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিশ্বাস, সারসেন স্টোনগুলো জায়গামতো আনা হয়েছিল কাঠের স্লেজে করে, প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূর থেকে। কিন্তু ব্ল স্টোনগুলোর উৎপত্তির জায়গা আরও দূরে। প্রায় ২২৫ কিলোমিটার দূরের ওয়েলস অঞ্চল থেকে আনা হয়েছিল। তাঁরা মনে করেন, স্লেজে করে স্থলপথ এবং কাঠের ভেলায় করে জলপথ পার করে এসব পাথর সৌধ অঞ্চলে আনা হয়েছিল।
চাঁদ ও সূর্যের আলোর ছায়া দেখে ঋতুপরিক্রমা বোঝার জন্য হয়তো তৈরি হয়েছিল বলে মনে করেন তাঁরা। সমাধিসৌধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো স্টোনহেঞ্জ, এমন বিশ্বাসের মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
হাজারো ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, হাতুড়ি–বাটালি চালিয়ে পাথরগুলোর আজকের রূপে নিয়ে আসা হয়। এবার প্রশ্ন, দানবীয় এসব পাথর খাড়া করা হলো কীভাবে? তারও ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রত্নতত্ত্বিকেরা। প্রথমে পাথরের গোড়ার দিকে গর্ত খোঁড়া হতো। তারপর দড়ি, শক্তিশালী কাঠের খাম্বা ও কাঠামোর সাহায্যে সেগুলোকে টেনে গর্তের মধ্যে খাড়া করে ফেলত। এরপর মাটি–পাথর দিয়ে গর্ত পূরণ করে দিলেই কাজ শেষ!
এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বলা দরকার। কী উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল এই সৌধ? স্টোনহেঞ্জ কী কাজে লাগত তখনকার মানুষের?
স্টোনহেঞ্জের সবচেয়ে বড় রহস্যের জায়গাটা এখানে। নির্মাণপ্রক্রিয়ার মতোই ধোঁয়াশায় ঢেকে আছে স্টোনহেঞ্জ তৈরির উদ্দেশ্য। এটা কী কাজে ব্যবহৃত হতো বা কেন এটা তৈরি করা হয়েছে, তা নিয়ে রহস্যের জাল এত বছরেও ছিন্ন হয়নি। অনেকেই মনে করেন, এটি ধর্মীয় উপাসনার কাজে ব্যবহৃত হতো। সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষ ও যাজকেরা এখানে আসতেন প্রার্থনা করতে। অনেকের মতে, এটি ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় ক্যালেন্ডার। চাঁদ ও সূর্যের আলোর ছায়া দেখে ঋতুপরিক্রমা বোঝার জন্য হয়তো তৈরি হয়েছিল বলে মনে করেন তাঁরা। সমাধিসৌধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো স্টোনহেঞ্জ, এমন বিশ্বাসের মানুষের সংখ্যাও কম নয়। স্টোনহেঞ্জ খনন করে পাওয়া মানবদেহের হাড়গোড় তাঁদের এই ধারণাকে অনেকটাই সমর্থন করে। সমাজের উঁচু মহলের মানুষদের এখানে সমাহিত করা হতো, এটাই তাঁদের দাবি। আরেক দল আবার এত কিছুর তোয়াক্কা না করে বলে, স্টোনহেঞ্জ ছিল সেবাকেন্দ্র! দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে এখানে সেবা নিত। কেউ মারা গেলে তাঁদের সমাধিস্থ করা হতো বিশাল অঞ্চলের মধ্যেই।
এসবের কোনটা সত্যি, তা এত বছর পর এখন আর নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। তা না থাকুক, ইউনেসকো স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের এই সাইট দেখতে প্রতিবছর কয়েক লাখ মানুষ হাজির হন। প্রাচীন মানুষের কীর্তি দেখে অবাক ও বিমোহিত হন। হয়তো দর্শনার্থীরা কল্পনার টাইমমেশিনে চড়ে ফিরে যান হাজার বছর পেছনে।
সূত্র: ব্রিটেনিকা, হিস্টোরি ডটকম, ন্যাটজিও কিডস