জেন-জিরা কেন ফিচার ফোনে আগ্রহী হচ্ছে
বর্তমানে জেন-জি বা জেনারেশন জেডের কাজকর্ম নিয়ে অনেক আলাপ হচ্ছে। যাদের বয়স ১১ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে তারাই জেন-জির অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী সবাই জেন-জির মধ্যে পড়ে। এই বয়সী ছেলেমেয়েদের অনেকেই বর্তমানে ফিচার ফোনে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। স্মার্ট যুগে এসে তারা কেন ফিচার ফোনে আগ্রহী হচ্ছে?
সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে ফিচার ফোনের ব্যাপারটা একটু স্পষ্ট করতে হবে। সাধারণত যে ফোনে ইন্টারনেট অ্যাকসেস নেই কিংবা মিডিয়ার অনেক টুল ব্যবহার করা যায় না, সেই ফোন ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে এই প্রজন্ম। ইংরেজিতে একে বলে ডাম্বফোন। বাংলা ভাষায় একে ফিচার ফোন বা বাটন কিংবা বেসিক ফোন বলে। কিন্তু এখন কিছু বাটন ফোনেও ইন্টারনেট অ্যাকসেস থাকে। সেগুলোর কথা বোঝাচ্ছি না। শুধু যেসব মোবাইলে কল করা, মেসেজিং, ক্যালকুলেটর কিংবা ক্যালেন্ডারের মতো মৌলিক ফিচার ব্যবহার করা যায়, সে ফোনকেই বলছি ফিচার ফোন।
এখন দেখা যাক, কেন এমন পুরোনো আমলের একটা ফোন পছন্দ করছে আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরা। সবচেয়ে বড় কারণ, স্মার্টফোনে প্রতিদিন আমাদের অনেকটা সময় ব্যয় হয়; যদিও আমরা তা বুঝতে পারি না। মনে হয় মাত্র ৩০ মিনিট ব্যবহার করলাম। কিন্তু কখন যে তা দু–তিন ঘণ্টা হয়ে যায়, আমরা টের পাই না। এটা শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ক্রল করার বিষয় নয়, আমাদের মস্তিষ্কেও এর প্রভাব পড়ে।
বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্টফোন ব্যবহারের কারণে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ, হতাশা ও একাকিত্ব বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার জন্য মস্তিষ্কের এক অংশ বেশ সক্রিয় থাকে। মানে মস্তিষ্কের একটা নির্দিষ্ট অংশ বারবার উদ্দীপ্ত হয়। এতে স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
জেন-জির মধ্যে এই পরিবর্তন কিন্তু শুধু একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশে হয়নি; বিশ্বব্যাপী জেন-জিরা এখন বাটন ফোন ব্যবহার করে সময় বাঁচাতে চাইছে।
তরুণেরা অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সেলিব্রেটিদের মতো জীবন যাপন করতে চায়।তাঁদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে সে রকম হতে চায়। স্বাভাবতই এমনটা সবাই করতে পারে না। তখন তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। যারা মানসিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য এটা ক্ষতিকর হতে পারে। এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় যারা জন্মের পর স্মার্টফোন হাতে নিয়ে বড় হয়েছে, তাদের মধ্যে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ভিপিএন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এক্সপ্রেসভিপিএনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বের ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী স্ক্রিনটাইম কমাতে বাটন ফোন ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। অনেকে স্মার্টফোনে নির্দিষ্ট কিছু অ্যাপ ব্যবহার করে স্ক্রিনটাইম কমায়। এক দিনে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে না। যতটা সময় সেট করে রাখা হবে, সেই সময়ের পরে আর কিছু নির্দিষ্ট অ্যাপ ব্যবহার করা যাবে না।
এ বিষয়ে কানাডার ১৬ বছর বয়েসী লুক মার্টিনের কথা বলা যায়। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্টিন বলেছে, সময় বাঁচাতে স্মার্টফোন বাদ দিয়ে একটা বাটন ফোন কিনেছে সে। সেই ফোনে শুধু মেসেজ, কল আর ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা যায় (এ ছাড়া সাধারণ বাটন ফোনে যা থাকে, সেগুলোও নিশ্চয়ই ছিল)। ওই সময় তার সহপাঠী ও বন্ধুরা দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ও গেমিং করত। কিন্তু ফোন পরিবর্তন করায় প্রতিদিন তাঁর এসব কাজে মাত্র ২০ মিনিট ব্যয় হয়।
জেন-জির মধ্যে এই পরিবর্তন কিন্তু শুধু একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশে হয়নি; বিশ্বব্যাপী জেন-জিরা এখন বাটন ফোন ব্যবহার করে সময় বাঁচাতে চাইছে। বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট জেডএমই সায়েন্সের মতে, ‘এটি এখন সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে।’ উত্তর আমেরিকায় ইতিমধ্যে ফিচার ফোনের বিক্রি অনেক বেড়েছে। তরুণ প্রজন্মের এই সিদ্ধান্তে বাবা–মায়েরাও খুশি। অনেক অভিভাবক তাঁদের সন্তানের মোবাইলের আসক্তি কমাতে হিমশিম খান। ফলে তাঁদের জন্য এই সামাজিক আন্দোলন নিশ্চয়ই স্বস্তি বয়ে আনবে।
নকিয়া ফোনের নির্মাতা এইচএমডি গ্লোবালের মতো সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিচার ফোন বিক্রি বেড়েছে। প্রতি মাসে ১০ হাজারের বেশি ফিচার ফোন বিক্রি হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ভারতে আগের চেয়ে ৮০ শতাংশ ফিচার ফোনের বিক্রি বেড়েছে।
অনেক কোম্পানি এখন নতুন করে ফিচার ফোন বাজারে আনছে। টেকলেসের প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস কাসপার বলেছেন, তাঁরা তরুণদের এই আগ্রহ মাথায় রেখে ‘ওয়াইজফোন ২’ নামে একটি ফোন বাজারে এনেছে। এ ফোনে শুধু রিংটনের পাশাপাশি দুই ধরনের রং ও দুটি ফন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। কারও যাতে বেশি সময় ফোন ব্যবহার করতে ইচ্ছা না করে, সে জন্য এ ব্যবস্থা। আরও একধাপ এগিয়ে আছে কিছু লাইট ফোন। সেগুলোয় মাত্র ৭টি জিনিস আছে। ঘড়ি, ক্যালকুলেটর, ম্যাপ, ক্যামেরা, সেটিংস, ফোন ও মেসেজ। কিন্তু দেখতে মোটেও বাটন ফোনের মতো নয়। স্বাভাবিক স্মার্ট ফোনের মতোই দেখতে সেগুলো।
ফলে বিশ্বব্যাপী তরুণদের মধ্যে যে নতুন সামাজিক আন্দোলন দেখা যাচ্ছে, সেটাকে বাহবা দিতেই হয়। কারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাজীবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়টা স্মার্টফোনে রিলস কিংবা ভিডিও দেখে না কাটালে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব।
সূত্র: জেডএমই সায়েন্স ডটকম