চাঁদের মাটিতে ব্লু ঘোস্টের ল্যান্ডিং কেন অসাধারণ

ব্লু ঘোস্ট লুনার ল্যান্ডার

চাঁদে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ সংস্থা ফায়ারফ্লাই অ্যারোস্পেসের ‘ব্লু ঘোস্ট মিশন ১’–এর মহাকাশযান সফলভাবে অবতরণ করেছে। বেসরকারি মহাকাশ সংস্থা জানিয়েছে, এ ঘটনা শুধু মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রেই নয় বরং বাণিজ্যিক উদ্যোগের মহাকাশ মিশনের ক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। ২ মার্চ মার্কিন সময় বেলা ৩টা ৩৪ মিনিটে মহাকাশযানটি চাঁদের মাটিতে সফলভাবে অবতরণ করে। এটি দ্বিতীয় ব্যক্তিগত মহাকাশ মিশন, যা চাঁদে পৌঁছাল এবং প্রথম মিশন যা সফলভাবে অবতরণ করেছে চাঁদের মাটিতে।

ফায়ারফ্লাই অ্যারোস্পেস তাদের ব্লু ঘোস্ট ল্যান্ডার চাঁদে অবতরণের কয়েক ঘণ্টা পর চাঁদের কিছু অবিশ্বাস্য ছবি প্রকাশ করেছে। ব্লু ঘোস্ট চাঁদের মের ক্রিসিয়াম (Mare Crisium) নামক স্থানে অবতরণ করেছে। অবতরণের আগে এটিকে দুটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি পার করতে হয়। পরে সব বাধা পেরিয়ে চাঁদের মনস ল্যাট্রিল আগ্নেয়গিরির কাছে অবতরণের লক্ষ্যস্থলের ১০০ মিটারের মধ্যে নিখুঁতভাবে অবতরণ করেছে ব্লু ঘোস্ট। এই মিশন ফায়ারফ্লাই অ্যারোস্পেসের সঙ্গে কাজ করেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এবং ইলন মাস্কের স্পেসএক্স।

আরও পড়ুন
ব্লু ঘোস্ট ল্যান্ডার দ্বিতীয় যে ছবি তুলেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে ল্যান্ডারটি চাঁদের পৃষ্ঠে বসে আছে এবং এর পেছনে দূরে নীল বিন্দুর মতো পৃথিবী দেখা যাচ্ছে। এমনকি ল্যান্ডারের প্যানেলে পৃথিবীর প্রতিফলিত ছবিও ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে।

নাসা সায়েন্স মিশন অধিদপ্তরের ডেপুটি অ্যাসোসিয়েট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জোয়েল কার্নস এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চাঁদের পৃষ্ঠে কোনো কিছু নামানো বা অবতরণ করানো একটি অবিশ্বাস্য রকম কঠিন প্রযুক্তিগত কাজ। কারণ, চাঁদে কোনো বাতাস নেই। সে জন্য প্যারাসুট ব্যবহার করা যায় না। শুধু মহাকাশযানের ইঞ্জিনের সাহায্যে যানগুলোকে নিরাপদে অবতরণ করাতে হয় চাঁদের মাটিতে।

ব্লু ঘোস্ট ল্যান্ডিং সেলিব্রেশন

অবতরণের কিছুক্ষণের মধ্যে ফায়ারফ্লাই অ্যারোস্পেস চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে তোলা প্রথম ছবিটি প্রকাশ করে। ছবিটি ব্লু ঘোস্ট চন্দ্রযানটি তুলেছে। ব্লু ঘোস্টের এস-ব্যান্ড ইমেজিং সিস্টেমের মাধ্যমে এই ছবি তোলা হয়েছে। চন্দ্রযানটি যখন এর প্রধান অ্যানটেনা স্থাপন করে, তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আরও উন্নতমানের এক্স-ব্যান্ড ছবিগুলো প্রকাশ করে ফায়ারফ্লাই অ্যারোস্পেস।

ফায়ারফ্লাইয়ের স্পেসক্রাফট প্রোগ্রামের পরিচালক রে অ্যালেনসওয়ার্থ জানিয়েছেন, ব্লু ঘোস্ট ল্যান্ডারের অবতরণের লাইভ ভিডিও না দেখানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ, টেলিমেট্রি এবং অবতরণের সময় চালু থাকা বিভিন্ন যন্ত্রের জন্য যোগাযোগের ব্যান্ডউইডথের ব্যবহার। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র ছিল বিপদ এড়ানোর জন্য ক্রিটিকাল হ্যাজার্ড এভিডেন্স সিস্টেম, যা ল্যান্ডারটিকে পৃষ্ঠের অন্তত দুটি বিপজ্জনক পাথর থেকে বাঁচতে সাহায্য করে। মানে ফায়ারফ্লাই ল্যান্ডারের অবতরণের সময় লাইভ ভিডিও না দেখিয়ে যোগাযোগের ব্যান্ডউইডথ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এর ফলে ল্যান্ডারটি নিরাপদে অবতরণ করতে পেরেছে চাঁদের মাটিতে।

আরও পড়ুন
ব্লু ঘোস্ট চাঁদের মাটি থেকে পূর্ণ সূর্যগ্রহণের ছবি তুলবে। চাঁদের দিক থেকে পৃথিবী সূর্যকে ঢেকে দেবে। একই সময়ে পৃথিবীতে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে। আর চাঁদকে গাঢ় লাল রঙের দেখাবে।
চাঁদের মাটিতে ব্লু ঘোস্ট

রে অ্যালেনসওয়ার্থ বলেন, ‘নাসা আশা করেছিল যে অবতরণের স্থানটি তুলনামূলক নিরাপদ হবে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সেখানে কোনো বিপদ ছিল না। তাই, আমরা সব সময় বিপদের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। সে জন্য আমরা বিপদগুলো মোকাবিলা করে নিরাপদে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছি।’

ব্লু ঘোস্ট ল্যান্ডার দ্বিতীয় যে ছবি তুলেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে ল্যান্ডারটি চাঁদের পৃষ্ঠে বসে আছে এবং এর পেছনে দূরে নীল বিন্দুর মতো পৃথিবী দেখা যাচ্ছে। এমনকি ল্যান্ডারের প্যানেলে পৃথিবীর প্রতিফলিত ছবিও ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে, ফায়ারফ্লাই চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে তোলা এই অসাধারণ ছবি প্রকাশ করে। ফায়ারফ্লাই প্যানেলের এক সদস্য বলেন, ‘আমরা সবাই এই ছবিতে আছি।’ ব্লু ঘোস্ট ল্যান্ডারটি চাঁদে অবতরণ করার পর ১৪ দিন ধরে চাঁদের পৃষ্ঠে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে। ফায়ারফ্লাই অ্যারোস্পেসের সিইও জ্যাসন কিম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আগামী ১৪ দিন আমাদের জন্য খুবই কঠিন হতে চলেছে। আমরা ল্যান্ডারে থাকা ১০টি পেলোডে তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করব। তবে আমি নিশ্চিত যে আমাদের দল এই চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবে।’

আরও পড়ুন

ব্লু ঘোস্ট মিশন ১-এর একটি প্রধান আকর্ষণ দেখা যাবে ১৪ মার্চ। সেদিন ব্লু ঘোস্ট চাঁদের মাটি থেকে পূর্ণ সূর্যগ্রহণের ছবি তুলবে। চাঁদের দিক থেকে পৃথিবী সূর্যকে ঢেকে দেবে। একই সময়ে পৃথিবীতে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে। আর চাঁদকে গাঢ় লাল রঙের দেখাবে। ১৬ মার্চ ল্যান্ডারটি চাঁদের সূর্যাস্তের ছবি তুলবে এবং সৌর কার্যকলাপের কারণে চাঁদের ধুলা কেমন আচরণ করে, তা পর্যবেক্ষণ করবে। অ্যাপোলো–১৭ মিশনের সময় প্রথম এ ঘটনা দেখা গিয়েছিল।

চাঁদে অবতরণের আগে ব্লু ঘোস্ট ৪৫ দিনে ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন মাইল পথ অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে ২৭ জিবি ডেটা পৃথিবীতে পাঠিয়েছে, যা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম থেকে রেকর্ড-ব্রেকিং সিগন্যাল ট্র্যাকিং এবং ভ্যান অ্যালেন বেল্টের বিকিরণ পরিমাপ করতে পেরেছেন।

সূত্র: স্পেস ডটকম, দ্য গার্ডিয়ান

আরও পড়ুন