যে কারণে বৃক্ষমেলায় যেতেই হবে
তোমার প্রিয় ফল কি আম? আম্রপালি, হিমসাগর নাকি ল্যাংড়া? ধরো, তুমি প্রতিবেশী দেশ ভারতে গেলে আলফানসো আম খেতে; কিংবা বোম্বাই লিচু পেতে। সেখান থেকে পাকিস্তান কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় আনার, থাইল্যান্ডে থাই আম, থাই কাঁঠাল, ভিয়েতনামের নারকেল, জাপানের লাল মিয়াজাকি আম কিংবা পিচফল, ফিলিপাইনের কালো আখ, ব্রুনাইয়ের ব্রুনাই কিং আম, মালয়েশিয়ার রাম্বুটান, সৌদি আরবের খেজুর, মিসরের ডুমুর, ইন্দোনেশিয়ার ইন্দো পালমার আম কিংবা আমেরিকার রেড পালমার আম খেতে যাওয়া সম্ভব? এক দিনে এতটা দেশে যাওয়া হয়তো সম্ভব নয়, তবে এতগুলো দেশের ফুল-ফলের দেখা যদি পেয়ে যাও এক জায়গাতেই? তা–ও আবার ঢাকায়। বলছি, বৃক্ষমেলার কথা। বৃক্ষমেলার সুবিধাই তো এই—এক জায়গায় দেশি-বিদেশি নানান গাছের সমাহার। বৃক্ষমেলা নামের এই অরণ্যে বিচিত্র সব গাছের চারা দেখা যায়, চেনা যায়, কেনা যায়।
মেলা বসেছে রাজধানী ঢাকার আগারগাঁও পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠে। বাণিজ্য মেলা তার ঠিকানা পাল্টালেও বৃক্ষমেলা বসেছে তার আগের ঠিকানাতেই। সময় করে তুমিও যেতে পারো কোনো একদিন।
যেমনটা আছে এবারের মেলায়: শুরুতেই ফল প্রসঙ্গ
মেলায় সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ছে ডালভর্তি ফল নিয়ে একেকটি ফলের গাছ। প্রায় প্রতিটি স্টলেই ডালভর্তি রঙিন আমগাছগুলোই চোখে পড়ে আগে। ভিনদেশি আমের তালিকায় আছে তিন থেকে পাঁচ কেজি ওজনের রাজকীয় ব্রুনাই কিং, চিয়াংমাই, চাকাপাত, আমেরিকান রেড পালমার, কিউজাই, থ্রি টেস্ট, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, ফোর কেজি, থাই ফজলি, নাম ডকমাই, বোম্বাই গ্রিন, পুনাই, মাহাচানক, মিয়াজাকি, কেন্ট ম্যাঙ্গো, ব্ল্যাক স্টোন, কাটিমন, তোতাপুরী, আলফানসোসহ অনেক জাত। তবে আম দেখে মুগ্ধ হলেও দাম শুনে ভড়কে যেতে পারো তোমরা। জাতভেদে ফলসহ গাছের দাম ১০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাঁকছেন বিক্রেতা। তাহলে কম দামে একই জাতের গাছ সংগ্রহের উপায় কী? উপায় হলো ফলসহ গাছ না কিনে বরং একই জাতের ছোট কলম চারা কেনা। তাতে দাম নেমে আসবে ৪০০ থেকে হাজার টাকায়। সবচেয়ে ভালো হয় মেলায় প্রবেশ করে অন্যান্য স্টলে যাওয়ার আগেই হাতের ডান দিক ধরে এগিয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) স্টলে ঘুরে আসা। এখানে সরকারি রেটে পাওয়া যাবে পছন্দসই যেকোনো ফলের চারা। যেখানে অন্যান্য স্টলে গুনতে হবে কয়েক গুণ বেশি টাকা, সেখানে বিএডিসি স্টলে যেকোনো জাতের আমের কলমচারা নেওয়া যাবে ১০০ থেকে ২০০ টাকায়।
বিদেশি অন্যান্য ফলের মধ্যে রয়েছে রসালো র্যাসবেরি (কালো ও লাল), কালো ব্ল্যাকবেরি, কিউই, ব্রেড ফ্রুট বা রুটি ফল, কালো আঙুর, সবুজ আঙুর, আমাদের দেশে চাষোপযোগী গ্রীষ্মকালীন আপেল ও হরিমন ৯৯ জাতের আপেল, ব্রাজিলিয়ান ব্ল্যাক সুগারক্যান, সৌদি খেজুর, ভিয়েতনামি নারকেল, কেরালা নারকেল, পার্সিমন, অ্যাপ্রিকট, ম্যাঙ্গোস্টিন, মিরাকল ফল, ড্রাগন ফল, মিসরীয় ডুমুর, চায়না কমলা, নাগপুর কমলা, মাল্টা, থাই লম্বাটে সফেদা, থাই লাল শরিফা, থাই ডুমুর, থাই ড্রাগন, থাই করমচা, থাই–৭ পেয়ারা, রাম্বুটান, অ্যাভোকাডো, লোকাট, অ্যাবিউ ফ্রুট, এগ ফ্রুটসহ অনেক জাত। মেলায় ওঠা সবচেয়ে বেশি দাম হাঁকানো গাছটি হচ্ছে থোকা থোকা ফলসহ প্রায় ১৫ ফুট উচ্চতার খেজুরগাছ। যার দাম চাওয়া হয় ১০ লাখ টাকা। বারোমাসি ভিয়েতনামি কাঁঠাল, থাই লাল কাঁঠাল, এমনকি আঠাহীন থাই কাঁঠালের চারাও মিলছে এখন মেলায়, ‘গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল’ দেওয়ার দিন বুঝি ফুরিয়ে এলো এবার!
কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখা ‘কাজলা দিদি’ কবিতাটা পড়েছ নিশ্চয়ই ‘বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,/ মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?’ তেমনি যদি বাঁশবাগানের মাথার ওপর যদি চাঁদের দেখা পেতে চাও, নিতে পারো টবে বসানো বাঁশঝাড়ও। পাওয়া যাবে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে।
প্রচলিত আমের মধ্যে আছে আম্রপালি, ল্যাংড়া, হিমসাগর, হাঁড়িভাঙা, গোপালভোগ, ফজলি, মল্লিকা, বারি–৪, বারি–১১ ইত্যাদি। আছে জাম, লিচু, কাঠলিচু, ডেউয়া, লটকন, বিলাতি গাব, আমলকী, আমড়া, বেল, কতবেল, সফেদা, স্ট্রবেরি, পেয়ারা, কুল, ডালিম, আনার, জামরুল, বাতাবিলেবু, চালতা, করমচাসহ রয়েছে শতাধিক জাতের চারা। বারোমাসি ফলের মধ্যে আম, আতা, আনার, আখ, শজনে, সাদা জাম, পেঁপে ও কলা থেকে শুরু করে কলমের থাই ও ভিয়েতনামি বারোমাসি কাঁঠালের চারাও মিলছে। ফলে গাছ লাগিয়ে ফলের মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না, সারা বছর গাছ থেকে ফল পাওয়া যাবে। আছে কাগজি লেবু, কলম্বো লেবু, হাজারি লেবু, জারা লেবু, কাঁটাহীন সিলেটি মোম লেবু, বীজহীন লেবু ও হাতের আঙুলের মতো দেখতে ফিঙ্গার লেবু।
তুলনামূলক কম দামে ভালো মানের চারা পেতে যেতে পারো বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) স্টলে। সেখানে ৩০ টাকায় পাবে প্রতিটি পান, সুপারি, কারিপাতা, মেহেদির চারা। ৫০ টাকায় প্রতিটি পোলাউ পাতা কাঁঠালিচাঁপা, অরবরই বীজহীন লেবু, চায়না–৩ লেবুর চারা। ১০০ টাকায় পাবে প্রতিটি হিমসাগর, হাঁড়িভাঙা, ল্যাংড়া, কাটিমন, কিউজাই, জাম, লিচু, আঙুর, কামরাঙা, কতবেল, লটকন, জামরুল, কফি, চুইঝাল কাজুবাদাম, চালতা ও পানবিলাসের চারা। ১০০-১৫০ টাকায় ড্রাগন ফল। ২০০ টাকায় প্রতিটি আতা, শরিফা, মিসরীয় ডুমুর, তেজপাতা,আনার, ডালিম, থাই আমলকী, বাতাবিলেবু বা জাম্বুরা, আমড়া, মাধুরী পেয়ারা, সফেদা ও নেপালি কমলা। আমের মধে৵ ইন্দো পালমার, চিয়াংমাই, আলফানসো, অস্টিন, মিয়াজাকি, থ্রি টেস্ট, কাঁচামিঠা, হানিডিউ, ব্রুনাই কিং, কিং অব চাকাপাতের চারা। ৩০০ টাকায় প্রতিটি বারোমাসি ভিয়েতনামি কাঁঠাল, গ্রীষ্মকালীন সবুজ আপেল, হরিমন ৯৯ জাতের আপেল ও টক আতা। ৫০০ টাকায় রনেলিয়া, ব্রাজিলের ফল জাবুটিকা এবং ১ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ান রাম্বুটানের কলম চারা।
ফুলের সমারোহ
প্রায় প্রতিটি স্টলে ফলের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে ফুলের গাছ। নানা রঙের রঙিন গোলাপ, মরুর গোলাপ নামে পরিচিত অ্যাডেনিয়াম, নানারকম বাহারি হাইব্রিড জবা, নয়নতারা, চন্দ্রপ্রভা, অপরাজিতা, কুঞ্জলতা, হংসলতা, বাসরলতা, হলুদ, সাদা ও খয়েরি রঙের অলকানন্দা, ব্লিডিং হার্ট, জারবেরা, রঙ্গন, হাসনাহেনা, মুসেন্ডা, হরেক রঙের ল্যান্টেনা, বাগানবিলাস, দাঁতরাঙা, কাঁটামুকুট, অ্যারোমেটিক জুঁই, লাল-গোলাপি ও সাদা রঙের ফুরুস ফুল, মর্নিং গ্লোরি, পিস লিলি, রেইন লিলি, এমারিলিস লিলি, লিলিয়াম, নন্দিনী, কাঁঠালচাপাসহ অনেক প্রজাতি। গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে এক গাছেরই বিভিন্ন ডালে বিভিন্ন রঙের ফুল ফোটাচ্ছে আছে এমন ফুল গাছও। জবা আর বাগানবিলাসের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে বেশি। বাগানবিলাসের একটি গাছেই লাল, কমলা, গোলাপি, সাদাসহ ফুটে আছে ছয় রঙের ফুল। গাছটির দাম অবশ্য আকাশছোঁয়া—দেড় লাখ টাকা! কিছু স্টলে চেনা ফুল শাপলা ও পদ্ম থেকে শুরু করে ভিনদেশি অচেনা অনেক জাতের জলজ ফুলের সংগ্রহও রয়েছে।
লতাপাতায় সৌন্দর্য
গাছভর্তি ফুল আর ফলের বাইরে স্রেফ পাতার সৌন্দর্যেই কাছে টেনে নেয় পাতাবাহার আর শোভাবর্ধক গাছ। আর তাই তো ঘরে কিংবা বাইরে শোভা বাড়াতে চাহিদার কমতি নেই এগুলোর। মানিপ্ল্যান্ট বা পথোস থেকে শুরু করে লাকি ব্যাম্বো, স্নেক প্ল্যান্ট, জিজি প্ল্যান্ট, টসটসে রসালো পাতার সাকুলেন্ট, ক্রোটন, ক্যালাডিয়াম, সিঙ্গনিয়াম, ড্রাসিনা, স্পাইডার প্ল্যান্ট, আরিকা পাম, সাইকাস, কয়েন প্ল্যান্ট, চায়না বটসহ অনেক আছে পাতাবাহারের তালিকায়। মাটিতেও নয় আবার পানিতেও নয়, শুধু বাতাসেই হয়, আছে এমন এয়ার প্ল্যান্ট। দাম পড়বে ৭০০ টাকা থেকে হাজার টাকা। লাকি ব্যাম্বোকে পেঁচিয়ে বিভিন্ন নকশায় রূপ দেওয়া গাছের দাম পড়বে ৩ হাজার ২০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখা ‘কাজলা দিদি’ কবিতাটা পড়েছ নিশ্চয়ই ‘বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,/ মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?’ তেমনি যদি বাঁশবাগানের মাথার ওপর যদি চাঁদের দেখা পেতে চাও, নিতে পারো টবে বসানো বাঁশঝাড়ও। পাওয়া যাবে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে। ঝোপালো চায়না বাঁশ, মুলি বাঁশ, ঘটি বাঁশ থেকে শুরু করে মিলবে ডোরাকাটা পাতার ভেরিগেট বাঁশঝাড়ের দেখাও। বাগানে বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করতে নেওয়া যায় নাগাচূড়া, যার পাতাতেই যেন সব সৌন্দর্য। সবুজ ও সাদাটে পাতার দুই রকমের নাগাচূড়ার দাম পড়বে ৩ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। পাতার কিনারায় কাঁটায় ঘেরা দৈত্যাকায় সেঞ্চুরিগাছের দাম উঠেছে ১৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা।
অর্কিডের সমাহার
মেলায় আছে অর্কিডের জমকালো উপস্থিতি। একে তো নজরকাড়া ফুল, তা–ও আবার টেকে অনেক দিন। প্রথম দেখায় যে কেউ একে প্লাস্টিকের ফুল ভেবে ভুল করতে পারো! ঝুলন্ত শিকড়সহ দৃষ্টিনন্দন সব দেশি-বিদেশি অর্কিড হাজির মেলার স্টলে স্টলে। ডেনড্রোবিয়াম, অনসিডিয়াম, সিম্বিডিয়াম অর্কিড, মোকারা, ক্যাটলিয়া, ভেন্ডা, অ্যারান্ডা, রয়েন স্টাইলিশ জিগান্টিসহ অনেক জাতের অর্কিডের সংগ্রহ। মিলবে ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে। দেশি অর্কিড হয়া মিলে ২৫০ টাকার মধ্যেই। ফুলেল অর্কিডের পাশাপাশি ফুলহীন ছোট চারাও বিক্রি হচ্ছে। মিলবে অর্কিডগাছে দেওয়ার জন্য প্যাকেটজাত সার; যা পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হয়।
কাঁটাময় ক্যাকটাস
মাথায় লাল–হলুদ গ্রাফটিংসহ মেলায় পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস। আকারভেদে ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। পলিব্যাগে বসানো ছোট সবুজ ক্যাকটাস মিলবে ১০০ টাকার মধ্যে। একই টবে অনেক প্রজাতির ছোট ছোট ক্যাকটাসের সমন্বয় নিতে পারবে ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকার মধ্যে।
বাহারি বনসাই
বনসাই তো শুধু গাছ নয় যেন একেকটা শিল্পকর্ম। ধৈর্য ধরে বছরের পর বছর ধরে পরিচর্যা আর অধ্যবসায়ের ফল হিসেবে সাধারণ একটি গাছ রূপ নেয় বনসাই নামের শিল্পকর্মে। বনসাইয়ের মধ্যে দেশি বট, চীনা বট, চন্দন বট, ফাইকাস বা লক্ষ্যপাকুড়, জিনসেং, কামিনী, অশ্বত্থ, পাকুড়, কতবেল, দেবদারু, পলাশ, বাবলা, আফ্রিকান বাওবাব, শেওড়া, নিম, অর্জুন, পাইফোড়, তেঁতুল, খেজুরসহ অনেক গাছেরই বনসাই মিলছে মেলায়। প্রকার, নকশা ও বয়স ভেদে এসবের দাম ৫ হাজার থেকে ৮ লাখ টাকা। মেলায় ওঠা সর্বোচ্চ ৮ লাখ টাকা দামের বনসাইটি একটি দৃষ্টিনন্দন ফাইকাস বা লক্ষ্যপাকুড় গাছের বনসাই। পুরো মেলা ঘুরে সেই বনসাই খুঁজে পেতে তোমাদের যাতে বেগ পেতে না হয়, সে জন্য বনসাইয়ের ঠিকানা সহজ করে দিচ্ছি, মেলার মাঝখানে লম্বাটে যে টাওয়ারটা চোখে পড়ে, ঠিক ওখানেই আস্তানা গেড়েছে দৃষ্টিনন্দন সব বনসাই। বয়সে কোনো কোনোটা আবার ৭০ বছর পেরিয়ে গেছে! বাচ্চা বনসাই থেকে শুরু করে বয়সী বনসাই দেখতে চাইলে ভিড় জমাতে পারো সেখানে।
জলজ উদ্ভিদ
জলজ উদ্ভিদের মধে৵ রয়েছে বিশাল আকৃতির গোলাকার পাতা নিয়ে আমাজন লিলি। এ ফুল তো সুন্দরই, পাতাটাও তোমাকে মুগ্ধ করে কাছে টানবে। বৃক্ষমেলায় প্রবেশ করেই হাতের বাঁ দিকের শুরুর স্টলটি পাবে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের স্টল। এখানেই বানানো খুদে এক জলাশয়ে খুঁজে পাবে তাকে। ফুলের চেয়ে পাতার কারণেই বেশি পরিচিত আমাজন লিলি। দৈত্যাকার পাতা আর শুভ্র ফুল—সব মিলিয়ে চমৎকার এক ফুল আমাজন লিলি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলজ ফুল। এর পাতা দেখতে থালার মতো—ঠিক যেন পানিতে ভাসমান প্লেট। পাতার উপরি ভাগটি সবুজ আর নিচের দিকটা মেরুন রঙের; আর পাতাগুলো এতই মজবুত যে একটি শিশু অনায়াসে পাতার ওপর বসে থাকতে পারে। দুর্লভ প্রজাতির এই ফুলের আদি নিবাস ব্রাজিল। আমাজন অঞ্চলের বিভিন্ন নদী, ডোবা ও জঙ্গলে এটি ১২ মাস ফুটে থাকে। আমাদের দেশে বলধা গার্ডেন, মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পার্কে ও প্রতিবছরের এই বৃক্ষমেলায় এর দেখা মিলবে।
আমাজন লিলির পাশেই আছে পদ্ম। আবার জাতীয় ফুল সাদা শাপলা যেমন আছে, আছে দৃষ্টিনন্দন লাল, নীল ও বেগুনি রঙের শাপলাও। বিক্রির জন্য বিভিন্ন স্টলে রাখা পদ্ম আর শাপলা ফুলের দেখাই পাবে বেশি।
মসলাজাতীয় উদ্ভিদ
মসলাজাতীয় উদ্ভিদের মধ্যে পাবে হলুদ, মরিচ থেকে শুরু করে আদা, আম আদা, লেমনগ্রাস, হলুদ, দারুচিনি, ছোট ও বড় এলাচি, তেজপাতা, লবঙ্গ, কারিপাতা, পোলাওপাতা, পুদিনা ইত্যাদি । প্রায় সব রকম মসলার গুণ পাওয়া যাবে একটি গাছের পাতাতেই—মিলবে এমন গাছও। নাম তার ‘অল স্পাইস প্ল্যান্ট’।
ঔষধি বৃক্ষের খোঁজে
বর্তমানে ভাইরাল টপিক ‘রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক’! রাসেল ভাইপারের সঠিক নাম ‘রাসেলস ভাইপার’। বাংলা নাম ‘চন্দ্রবোড়া’। স্যার প্যাট্রিক রাসেল আমাদের এই উপমহাদেশের সাপের শ্রেণিবিন্যাসের কাজ শুরু করেন। তিনিই প্রথম কাগজে–কলমে এ অঞ্চলের অনেক সাপের পরিচিতি এবং বিশ্লেষণ করেছিলেন। ১৮ শতকে সাপের চূড়ান্ত শ্রেণিবিন্যাসের সময় রাসেল সাহেবের সতীর্থ বিজ্ঞানীরা তাঁর নাম জুড়ে দেন এই সাপের সঙ্গে। সেই থেকে চন্দ্রবোড়া হয়ে যায় রাসেলস ভাইপার।
বলছি সেই রাসেলস ভাইপারের আতঙ্ক থেকে বাঁচার উপায়ও আছে এই বৃক্ষমেলায়! খোঁজ নিয়ে কিনে নাও ঔষধি সর্পগন্ধা গাছ। সব সাপ ‘বাপ বাপ’ বলে পালাবে! অন্যান্য ঔষধি গাছের মধ্যে আছে অশ্বগন্ধা, কালো ধুতুরা, হরীতকী, নিম, নিশিন্দা, পানবাহার, থানকুনি, শালপানি, শতমূলী, লজ্জাবতী, তুলসী, রামতুলসী, সোনালু, কাজু বাদাম, দণ্ডকলস, মটকিলা, হাড়জোড়া, অপরাজিতা, লেমনগ্রাস, ঘৃতকুমারী, নীল, শিবজটা, বড় কালকাসুন্দা, সূর্যকন্যা, নাগমণি, চন্দন, অর্জুন ও বাসকসহ প্রায় ৩০ প্রজাতির চারা।
ভেরিগেট বা ডোরাকাটা বিচিত্র ফুল-ফলের দেখা
হ্যাঁ, টিভির পর্দায় বনে কিংবা সরাসরি চিড়িয়াখানায় ডোরাকাটা বাঘমামার দেখা পেয়েছ নিশ্চয়ই অনেকে। এবার চলো, কিছু ডোরাকাটা গাছের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যাক! মেলায় মিলবে তেমনি কিছু ডোরা দাগকাটা বিচিত্র সব ফুল-ফলের দেখা। গাছের পাতা যেমন ডোরাকাটা থাকে, ফলটাও ঠিক তেমনই ডোরাকাটা পোশাক পরে থাকে। এই তালিকায় আছে ভেরিগেট মাল্টা, লেবু, পেয়ারা, কাসাবা বা শিমুল আলু। শিমুল আলু গাছের পাতা অনেকটা শিমুলগাছের পাতার মতো, তাই লোকে একে তুলাগাছের চারা ভেবে ভুল করে। বাগানে শোভাবর্ধনকারী পাতাবাহার গাছের মধে৵ আছে ভেরিগেট বাঁশ, চায়না বাঁশ, লাকি ব্যাম্বো। আর ফুলের মধে৵ আছে ডোরাকাটা ভেরিগেট জবা, গন্ধরাজ, কাঠগোলাপের নজরকাড়া রূপে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। ফুল তো এমনিতেই সুন্দর, এখন পাতাটাও হাজির হয়েছে ভিন্ন রকম সৌন্দর্য নিয়ে।
কেনা নয়, শুধুই প্রদর্শনীই যে স্টলের উদ্দেশ্য
প্রতিবারের মতো এবারও মেলায় প্রবেশ করতেই হাতের বাঁয়ে প্রথমে পড়বে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের স্টল। বিক্রি নয়, প্রদর্শনীই এই স্টলের প্রধান উদ্দেশ্য। এখানে রয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দুর্লভ সব ফুল, ফল, ঔষধি গাছ, ক্যাকটাস, অর্কিড আর বনসাইয়ের সমাহার। সবার আগে নজর কাড়ে জলে ভাসা পদ্ম, লাল-সাদা-নীল-বেগুনি শাপলা আর আমাজন লিলি। লিলি যত না সুন্দর, তার চেয়ে পাতার সৌন্দর্যই যেন বেশি নজর কাড়ে।
আছে ডুগডুগি ফল, পানাম ফল, কুসুম ফল, কাঞ্জল ফল, কাউফল, ননিফল, পাইনফল, ডিজেল ফল, রবার, করবী, কুচিলা, ম্যাগনোলিয়া, বাওবাব, জারুল, সাইকাস, দেশি গাব, কেয়া, চালমুগরা ও নাগেশ্বর। আরও আছে চালতা, কফি, তমাল, পাইনাল, কাঁঠালচাঁপা, বহেড়া, উদয় পদ্ম, কানাই ডাঙা, তালি পাম, গোস্টাভিয়া, ডুমুর, দেবদারু, কলকি, ঘোড়ানিম, অশোক, ডেফল, নাগলিঙ্গম, পান্থপাদপ (ট্রাভেলার্স পাম), স্বর্ণ বট ইত্যাদি। আরও আছে ভুঁইকদম, ছাতিম, আগর, শ্বেতচন্দন, বার্মা শিমুল, ঢোলসমুদ্র, রামধাম চাঁপা, উলটকম্বল, বার্ড নেস্ট, জারুল, পানবিলাস, নীল চিতা, হলুদ চিতা, লাল চিতা ফুলসহ বিচিত্র ও দুর্লভ সব গাছের সমারোহ।
মসলাজাতীয় উদ্ভিদের মধ্যে পাবেন আদা, আম আদা, লেমন গ্রাস, হলুদ, দারুচিনি, ছোট ও বড় এলাচি, তেজপাতা, লবঙ্গ, কারি পাতা, পোলাও পাতা, পুদিনা ইত্যাদি। প্রায় সব মসলার গুণের উপস্থিতি আছে, পাবেন এমন ‘অল স্পাইসি’ গাছের দেখাও এখানে। ঔষধি বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে অশ্বগন্ধা, সর্পগন্ধা, কালো ধুতুরা, হরীতকী, নিম, নিশিন্দা, পানবাহার, থানকুনি, শালপানি, শতমূলী, লজ্জাবতী, তুলসী, রামতুলসী, সোনালু, কাজুবাদাম, দণ্ডকলস, মটকিলা, হাড়জোড়া বা হাড়ভাঙা, অপরাজিতা, ঘৃতকুমারী (অ্যালোভেরা), নীল, শিবজটা, বড় কলকাসুন্দা বা কালকাসুন্দি, সূর্যকন্যা, নাগমণি, চন্দন, অর্জুন, বাসকসহ বিভিন্ন প্রজাতির চারা।
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে আছে বাঁশ, রবার গাছ ও সিমেন্টের আস্তর দেওয়া অনুষঙ্গের প্রদর্শনীও। জানতে পারবেন কঞ্চিকলম–পদ্ধতিতে বাঁশের চাষ, কাটিং–পদ্ধতিতে হাইব্রিড একাশিয়ার বংশবিস্তার ও তালের চারার উত্তোলন ও রোপণপদ্ধতি। কঞ্চিকলম পদ্ধতিতে রোপণকৃত কঞ্চি বাঁশঝাড়ে পরিণত হতে সময় নেয় চার বছর। আর সেখান থেকে বাঁশ আহরণ করা যায় ছয় বছরের মাথা থেকেই।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের স্টলে আরও আছে কাচের বয়ামে কৃত্রিমভাবে সংরক্ষিত বিলুপ্ত উদ্ভিদের অবাক করা সব ফলের সংগ্রহ। আছে গাছ ও প্রকৃতি বিষয়ক মূল্যবান কিছু বই কিনে নেওয়ার সুযোগও।
চারা রোপণ ও পরিচর্যার অনুষঙ্গ
মেলা ঘুরে পছন্দসই চারা কেনার পরে মাথায় আসে সেই চারা রোপণ ও তার পরবর্তী পরিচর্যা নিয়ে। মেলায় আছে সেসবের ব্যবস্থাও। বিভিন্ন আকারের বাঁশ-বেত, মাটি ও প্লাস্টিক টব, জিও ব্যাগ থেকে শুরু করে গাছের জন্য উপযুক্ত প্যাকেটজাত রেডি মিক্সড মাটি, মাটির বিকল্প কোকোপিট, শুকনা গোবর সার, ভার্মিকম্পোস্ট বা কেঁচো সার, নিম খইল, শিং কুঁচি, হাড়ের গুঁড়া, ডিমের খোসার গুঁড়াসহ বিভিন্ন ধরনের জৈব ও রাসায়নিক সার, এমনকি বালাইনাশকও মিলবে। জৈববালাইনাশক হিসেবে ১০০ মিলি লিটারের নিম ও মেহগনি তেল নিতে পারবেন ১২০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। পাবেন উন্নত জাতের ফল ও সবজির প্যাকেটজাত বীজও। নিড়ানি, সিকেচার, কলম কাটার ছুরি, পানি দেওয়ার স্প্রে মেশিন, কীটনাশক ছিটানোর মেশিন, শাবল, কোদালসহ বাগান পরিচর্যার দরকারি সব সরঞ্জাম ও কৃষিবিষয়ক বই ও দিকনির্দেশনা–সংবলিত লিফলেটও মিলবে মেলায়।
এবার মেলার স্টলের সংখ্যা মোট ১১৯টি।মেলায় প্রবেশে কোনো টিকিটের খরচ নেই। প্রবেশমুখে আছে বিনা খরচে গাড়ি ও বাইক পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। প্রতিদিন খোলা থাকছে সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। ৫ জুন শুরু হওয়া মেলা চলবে ১৩ জুলাই পর্যন্ত। তবে আর দেরি কেন মা, বাবা কিংবা সহপাঠী বন্ধুবান্ধব নিয়ে দলবলে বেরিয়ে পড়ো একদিন, বিচিত্র সেই গাছের সমাহার দেখে অবাক হতে পারো, আবার পছন্দ হলে কিনেও নিতে পারো। স্কুলের প্রিয় শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে সবাই মিলে এক দিনের শিক্ষাসফরেও আসতে পারো বৃক্ষমেলাকে ঘিরে। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই বিভাগীয় পর্যায়ে ১৫ দিন, জেলা ও থানা পর্যায়ে সাত দিনের বৃক্ষমেলা বসবে, খেয়াল রেখো কিন্তু! বৃক্ষমেলায় যাও, গাছ কেনো, রোপণ করো, যত্ন নাও—তপ্ত প্রকৃতির তাপমাত্রা কমাতে অবদান রাখো তুমিও। আর বোনাস হিসেবে গাছের ফুল-ফল তো পাবেই।