হঠাৎ উড়োজাহাজের ঝাঁকুনি বেড়ে গেল কেন, পাখিতেই সমাধান?
গত ৯ জুন রোববার বিকেলে অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমান শিলাবৃষ্টির মধ্যে পড়ে। শিলার আঘাতে বিমানের ককপিটের সামনের জানালা ফেটে যায়। বিমানের একদম সামনের অংশ (নোজ কোন) ভেঙে যায়। বিমানের পাইলট মে ডে কল করতে বাধ্য হন। বিমানটি জরুরি অবতরণ করে। স্পেন থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় যাওয়ার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
বিমানটির যাত্রীরা জানিয়েছেন, ‘বিমানটি প্রচণ্ড কাঁপছিল।’ একজন যাত্রী অস্ট্রিয়ান গণমাধ্যমকে বলেছেন তিনি ধ্বংস হয়ে যাওয়া সামনের অংশ বিমানের পাশ দিয়ে উড়ে যেতে দেখেছেন। অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইনস জানিয়েছে, ‘বিমানটি বজ্রপাতের কবলে পড়ায় এ ঘটনা ঘটে। আবহাওয়ার রাডারে বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেখা যায়নি।’ আরেক যাত্রী জানান, ‘আমরা অবতরণ থেকে প্রায় ২০ মিনিট দূরে ছিলাম। এমন সময় শিলাবৃষ্টি এবং বজ্রপাতের মেঘের মধ্যে পড়ে গিয়েই ঝামেলা শুরু হয়।’
ঝড়বৃষ্টি বা বাতাসের ঝাঁকুনির ফলে দুর্ঘটনা এটিই প্রথম নয়। কিছুদিন আগের ঘটনা। গত ২১ মে মঙ্গলবার সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের এসকিউ ৩২১ ফ্লাইটটির ৭৭৭-৩০০ ইআর বিমান মাঝ–আকাশে প্রবল ঝাঁকুনির কবলে পড়ে। এই তীব্র ঝাঁকুনিতে একজন যাত্রী নিহত ও অন্তত ৩০ জন আহত হন। বিমানের ভেতরটি লন্ডভন্ড হয়ে যায়। নিহত যাত্রী ছিলেন ৭৩ বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিক জিওফ কিচেন। তিনি মূলত হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। বিমানটি জরুরি অবতরণ করে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে। বিমানটি লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুরে যাচ্ছিল।
বিমানের যাত্রী ২৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী জাফরান আজমির জানান, ‘বিমানটি হঠাৎ করে মনে হলো নিচের দিকে পড়ছে। যাঁরা সিটবেল্ট বাঁধেননি, তাঁরা সজোরে গিয়ে ওভারহেড ব্যাগেজ কেবিনের সিলিংয়ের সঙ্গে জোরে ধাক্কা খান। এটি এতটাই জোরে হয়েছিল যে কেবিনের আকৃতি পরিবর্তন হয়ে গেছে। চারপাশ থেকে সবাই চিৎকার দেওয়া শুরু করেন।’
প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে, ঝাঁকুনির কারণ তীব্র বাতাস। তবে ঘটনার সঠিক কারণ নির্ধারণের জন্য সিঙ্গাপুরের বিমান কর্তৃপক্ষ একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করেছে। ফ্লাইটরাডার ২৪-এর ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ফ্লাইটটি ৩৭ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ছিল, যা বাণিজ্যিক ফ্লাইটের ওড়ার গড় উচ্চতার সীমার মধ্যে।
২০২৪ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতিবছর বিমান মাঝারি থেকে গুরুতর টার্বুলেন্সের মুখে পড়ে প্রায় ৬৮ হাজার বার। আধুনিক বিমানে অত্যাধুনিক আবহাওয়া রাডার সিস্টেম থাকে। ১৮ ঘণ্টা আগে প্রায় ৭৫ শতাংশ টার্বুলেন্সের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। তবে অনেক ধরনের টার্বুলেন্স শনাক্ত করা কঠিন।
বিমানটি যখন মাত্র বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে সিঙ্গাপুরের দিকে যাচ্ছিল, ঠিক তখন বিমানটি যে উচ্চতায় (ক্রুজিং অল্টিটিউড) উড়ছিল, সেখান থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে হঠাৎ করে ৬ হাজার ফুট বা ১ হাজার ৮০০ মিটারে নেমে আসে। বিমানটি এক থেকে দেড় মিনিট ধরে ঝাঁকুনি দেয়। এ কারণে বিমানটিতে এত তীব্র ঝাঁকুনি হয়।
এয়ারলাইনটি ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছে, যাঁরা সামান্য আহত হয়েছেন, তাঁদের ১০ হাজার ডলার করে পরিশোধ করা হবে। গুরুতর আহত যাত্রীদের জন্য তাঁদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে ২৫ হাজার ডলার অগ্রিম অর্থ প্রদান করছে। এর বাইরে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আলোচনা করছে তারা।
টার্বুলেন্সের কবলে পড়ে ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ার হার বেড়ে যাওয়ার জন্য গবেষকেরা দায়ী করছেন জলবায়ু পরিবর্তনকে। দিনে দিনে বিমানে এমন দুর্ঘটনার হার বাড়ছে। নিচ থেকে আকাশের দিকে তাকালে ওপরের পরিস্থিতি বেশ শান্ত মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে বাতাসের স্রোত বা জেট স্ট্রিম সব সময় স্রোতের মতো চলতে থাকে। এই স্রোত কখনো মসৃণ, আবার কখনো নদীর ঢেউয়ের মতো উত্তাল ও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বাতাসের স্রোত ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। ঝড়বৃষ্টির যেমন পূর্বাভাস দেওয়া যায়, বায়ুর স্রোতে টার্বুলেন্স কতটা, তা সহজে পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে টার্বুলেন্সের ভবিষ্যদ্বাণী করা সবচেয়ে কঠিন।
গবেষকেরা বাতাসের স্রোতের অবস্থার পূর্বাভাস এবং কীভাবে এ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবছেন। তাঁদের ধারণা, এ সমস্যার সমাধান আছে পাখিতে। পাখিরা প্রায়ই আকাশে এমন উত্তাল বাতাসের মুখে পড়ে। কম উচ্চতায় পাখিরা বাতাসের মুখে পড়লে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা নিয়ে গবেষণা করে আবহাওয়াবিদেরা টার্বুলেন্সের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য আরও ভালো মডেল তৈরি করতে পারবেন। কিছু প্রজাতির পাখি প্রচণ্ড টার্বুলেন্স মোকাবিলা করে উড়তে অভিযোজিত হয়েছে। কীভাবে এই প্রক্রিয়া বিমানের ওড়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়, কীভাবে বিমানের নকশায় বিষয়টি বিবেচনা করা যায়, এটি নিয়ে ভাবছেন গবেষকেরা। বিশেষ করে শহরে চলাচল করা ছোট বিমান বা ড্রোনের ক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
২০২৪ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতিবছর বিমান মাঝারি থেকে গুরুতর টার্বুলেন্সের মুখে পড়ে প্রায় ৬৮ হাজার বার। আধুনিক বিমানে অত্যাধুনিক আবহাওয়া রাডার সিস্টেম থাকে। ১৮ ঘণ্টা আগে প্রায় ৭৫ শতাংশ টার্বুলেন্সের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। তবে অনেক ধরনের টার্বুলেন্স শনাক্ত করা কঠিন। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে এমন তীব্র টার্বুলেন্স আঘাত করে, যেটি আগে অনুমান করা যায় না। এমন টার্বুলেন্স বিমান দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিয়মিত এমন টার্বুলেন্স দেখা যাচ্ছে। গবেষকেরা কবুতরকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। কবুতর কীভাবে বাতাসের টার্বুলেন্স মোকাবিলা করে, সেটা পর্যবেক্ষণ করেন। আবহাওয়াবিদেরা এখন চেষ্টা করছেন টার্বুলেন্সের একটি পূর্ণাঙ্গ পূর্বাভাস দেওয়ার কম্পিউটার মডেল উদ্ভাবন করতে। যেটি সব রকম টার্বুলেন্সের পূর্বাভাস দিতে পারে। টার্বুলেন্সে পাখির ওড়াউড়ির সময় বাতাসের তাপীয় অবস্থা, দিক এবং গতি নির্ধারণ থেকে শেখা যেতে পারে।
সোয়ানসি ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা বলছেন, বাতাসে পাখিদের চলাচলের অভিজ্ঞতা থেকে টার্বুলেন্সের পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব হতে পারে। পাখিরা হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয়। বাতাসের গতি, দিক এবং টার্বুলেন্স নির্ধারণ করে এরা কোন পথে ভ্রমণ করবে এবং কী পরিমাণ শক্তি ব্যয় করবে। তবে বেশির ভাগ পাখি বাণিজ্যিক বিমানের পাশাপাশি বা একই উচ্চতায় ওড়ে না। কিছু পাখি অনেক বেশি উঁচুতে ওড়ে। যেমন ফ্রিগেট পাখি। এরা মাটি থেকে ১৩ হাজার ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় উড়তে পারে।
তবে পাখি কীভাবে ওড়া নিয়ন্ত্রণ করে, তা নিয়ে খুব কম জানা গেছে। এগুলো জানার জন্য আগেও গবেষণা হয়েছে। ওয়েলসের সোয়ানসি ইউনিভার্সিটির পাখির ওড়া এবং বায়ুপ্রবাহ বিশেষজ্ঞ এমিলি শেপার্ডের গবেষক দল ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত হোমিং কবুতরের ঝাঁকের পাশাপাশি একটি আলট্রালাইট বিমান ওড়ানো হয়েছিল। জিপিএস, ব্যারোমেট্রিক চাপ এবং অ্যাকসিলারেশন ডেটা লগার ব্যবহার করে ৮৮টির বেশি ফ্লাইটে টার্বুলেন্সের মাত্রা পরিমাপ করেছিলেন।
দেখা গেছে, টার্বুলেন্সে গবেষক দলের বিমান একদমই উড়তে পারছিল না। প্রচুর ঝাঁকুনি হচ্ছিল। একই টার্বুলেন্সে কবুতর খুব সহজভাবেই উড়েছে। এ থেকে গবেষকেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কবুতর উচ্চমাত্রার টার্বুলেন্স মোকাবিলা করতে পারে। যেটা আলট্রালাইট বিমানের তুলনায় বেশি। পাখির পায়ে লাগানো ট্যাগ এবং সেন্সর এ ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। পাখি ওড়ার পথে যে টার্বুলেন্সের মুখোমুখি হয়, সে সম্পর্কে ক্রমাগত তথ্য সংগ্রহ করতে পারে সেন্সর। এটি বিমানে লাগানো সেন্সর থেকে কম খরুচে। আবার পাখিরা যে পরিস্থিতিতে উড়তে পারে, বিমান সে অবস্থায় উড়তে পারে না।
আবার শহরে উঁচু স্থাপনা থাকায় টার্বুলেন্স বেশি হয়। বিল্ডিং বাতাসের প্রবাহকে বাধা দেয়। কীভাবে শহরে নিরাপদে ফ্লাইট পরিচালনা করা যাবে, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। বাতাস একটি বিমানকে বিল্ডিংয়ের দিকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। গবেষক শেপার্ড বলেছেন, ‘নগরায়ণ টার্বুলেন্স বাড়ানোয় অবদান রাখছে। নগরায়ণ কীভাবে পাখিদের ওড়াকে প্রভাবিত করে, তা আমাদের জানতে হবে।’
টার্বুলেন্স নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত। বিশ্বজুড়ে আকাশপথে ভ্রমণ আরও কঠিন হবে। কীভাবে আকাশে ওড়া সহজ করা যায়, তার এক-দুটি জিনিস পাখির কাছ থেকে শেখা যেতে পারে।
সূত্র: বিবিসি