প্রাচীন গ্রিসে আর্কিমিডিস নামে এক দার্শনিক ছিলেন। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন, জাহাজ কেন পানিতে ভাসে। সে এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার। প্রচলিত আছে, সেটাই ছিল ইতিহাসের প্রথম ‘ইউরেকা’ মুহূর্ত! মানে, সেই রহস্য উন্মোচনের আনন্দে গোসলরত নগ্ন আর্কিমিডিস ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলে চিৎকার করতে করতে ছুট দিয়েছিলেন। কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে রসিকতা করে বলেন, ইউরেকা ছিল তাঁর স্ত্রীর নাম।
তা গল্প বলিয়েরা তো কত কিছুই বলেন। তার সবই সত্য নয়। আর্কিমিডিসের গল্পের সত্যতা নিয়েও সন্দেহ আছে। তবে এ–বিষয়ক বৈজ্ঞানিক সূত্রটার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে আছে ভালোভাবেই। তবে তিনি বিশেষভাবে জাহাজের ভেসে থাকার কারণ আবিষ্কার করেননি। ভেবে ভেবে বের করেছিলেন, পানিতে কোনো কিছু ভাসে কেন। সেটা খ্রিষ্টপূর্ব ২৪৬ সালের কথা।
এবারে একটা কথা ভাবো তো। তুমি একটা সূত্র আবিষ্কার করলে, আর তার ওপর ভরসা করে মানুষ জাহাজে উঠে পড়ল নির্ভয়ে, আবিষ্কার করে ফেলল নতুন নতুন দেশ-মহাদেশ—এমনটা কি আদৌ হয়? আর্কিমিডিসের সূত্রে ভর করেও কেউ অমন কাজ করেননি আসলে।
তা একটা পুরোনো কৌতুক একটু ধার করে বলা যাক। আমার এক বন্ধু যেদিন জানল, অক্সিজেন আবিষ্কার হয়েছে ১৭৭২ সালে, তখন সে প্রশ্ন করল—এর আগে মানুষ শ্বাস নিত কীভাবে? এ রকম বন্ধু নিশ্চয়ই তোমাদেরও আছে। বহুবার ইন্টারনেটে দেখা এই জোক বা মিম ধার করে বলা যায়, এর আগেও যেমন মানুষ শ্বাস নিত, তেমনি আর্কিমিডিসের সূত্রের আগেই মানুষ জাহাজ নির্মাণ করেছিল, ভেলা ভাসিয়েছিল নদীতে। তাঁর সূত্র শুধু ব্যাখ্যা দিয়েছে, জাহাজ কীভাবে ভাসে।
বাক্সটার ভেতরটা খালি। অর্থাৎ বাতাসপূর্ণ। প্রতি একক আয়তনে বাক্সের ঘনত্ব পানির ঘনত্বের চেয়ে কম। এককথায় বললে, বাক্সটা পানির চেয়ে হালকা। সে জন্যই এটা ভাসছে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, প্রথম বিশালাকার জাহাজের সন্ধান মেলে প্রাচীন মিসরে। সেটা খ্রিষ্টপূর্ব ৬ হাজার সালের দিকের কথা। আরও প্রায় ২ হাজার বছর আগেই মানুষ ভেলা ভাসিয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো এই ভেলা কিন্তু মিসর বা গ্রিস নয়, পাওয়া গেছে আজকের নেদারল্যান্ডসে। দেশটির ডেরেন্স প্রদেশের ‘পেসে’ গাঁয়ে পাওয়া এই ভেলার নাম রাখা হয়েছে ‘পেসে ক্যানু’ বা পেসে ভেলা।
অনেক কথা হলো। এবার শুরুর প্রশ্নে ফিরে যাই। আর্কিমিডিসের সূত্র আসলে কী বলে? কীভাবে ভেসে থাকে জাহাজ? বোঝার জন্য এমন একটা দৃশ্য ভাবা যাক, যেটা আমরা বাসায় পরীক্ষা করতে পারব।
কানায় কানায় ভরা একটা বালতি। একটা ভারী খালি বাক্স এনে এতে ভাসিয়ে দিলে কী হবে? কিছুটা পানি উপচে পড়বে। বাক্সটার ওজন আছে। নিজের ওজনের সমান পানিকে সরিয়ে দিয়ে সেই জায়গা নিয়েছে এটি। তারপর? বাক্সটা কিন্তু ডুবে যাবে না, ভেসে থাকবে। কেন? কারণ, পানি একে ওপরের দিকে ঠেলছে। পানি যদি বাক্সটাকে ওপরের দিকে ধাক্কা না দিত, তবে বাক্সটা তলিয়ে যেত। গিয়ে পৌঁছাত একদম বালতির নিচে। এই যে পানি বাক্সটাকে ওপরের দিকে ঠেলছে, এর ওপর ঊর্ধ্বমুখী বল প্রয়োগ করছে, যার ফলে বাক্সটা ভেসে আছে—ইংরেজিতে এ ঘটনাটাকে বলে বুয়েন্সি। বাংলায় বলে প্লবতা। আর পানি যে বলে (পড়ো, শক্তিতে) বাক্সটাকে ওপরের দিকে ঠেলছে, তার নাম প্লবতা বল (বুয়েন্ট ফোর্স)।
এখানে ঘটনাটা কী ঘটছে আসলে? বাক্সটার ভেতরটা খালি। অর্থাৎ বাতাসপূর্ণ। প্রতি একক আয়তনে বাক্সের ঘনত্ব পানির ঘনত্বের চেয়ে কম। এককথায় বললে, বাক্সটা পানির চেয়ে হালকা। সে জন্যই এটা ভাসছে।
এবারে একটু থাম। ভেবে দেখ, জাহাজ তো হালকা না! টনকে টন ওজন। তাহলে? মনে রাখতে হবে, ভারী হওয়ার পাশাপাশি জাহাজ আকারে অনেক বড়। এর খোলের ভেতরে যথেষ্ট জায়গা রাখা হয়। সবটা থাকে বাতাসে ভরা। আকার অনুযায়ী বিশাল জায়গাজুড়ে এটি বসে থাকে পানির ওপরে। যে পরিমাণ জায়গা এটা পানির ওপরে দখল করে আছে, প্রতি একক আয়তনে এর ঘনত্ব পানির চেয়ে কম। সে জন্যই জাহাজ ভেসে থাকতে পারে।
তাহলে জাহাজডুবির যে ঘটনা ঘটে, সেটা কেন হয়?
দুর্ঘটনাক্রমে কোনোভাবে জাহাজের খোল ফেটে গেলে ভেতরে পানি ঢুকে পড়ে। তখন জাহাজের ভেতরের ঘনত্ব (বাতাসের জায়গা দখল করে নেওয়া পানি) আর বাইরের পানির ঘনত্ব সমান হয়ে যেতে থাকে। ঘনত্বের পার্থক্য যত কমে, জাহাজ তত তলিয়ে যায়। জাহাজের ভেতরের বাতাসের জায়গা ধীরে ধীরে দখল করে পানি। এখন যে খোল, মালপত্র আছে, এগুলোর ভেতরে আর বাতাস নেই। এগুলো আর পানির চেয়ে হালকা না, ভারী। তাই এগুলো তলিয়ে যায়।
ঠিক ধরেছ, আইসবার্গ বা বরফের চাঁইয়ের ধাক্কায় এভাবেই তলিয়ে গিয়েছিল বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজ। তোমাকে কেউ যদি বলে, টাইটানিক মুভির জ্যাক জাহাজ কীভাবে ভাসত, সেটা জানত না বলে ডুবে গিয়েছিল, তাহলে কিন্তু বিশ্বাস করো না। তবে এটা নিয়ে একটা মিম বানিয়ে ফেলাই যায়, কী বলো?