যেভাবে সমুদ্র অভিযাত্রী ও তাঁর কুকুরের জীবন বাঁচিয়েছে জাপানি সুশি
সাগরে টুনা মাছের ঝাঁক শনাক্ত করার জন্য হেলিকপ্টার নিয়ে ঘুরছিলেন একজন টুনা স্পটার। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল থেকে ১ হাজার ২০০ মাইল দূরে উড়ছিলেন তিনি। এমন সময় খোলা সমুদ্রে একটি সাদা রঙের ক্যাটাম্যারানকে (ইঞ্জিনচালিত নৌকা) ভাসতে দেখেন। নৌকাটির অবস্থা খুব খারাপ। কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ভাসছে। ইঞ্জিন বন্ধ।
পাইলট নৌকাটির কথা রেডিওতে টুনা মাছ ধরা ট্রলারকে জানান। ক্যাটাম্যারানটি উদ্ধার করতে আসে ট্রলারটি। নৌকা থেকে উদ্ধার করা হয় একজন ৫৪ বছর বয়সী ব্যক্তিকে। লোকটির নাম টিমোথি শ্যাডক। সমুদ্র থেকে উদ্ধার করার সময় লোকটির সঙ্গী একটি কুকুরকেও জীবিত উদ্ধার করা হয়। কুকুরটির নাম বেল্লা। টিমোথি উদ্ধার হওয়ার পর চ্যানেল নাইনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত খাবার পাইনি।’
উদ্ধারের সময় ছোট আকারের ক্যাটাম্যারানটির অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ঝড়ের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নৌকাটি। উদ্ধারের ভিডিওতে দেখা গেছে, মাথাভর্তি চুল ও মুখভর্তি দাঁড়ি–গোঁফওয়ালা একজন বয়স্ক লোককে নৌকা থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে। লোকটির দাঁড়ি-গোঁফ রোদে ঝলসে গেছে।
মাছ ধরার ট্রলার থেকে উদ্ধারকারী যাওয়ার পর তিনি বলেন, ‘আমি টিমোথি শ্যাডক। আমি আর আমার কুকুর বেল্লা প্রায় তিন মাস সমুদ্রে ভেসে আছি।’
টিমোথি তিন মাস টুনা মাছ ধরেছেন। জাপানি মাছ খাওয়ার পদ্ধতি সুশি হিসেবে কাঁচা টুনা খেয়ে টিকে ছিলেন। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি ধরে পান করতেন।
গত ১৭ জুলাই টিমোথি শ্যাডক ও তাঁর কুকুর বেল্লাকে উদ্ধার করে মেক্সিকান টুনা মাছ ধরা ট্রলার মারিয়া ডেলিয়া। এরপর টিমোথির সমুদ্রে টিকে থাকার অসাধারণ গল্পটি জানতে পারে সবাই। গত তিন মাস টিমোথিকে ক্লান্তি, হতাশা এবং ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। তিনি বলেছেন, প্রথমে তাঁর মনে দার্শনিক চিন্তাভাবনা আসত। এরপর নিজের অবস্থাকে নিজের কাছে হাস্যকর লাগা শুরু করল। পরে সবকিছুর প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়েন তিনি।
উদ্ধারের পর মেক্সিকোর মানজানিলোর একটি সমুদ্র উপকূলীয় ডকে সাংবাদিকদের টিমোথি বলেন, ‘আমি সমুদ্রকে উপভোগ করেছি। বিষয়গুলো কঠিন হওয়ার পর ভেবেছি, আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু আপনি যখন মুক্তি পাবেন, তখন ভাববেন এবার আপনি বেঁচে থাকতে চান। আমি খুবই কৃতজ্ঞ।’
টিমোথি একজন অস্ট্রেলিয়ান। তাঁর কথা অনুযায়ী গল্পটি শুরু হয়েছিল প্রায় তিন মাস আগে। তিনি এবং বেল্লা মেক্সিকো থেকে ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ার উদ্দেশে নৌকায় চেপে রওনা হন। আলোহা তোয়া নামের ক্যাটাম্যারানে চেপে তাঁদের এই যাত্রা শুরু হয়।
টিমোথির দাবি, তিনি নিশ্চিত নন, কেন তিনি প্রায় চার হাজার মাইল যাত্রা শুরু করেছিলেন। তবে তিনি জাহাজ চালানো খুব উপভোগ করেন। সমুদ্রের মানুষকে ভালোবাসেন।
এই ভ্রমণের গল্পটির একটি পটভূমি আছে। ২০১৩ সালের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, তিনি একজন সাবেক তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী। কাঁচা খাদ্যের উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি কাঁচা শাকসবজি খেয়ে অন্ত্রের ক্যানসার জয় করেছিলেন।
একসময় তিন মাস শুধু সবুজ শাকসবজির জুস খেয়েছেন। সরাসরি বাগান থেকে তোলা সবজি এবং অস্ট্রেলিয়ার বুশল্যান্ডের বুনো খাবার খেতেন।
প্রশান্ত মহাসাগরে যাত্রা শুরুর কয়েক সপ্তাহ পর ঝড়ের কবলে পড়েন। ঝড়ে তাঁর ক্যাটাম্যারান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাগরে ভেসে থাকার সময় শেষবার এক পূর্ণিমা রাতে ভূমি দেখেছিলেন। এরপর অনেক অনেক খারাপ দিন ও অনেক ভালো দিন কাটান। ক্লান্তি তাঁকে চেপে ধরেছিল।
নৌকায় মাছ ধরার যন্ত্রপাতি ছিল। প্রচুর মাছ ধরতেন। টুনা মাছের সুশি ছিল মূল খাবার। তাঁর ওজন অনেক কমে গেছে। শেষের দিকে কয়েক সপ্তাহ ধরে খুব ক্ষুধার্ত ছিলেন। এই তিন মাসের কিছুদিন তাঁর শরীর খুব খারাপ ছিল।
সমুদ্রে টিকে থাকার জন্য বেল্লা নামের কুকুর ছিল তাঁর একমাত্র সঙ্গী। খোলা সাগরে কষ্ট সহ্য করতে সহায়তা করেছে বেল্লা। মেক্সিকো থেকে কুকুরটি তাঁকে অনুসরণ করা শুরু করে। কোনোভাবে তাঁর পিছু ছাড়েনি। বেল্লার জন্য কোনো হোম খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বেল্লা তাঁকে ছাড়েনি। সমুদ্রযাত্রায় তাঁর পিছু পিছু গিয়েছে। টিমোথি বেল্লার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তাঁর মতে, বেল্লার কারণেই তিনি বেঁচে আছেন। তাঁর চেয়ে বেল্লার সাহস অনেক বেশি।
টুনার ঝাঁক খুঁজে বের করা হেলিকপ্টারটিই ছিল টিমোথির কয়েক মাসের মধ্যে দেখা মানুষের উপস্থিতির লক্ষণ। উদ্ধারের ভিডিওতে টিমোথিকে দুটি টুপি পরা অবস্থায় দেখা গেছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, শুধু বিশ্রাম আর ভালো খাবার পেলেই টিমোথি সেরে উঠবেন। উদ্ধারের পর থেকে তিনি অবশ্য প্রচুর খাবার খাচ্ছেন।
ট্রলারটির মালিক গ্রুপোমার উদ্ধারের খবর জানান অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসকে। দূতাবাস টিমোথিকে নিরাপদে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরতে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে। উদ্ধারকারী জাহাজের সবার প্রতি জীবন বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন টিমোথি।
তাঁকে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, শিগগির আবার সমুদ্রযাত্রায় যাবেন? তিনি হাসতে হাসতে বলেছেন, সম্ভবত না।