সকাল থেকেই শিশু থেকে শুরু করে বুড়ো-বুড়ি সবাই সবুজ ঘাসের ওপর অপেক্ষায় আছে। সূর্য উঠছে পুব আকাশে। সেই আলোয় পাহাড়ি এবড়োখেবড়ো পথ বেয়ে উঠছে একটি ঘোড়া। শুধু ঘোড়া নয়, বলা যায় চলন্ত পাঠাগার বা ‘ঘোড়া লাইব্রেরি’। তার পিঠভর্তি বই, জ্ঞানের আলো। এই আলো একটু পরেই পৌঁছে যাবে শিক্ষার আলোবঞ্চিত গ্রামে গ্রামে।
এই পথের একপাশে প্রায় অন্ধকার খাদ। আরেক পাশে বিপজ্জনক সরু রাস্তা। আর চারপাশে অশিক্ষার অন্ধকার। এসব পেরিয়ে উঠে আসছে ঘোড়াটি। ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনলেই অপেক্ষায় থাকা শিশু-বুড়োদের মুখে ফুটে ওঠে আলোর মতো হাসি। কাছাকাছি আসতেই সবাই ছুটে গিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পছন্দের বই নিয়ে বসে পড়ে ঘাসের ওপর। কেউ কেউ এখানেই পড়ে নেন পাঠ্যবই বা প্রিয় কোনো বই। আবার কেউ কেউ এক সপ্তাহের জন্য বাড়িও নিয়ে যেতে পারেন এসব বই। এই ঘোড়ার মাধ্যমেই এখন ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের কুমায়ুন অঞ্চলের প্রত্যন্ত পাহাড়ি সুবিধাবঞ্চিত গ্রামে শিক্ষার আলো বিলিয়ে বেড়াচ্ছে।
উত্তরাখন্ডের নৈনিতাল জেলার অধিকাংশ পাহাড়ি গ্রামে ভারী বৃষ্টির কারণে রাস্তাঘাট সব পানিতে তলিয়ে গেছে। গাড়ি তো দূর অস্ত, এ সময় এই এলাকায় সাইকেলও চালানো যায় না। বাজারের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ আড়াই মাস। প্রতিবছর এ সময় গ্রামগুলো এমন সমস্যার সম্মুখীন হয়। শিক্ষার্থী ও পাঠকেরা বঞ্চিত হন বই পড়া থেকে। এ কারণেই ঘোড়ার পিঠে বই নিয়ে তা এমন মানুষদের পড়ানোর মহান উদ্যোগ নিয়েছেন নৈনিতালের বাসিন্দা শুভম বাধানি নামের এক তরুণ। ইতিমধ্যে এই ‘ঘোড়া লাইব্রেরি’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শুভমের ‘ঘোড়া লাইব্রেরি’ এখন জেলার কোটাবাগ ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম জালনা, বাঘনি, মহলধুড়া, আলেখ, গাওটিয়া, ধিনভাখারাক, সালভা, দুদালিয়া, দোলা, চানিখত ও বানসিতেও যাচ্ছে।
জালনা গ্রামের ছোট্ট মেয়ে জ্যোতি। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিনমান পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু গ্রামে ‘ঘোড়া লাইব্রেরি’ আসার পর থেকে সে আর পাহাড়ে অযথা ঘুরে বেড়ায় না। বই পড়ে। তার মা পুষ্পা দেবী বলেছেন, ‘আমার মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বৃষ্টির কারণে এখন স্কুল বন্ধ। গ্রীষ্মের ছুটি বা বৃষ্টির কারণে স্কুল বন্ধ থাকলে জ্যোতি বাড়িতে একদম পড়াশোনা করত না। খেলা করত, না হয় পাহাড়ে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু গত দুই মাস ধরে “ঘোড়া লাইব্রেরি” আসায় সে এখন বিভিন্ন বই পড়ে সময় কাটায়। কবিতা ও গল্পের বই তার ভীষণ প্রিয়।’
বাঘনি গ্রামের বাসিন্দা হরিশ। তাঁর তিন সন্তানের সবাই এখন ‘ঘোড়া লাইব্রেরির’ বই নিয়ে পড়াশোনা করছে। তিনি বলেন, ‘বর্ষাকালে গ্রামের অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয় যে জরুরি খাবার কিনতেও বের হওয়া যায় না। স্কুলগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হয়। দু-একজনের বেশি শিক্ষক পাওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতি দেখে শিক্ষকেরা অন্য জায়গায় বদলি নিয়ে চলে যান। তবে গ্রামে ঘোড়া পাঠাগারের কাজ দেখে স্থানীয় লোকজন খুবই খুশি। যাঁরা আগে বই থেকে দূরে থাকতেন, তাঁদেরও এখন বই পড়তে দেখা যায়। ঘোড়া পাঠাগার পাহাড়ের শিশুদের জন্য দুর্দান্ত কাজ করছে।’
যেভাবে শুরু
২৯ বছর বয়সী শুভম বাধানি নিজেও একজন গ্রন্থাগারিক। এই বিষয়ে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন তিনি। জেলার এই প্রত্যন্ত গ্রামের দুরবস্থা দেখে শুরুতে তিনি কিছু একটা করার কথা ভাবেন। এতগুলো মানুষ বইয়ের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবে, তা তিনি মানতে পারেননি। তাই তিনি ওই সব গ্রামে বইয়ের আলো বিলানোর উদ্যোগ নেন। শুরুতে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে অল্প কিছুসংখ্যক বই সরবরাহের পাশাপাশি গ্রামের শিশু ও অভিভাবকদের পাঠদান শুরু করেন শুভম। সেই থেকে শুরু। আর থামেননি শিক্ষায় প্রেরণাদাতা শুভম। এর পর থেকে পাহাড়ি গ্রামের পথে পিঠভর্তি বই নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে ঘোড়া, ছড়িয়ে দিচ্ছে জ্ঞানের আলো। ঘোড়ার পিঠে পাঠ্যবই তো আছেই, সঙ্গে সাধারণ জ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষাসহ বিপুল ভাবনার গল্প ও কবিতার বইও আছে। আর এই ঘোড়ার আশ্চর্য ‘ঘোড়সওয়ার’ শুভম।
মহৎ এই কাজে সঙ্গীও জুটে যায় শুভমের। হিম্মোত্থান ও সংকল্প ইয়ুথ ফাউন্ডেশন নামের স্থানীয় দুটি সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বই ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে ‘ঘোড়া লাইব্রেরি’কে। শুভম এখন এই প্রকল্পের প্রকল্প সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন।
এই প্রকল্পের স্বেচ্ছাসেবীরা কুমায়ুন অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামে যাঁরা বই পড়তে চান, তাঁদের হাতে বই তুলে দেন। এক সপ্তাহের জন্য ওই বই বিনা মূল্যে নিজের কাছে রাখা যায়। পরের সপ্তাহে আবার ‘ঘোড়া লাইব্রেরি’ যখন ওই গ্রামে পৌঁছাবে, তখন ওই ফিরিয়ে দিয়ে নতুন বই নেওয়া যাবে।
শুভম বাধানি বলেন, ‘আমরা পাহাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ করি। এসব গ্রামের রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা, খাবার পানিরও সুব্যবস্থা নেই। দিনে মাত্র ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। তাই এসব গ্রামে শহরের মতো শিক্ষার পরিবেশ দেওয়াটা কঠিন। এসব সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করে আমরা নৈনিতালের কোটাবাগ ব্লকের অনেক গ্রামে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের ধারণা নিয়ে এসেছি। এ কারণে গ্রামগুলোতে স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ করে তাঁদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তাঁরা সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে বই নিয়ে যেতে থাকেন। তবে গত ১০ জুন থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে এই গ্রামগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পরে এই উদ্যোগ যেন বন্ধ না হয় এ কারণে গ্রামবাসীরা ঘোড়া সরবরাহ করেছে। এখন এই ঘোড়ার পিঠেই বই নিয়ে গ্রামে গ্রামে যেতে শুরু করেছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা।’
শুভম বলেন, বর্তমানে তাঁদের ১০টি ঘোড়া ও ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক আছেন। এখনো গ্রামগুলোর বেশ কিছু জায়গার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। ওই সব এলাকায় পৌঁছানোর জন্য ঘোড়া ও স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।
নতুন বিষয় শিখছে শিশু
‘ঘোড়া লাইব্রেরি’র একজন স্বেচ্ছাসেবী সুভাষ চন্দ্র বদানী। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করা সুভাষ সপ্তাহে দুবার ঘোড়ার পিঠে বই নিয়ে গ্রামে গ্রামে যান।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, শিশুদের পড়াশোনা যাতে থেমে না যায়। এ কারণে আমরা ঘোড়ার পিঠে নিয়ে বিনা মূল্যে তাদের বই সরবরাহ করি। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে আমরা ক্লাসের দিন নির্ধারণ করি। ১০ থেকে ১৫ জন ছেলেমেয়ে পড়তে আসে। তাদের নিয়ে একটি বইয়ের আলোচনা দিয়ে অধিবেশন শুরু হয়। তাদের শিশুসাহিত্যের গল্প পড়ে শোনাই। পরবর্তী সময় কী হয়, তা নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য গল্পগুলো একপর্যায়ে থামিয়ে দিই। আমরা দেখেছি, মাত্র দুই মাসের মধ্যে নতুন নতুন বিষয় শেখার জন্য শিশুদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে।’
বিএ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কবিতা রাওয়াতও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। এ কাজে তিনি জালনা, দোলা ও গাওটিয়া গ্রামের দেখাশোনা করেন। তিনি বলেন, ‘ঘোড়ার পিঠে বই নিয়ে আসা দেখে শিশুরা বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আর আমরা যে বইগুলো পড়াই, সেগুলো পাঠ্যপুস্তক নয়। বিষয়টি শিশুদের মধ্যে আগ্রহ বাড়িয়েছে। যে গ্রামে আমরা এই কর্মসূচি পরিচালনা করছি, সেখানে সপ্তাহে তিন ঘণ্টা করে দুটি ক্লাস হয়। ফেরার সময়, ঘরে বসে পড়ার জন্য তাদের সাহিত্যের বই দিই। পরের সপ্তাহে যখন আবার ওই গ্রামে যাই, তখন আগের বই ফেরত নিয়ে নতুন আরেকটি বই দিই।’
এই প্রকল্পে শিশুদের পাশাপাশি বড়দের সাক্ষরতা শেখানো ও বই পড়ানো হয়। জালনা গ্রামের বাসিন্দা ৩২ বছর বয়সী নাথুরাম এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা সবাই পড়ার আসরে অংশ নিই। এতে আমাদের জানার পরিধি বাড়ছে। ঘোড়া আসার নির্ধারিত দিনে আমরা আগেই প্রয়োজনীয় কাজ সেরে পড়ায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকি।’
উৎসাহ দিচ্ছেন সবাই
নৈনিতালের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নগেন্দ্র বার্থওয়াল বলেন, ‘আমি “ঘোড়া লাইব্রেরি”র কথা জানি। উদ্যোক্তারা দারুণ কাজ করছে। এতে সমাজ উপকৃত হচ্ছে। অভিভাবকদের এই লাইব্রেরির সুবিধা নিতে হবে। এতে তাঁরা সন্তানদের লেখাপড়া করানো ও শিক্ষিত করে তুলতে পারবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারও অনেক কাজ করছে, শিশুরা এর সুফল পাচ্ছে।’
গ্রামপ্রধান কমলা নেগি বলেন, এই অনন্য শিক্ষাব্যবস্থার কারণে গ্রামের শিশুরা বেশ আনন্দিত। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামটি প্রত্যন্ত। এখানে ভালো কোনো পরিবহনব্যবস্থা নেই। এরপরও শিশুরা বইয়ের সুবিধা পাচ্ছে, তাদের পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে না। তাদের পড়ালেখায় আগ্রহ বেড়েছে, বাড়িতেও নিয়মিত পড়াশোনা করছে। ঘোড়া লাইব্রেরির কারণে ছেলেমেয়েদের বইভীতি দূর হয়েছে। আমরা গ্রামে শিক্ষার পরিবর্তিত রূপ দেখতে পাচ্ছি।’
‘ঘোড়া লাইব্রেরি’র উদ্যোক্তা শুভম বাধানি বলেন, শিশুদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক শ্রেণিতে একটি লাইব্রেরির মতো পরিবেশ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। এতে শিশুরা যখন বড় ক্লাসে উঠবে তখন তাদের পড়তে কোনো অসুবিধা হবে না।
শুভম আরও বলেন, ‘মুঠোফোন শিশুদের পড়ার আগ্রহ নষ্ট করে দিচ্ছে। শিশুদের হাতে মুঠোফোন ছেড়ে দিলে তারা বই থেকে আরও দূরে সরে যাবে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুরা শিশুসাহিত্য পড়তে পছন্দ করে, এসব বই তাদের বিনোদন দেয়। তাই তাদের পছন্দের শিশুসাহিত্য পড়াতে হবে। এ কারণে আমরা তাদের সাহিত্য ও ছবির বই সরবরাহ করি। ছবির বই দেখে তারা চিন্তা করতে, বুঝতে ও মানসিক ক্ষমতা বিকাশ করতে উৎসাহিত হয়। এরপর তারা পড়তে শুরু করে।’