আমরা সময়ের হিসাব রাখি ঘণ্টা ও মিনিটে। এই লেখা যখন লিখছি, তখন দেয়ালঘড়িতে রাত ১০টা ১৫ মিনিট। কেউ জিজ্ঞাসা করলে নিশ্চয়ই বলতাম, এখন সোয়া ১০টা বাজে। ঘড়িতে সব সময় টিকটিক করছে লম্বা একটি কাঁটা। এটাকে আমরা বলি সেকেন্ডের কাঁটা। সময় বলার সময় এই কাঁটা উপেক্ষিত থাকে।
আমরা জানি ৬০ সেকেন্ডে হয় ১ মিনিট। আর ৬০ মিনিটে হয় ১ ঘণ্টা। কিন্তু কখনো কি ভেবেছি, এক সেকেন্ড আসলে কতক্ষণ? আমরা প্রায় প্রতিদিন এই শব্দ ব্যবহার করি। কিন্তু এক সেকেন্ডের সঠিক পরিমাপ কীভাবে নির্ধারিত হলো, তা জানতে এই লেখা। এটি জানতে আমাদের সময়ের ইতিহাসে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। এখন অনেকে ভাববে, এক সেকেন্ড হলো ঘড়ির কাঁটায় সেকেন্ডের এক দাগ থেকে অন্য দাগে যাওয়ার সময়। প্রশ্ন হলো, কিসের মাধ্যমে এই দাগের সময় নির্ধারণ করা হলো? কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে মাপা হলো সেকেন্ডের ব্যাপ্তি?
সময় গণনার জন্য উদ্ভাবন করা হয় পেন্ডুলাম ঘড়ি, কোয়ার্টজ ঘড়ি ইত্যাদি। তবে বিজ্ঞানীরা সময় পরিমাপের আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে তৈরি করেন অ্যাটমিক ক্লক বা পারমাণবিক ঘড়ি।
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সভ্যতা চাঁদ, সূর্য ও নক্ষত্রদের চলাচলের ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব ক্যালেন্ডার তৈরিতে সময় নির্ধারণ করত। এমনকি আমরা যাকে সেকেন্ড বলে জানি, তা সম্পর্কে ১৫০০ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত কারও কোনো নির্দিষ্ট ধারণা ছিল না। যখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্রিটিশদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সবার কাছে সময় গণনার ধারণা কিছুটা স্পষ্ট হয়।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে দিনকে ২৪ ঘণ্টায় ভাগ করা হয়। আর প্রতি ঘণ্টাকে ৬০ মিনিটে। প্রতি মিনিটকে আবার ৬০ সেকেন্ডে ভাগ করা হয়। শুরুতে সেকেন্ডকে এভাবে গাণিতিকভাবে ভাগ করা হয়। অর্থাৎ প্রতি মিনিটকে ভাগ করা হয় ৩ হাজার ৬০০ সেকেন্ডে। আর ২৪ ঘণ্টাকে ভাগ করা হয় ৮৬ হাজার ৪০০ সেকেন্ডে। মানে বছরে ৩১ লাখ ৫৫৬ হাজার ৯২৬ সেকেন্ড। তখন এভাবে প্রতি সেকেন্ড গণনা করা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সীমানায় টাইম জোন বদলে যাওয়ায় সময়ের হিসাব করতে সমস্যা শুরু হয়। প্রতিটি সেকেন্ড সঠিকভাবে গণনা করা আরও কঠিন হয়ে যায়।
সময় গণনার জন্য উদ্ভাবন করা হয় পেন্ডুলাম ঘড়ি, কোয়ার্টজ ঘড়ি ইত্যাদি। তবে বিজ্ঞানীরা সময় পরিমাপের আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে তৈরি করেন অ্যাটমিক ক্লক বা পারমাণবিক ঘড়ি। ১৯৫৫ সালের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্যে সময় গণনার নতুন ধারণা প্রকাশ করেন। পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রন ঘুরছে, এটা আমাদের সবার জানা। নিউক্লিয়াসের চার্জ ধনাত্মক এবং ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক। একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিটি ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তবে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ক্ষেত্র, যেমন আলো বা রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে এই ঘূর্ণন পেন্ডুলামের মতো দোলন গতিতে পরিবর্তন করা সম্ভব। কোয়ান্টাম মেকানিকসের এই ধারণা কাজে লাগিয়ে তৈরি হয় পারমাণবিক ঘড়ি।
কীভাবে ঠিক হলো, পারমাণবিক ঘড়ির সময় হিসাব করার জন্য কোন মৌলের কম্পন হিসাবে ধরা হবে? এর উত্তর জানতে পর্যায় সারণিতে যেতে হবে। পর্যায় সারণিতে ১১৮টি মৌল আছে। ১৯৬৭ সালের দিকে ওজন ও পরিমাপের জন্য আন্তর্জাতিক কমিটির (সিআইপিএম) ১৩তম সাধারণ সম্মেলনে বিষয়টি আলোচিত হয়। বিজ্ঞানীরা খুঁজছিলেন এমন একটি মৌল, যার দীর্ঘায়ু রয়েছে। মানে অর্ধায়ু অনেক বেশি। দ্রুত ক্ষয়ে যায় না। এই খোঁজে জয়ী হয় সিজিয়াম পরমাণু। যার সংকেত Cs, পারমাণবিক সংখ্যা ৫৫ ও পারমাণবিক ভর ১৩৩। সিআইপিএম কনফারেন্সে সিদ্ধান্ত হয়, তখনকার প্রচলিত অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সেকেন্ডের গড় মান অনুসারে। অর্থাৎ এক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সেকেন্ডে সিজিয়াম পরমাণুতে ৯১৯, ২৬, ৩১, ৭৭০টি কম্পন তৈরি হয়। ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিজ্ঞানীরা একমত হন যে সিজিয়াম-১৩৩ পরমাণুর নিউক্লিয়াসের নির্দিষ্ট শক্তিস্তরের মধ্যে ইলেকট্রনের ৯, ১৯২, ৬৩১, ৭৭০ বার দোলন সম্পূর্ণ হতে যে সময় লাগে, তাকে এক সেকেন্ড হিসাবে ধরা হবে।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স, সায়েন্স ফোকাস, টেড-ইডি ডটকম