তোমরা অনেকেই হয়তো অস্কারজয়ী বিখ্যাত অ্যানিমেটর হায়াও মিয়াজাকির কাজের সঙ্গে পরিচিত। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা ‘স্টুডিও জিবলি’(Studio Ghibli) থেকে তৈরি হয়েছে অসাধারণ সব অ্যানিমে। বিশ্বখ্যাত এই অ্যানিমেগুলোর কথা কমবেশি সবাই জানো নিশ্চয়ই। সচরাচর যেসব অ্যানিমে দেখতে পাই আমরা, তার চেয়ে সব সময়ই একটু ভিন্ন ধাঁচের হয়ে থাকে স্টুডিও জিবলির অ্যানিমেগুলো। বিস্ময়কর এই অ্যানিমেগুলো দেখতে দেখতে কখন যে অ্যানিমের চরিত্রগুলোকে নিজের অজান্তেই আমরা একসময় ভালোবেসে ফেলি, টেরও পাই না। তোতোরো, কিকি, হাকু, ক্যালসিফায়ার, হাউলসহ অন্যান্য চরিত্ররা হয়ে ওঠে আমাদের আপনজন। আজকে চলো মিয়াজাকি ও তাঁর স্টুডিও জিবলি নিয়েই গল্প করি।
অ্যানিমে কী, তা তোমরা ভালোই জানো। তা–ও একদম সহজ ভাষায় বলি, অ্যানিমে হচ্ছে জাপানিজ অ্যানিমেশন ফিল্ম। অ্যানিমে যে সব সময় এখনকার মতো একেবারে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল, তা বলা যাবে না। ক্রমাগত উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে অ্যানিমেশিল্পকে। আশির দশকে যখন অ্যানিমেশিল্প ক্রমাগত একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিল, ঠিক তখনই একটু ভিন্নধর্মী চিন্তা করেন হায়াও মিয়াজাকি ও ইসাও তাকাহাতা। দুজন মিলে নির্মাণ করেন নাউসিকা অব দ্য ভ্যালি অব দ্য উইন্ড। তখন মূলধারার অ্যানিমে মানেই ছিল একটু দ্রুতগতির গল্প, পর্দায় যথাসম্ভব উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার আর উচ্চমাত্রার আবহ সংগীত। স্টুডিও জিবলির অ্যানিমেগুলো ছিল ভিন্ন। ১৯৮৪ সালে নির্মিত নাউসিকা অব দ্য ভ্যালি অব দ্য উইন্ড-এ একটু ধীরগতির চিত্রনাট্য তৈরি করেন মিয়াজাকি আর তাকাহাতা। ফলে অ্যানিমে ধীরে ধীরে সব বয়সী মানুষের মন জয় করে নেয়। তা ছাড়া পর্দায় একটু হালকা ধরনের রং ব্যবহার করে তাঁরা নিয়ে আসেন বৈচিত্র্য। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি তারা আনেন আবহ সংগীতের ক্ষেত্রে। মনোমুগ্ধকর ও ভিন্ন ধরনের সুর-তার-লয়ের চমৎকার ব্যবহারে অন্যান্য অ্যানিমের চেয়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় এই অ্যানিমে। মিয়াজাকি ও তাকাহাতার সঙ্গে তোশিও সুজুকি মিলে ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করেন স্টুডিও জিবলি।
কিন্তু স্টুডিও নির্মাণের পর প্রথম দিকের কিছু অ্যানিমে আশাতীত সাফল্য না পাওয়ায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে নির্মাতাদের কপালে। শুরুতে স্বপ্নটা কিছুটা ধাক্কা খেলেও আশির দশকের একদম শেষ ভাগে মিয়াজাকি নির্মাণ করেন কিকিস ডেলিভারি সার্ভিস। ছোট্ট মেয়ে কিকির একদম নতুন এক শহরে একা একা মানিয়ে নেওয়া এবং জীবিকার প্রয়োজনে তার নিজের ডেলিভারি সার্ভিস খোলার গল্পটা মুহূর্তেই কেড়ে নেয় সব বয়সী দর্শকদের মন। ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই জিবলি অ্যানিমে পুরো অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রিকে আবার ঢেলে সাজানোর আলো দেখায়। তত দিনে অ্যানিমে অবশ্য জাপান ছাড়াও ভিসিডি ও ভিসিআরের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে। মিয়াজাকি বুঝতে পেরেছিলেন কীভাবে বিশ্বায়নের মাধ্যমে অন্যান্য দেশের দর্শকদের জাপানি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায়। তাঁর সৃজনশীল চিত্রনাট্য, দৃষ্টিনন্দন নির্মাণ ও আবহ সংগীতে ভিন্নতার পাশাপাশি বিশ্বখ্যাত ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর সহায়তায় সাবটাইটেল ও ডাবিংয়ের মাধ্যমে সারা বিশ্বেই জিবলি অ্যানিমে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
অ্যানিমেগুলোর মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারি মিয়াজাকির একটা স্বপ্নের পৃথিবী রয়েছে। মায়াঘেরা সে পৃথিবীটা আমাদের বর্তমান পৃথিবীতে অনেকটাই আলাদা। সে পৃথিবীতে মাইলের পর মাইল ঘন সবুজ বন, দূষণমুক্ত বাতাস ও নদী এবং জীবজন্তুর বিস্তীর্ণ পথচলা। তার সেই পৃথিবীতে নেই কোনো হিংসা-বিভেদ। মিয়াজাকি তাঁর এই মায়ার জগৎকে বারবার ফুটিয়ে তুলেছেন অ্যানিমের পর্দায়। প্রকৃতি যে আমাদের কত আপন, তা তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন মাই নেইবার তোতোরোতে। প্রিন্সেস মনোনোকে, ক্যাসল ইন দ্য স্কাইসহ প্রায় প্রতিটি অ্যানিমেতেই গুরুত্ব পেয়েছে প্রকৃতি ও তার প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো। প্রকৃতির ক্ষতি করলে যে প্রকৃতিও ছেড়ে কথা বলবে না, বিষয়টি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন মিয়াজাকি। প্রকৃতিপ্রেম ছাড়াও দেশাত্মবোধ, পারিবারিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও স্থান-কাল-পাত্রভেদে বন্ধুত্বের নানা গল্প ঘিরেই নির্মিত হয়েছে প্রতিটি অ্যানিমে। তা ছাড়া মানবজাতির ওপর যুদ্ধ যে সীমাহীন অশান্তি-দুঃখ-কষ্ট ছাড়া আর কিছুই বয়ে নিয়ে আসে না, তা–ও তিনি আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন অ্যানিমের মাধ্যমেই।
অন্যান্য অ্যানিমে যেখানে শুধু নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণির দর্শক বিশেষ করে টিনএজ ফ্যানবেজ ধরে রাখার চিন্তা করে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল, সেখানে মায়াজাকি তাঁর মায়ার জগতের মাধ্যমে সব ধরনের দর্শকের মন জয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। তিনি তাঁর প্রতিটি অ্যানিমেতেই ব্যবহার করতে থাকেন বিখ্যাত জাপানি সংগীতশিল্পীদের। তাঁদের মায়াবী সুরের পাশাপাশি আঁকার ক্ষেত্রেও তিনি নিজেও যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে গল্পের চরিত্র ও পার্শ্বচরিত্রদের সাজিয়েছেন। প্রতিটি দৃশ্যের ছোট ছোট বিষয়কেও যেন যথাসম্ভব অধিক গুরুত্বের সঙ্গে আঁকিবুঁকি করে তিনি অ্যানিমের পর্দায় নিয়ে এসেছেন। এসব চরিত্রের ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবেও তিনি নিয়েছেন জাপানের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীদের। শতবর্ষী পুরোনো অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রিকে একদম নতুন করে ঢেলে সাজানোর পেছনে যদি কাউকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়, তবে তা যেন স্টুডিও জিবলিরই প্রাপ্য।
শুধু নির্মাণশৈলী দিয়েই নয়, ব্যবসায়িক দিক দিয়েও স্টুডিও জিবলির সাফল্য অনেকখানি। জাপানের সর্বকালের সর্বাধিক ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের হিসাবটাই যদি ধরি, তবে সেরা ১০–এর মধ্যে ৩টিই জিবলির অ্যানিমে! তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু ব্যাপারে জিবলি যেন ছাড়িয়ে গিয়েছে নিজেদেরই। যার স্বীকৃতিস্বরূপ ৭৫তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ড তথা অস্কারে প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র অ্যানিমে হিসেবে ‘বেস্ট অ্যানিমেটেড ফিচার’ ফিল্মের পুরস্কার জেতে মিয়াজাকি নির্মিত স্পিরিটেড অ্যাওয়ে। এ ছাড়া আরও তিনবার অস্কার মনোনয়ন ছাড়াও সম্মানসূচক ‘গোল্ডেন বিয়ার’সহ শত শত পুরস্কার নিজেদের ঝুলিতে বুঝে নিয়েছে তারা।
মিয়াজাকি আর স্টুডিও জিবলি যেন একে অন্যের পরিপূরক। একজন সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের সৃজনশীলতার জন্যই যেন হয়ে উঠেছিলেন স্টুডিও জিবলির প্রাণপুরুষ। আশির দশকে জাপানের অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রিতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, তার অন্যতম কারিগর। তাই ১৯৮৫ সাল থেকে একটানা এক যুগ কাজের পর স্বেচ্ছায় অবসরে যান মিয়াজাকি। তারপর আবার ফিরে আসেন স্পিরিটেড অ্যাওয়ের মতো অস্কারজয়ী কাজ দিয়ে। তারপর আবার তিনি ২০১৩–তে অবসরে যান দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ও ১১টি অ্যানিমে নির্মাণের অভিজ্ঞতা নিয়ে। কিন্তু মিয়াজাকি মানেই যেখানে স্টুডিও জিবলি সেখানে কি তার বেশি দিন কাজ থেকে দূরে থাকা মানায়? তাই ২০১৭ সালে যখন নানা কারণে স্টুডিও জিবলি বন্ধ হয়েই যাবে যাবে করছে, তখন মিয়াজাকি ঘোষণা দিলেন, তাঁর সর্বশেষ অ্যানিমে হাউ ডু ইউ লিভ? নির্মাণের। যদিও ঘোষণার পর অনেক দিন হয়ে গেছে। তবু মিয়াজাকির কাজের ধরনটাই যে এমন! ধীরেসুস্থেই না হয় শেষবার আবার আমাদের সবাইকে নিয়ে যাবেন তাঁর মায়ার জগতে!