বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইফতারের জনপ্রিয় খাবার
সারা বিশ্বে রমজান মাসে মুসলমানরা একযোগে রোজা রাখেন। রোজার সময় একই নিয়ম মেনে রোজা রাখেন সবাই। কিন্তু ইফতারিতে সবার থালায় একই খাবার থাকে না। আবার একই অঞ্চলের সব মানুষ যে একই ধরনের খাবার পছন্দ করেন, সেটাও নয়। অনেকের ইফতারে থাকে ভিন্নতা। দেশ, এলাকা ও অঞ্চলেভেদে মুসলমানরা ইফতারিতে থালা সাজান ভিন্ন ভিন্ন খাবার দিয়ে, যা কিনা সে অঞ্চলের জনপ্রিয় খাবার। এসব খাবার নিছক খাবার নয়, ইফতারের মর্যাদা ও সেই দেশের সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও অংশে পরিণত হয়েছে। চলো দেখি আসি বিশ্বে কোন দেশের মুসলমানদের কোন খাবার ইফতারের ঐতিহ্য।
বাংলাদেশ
সাধারণত শুরু হয় খেজুর আর লেবুর শরবত দিয়ে। এ ছাড়া ছোলা ও মুড়ি তো ইফতারে থাকতেই হবে। সঙ্গে থাকে পেঁয়াজু, বেগুনি। থাকবে হালিম। অনেকে আবার খান খিচুড়ি, বিরিয়ানি। আবার কারও কারও পাতে থাকে বিভিন্ন রকমের কাবাব। জিলাপিও ইফতারির এক গুরুত্বপূর্ণ আইটেম।
আর্জেন্টিনা
ফুটবলের জাদুকর ম্যারাডোনা ও মেসির এ দেশটিতে বেশ কিছু মুসলমানের বাস। তাঁরা ইফতার শুরু করেন ইয়েরবা মাতে নামের এক ভেষজ পানীয় দিয়ে (একধরনের ভেষজ চা)। সেই সঙ্গে থাকে এমপান্দাস, যা মাংস বা সবজি দিয়ে বানানো পিঠা। সে দেশে ইফতারিতে জনপ্রিয় খাবার হলো বিফ আসাদো চিমিচিরি, যা হচ্ছে ভাজা গরুর মাংসের সঙ্গে ধনে পাতার সস। সঙ্গে থাকে দুলচে দে লেচ্চে প্যানকেক। এমন এক মিষ্টি, যা ক্যারামেল দিয়ে বানানো আর ওপরে থাকে তাজা ফল।
অস্ট্রেলিয়া
ইফতারে অস্ট্রেলীয় মুসলমানদের যে খাবার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, সেটা শুনলে একটু অবাক হতে হবে। সেটা হলো একধরনের মসুরের ডাল, যার নামই লেন্টিল স্যুপ। এর সঙ্গে থাকে হালাল স্ন্যাকস প্যাক, যা বানানো হয় ভেড়ার মাংস দিয়ে, যার ওপরে থাকে রসুন ও বারবিকিউ সস। থাকে মিষ্টি লেমিনংটন নামের স্পঞ্জ কেক আর কোর্ডিয়াল নামের ফল দিয়ে একধরনের খাবার।
বসনিয়া
বসনিয়ার মুসলমানরা ইফতারিতে সবার আগে মুখে দেন সোক অদ ড্রেঞ্জিনা। এটা চেরি দিয়ে বানানো জুস। থাকে মাখন আর পনির দিয়ে বানানো খাবার তোপা। পিটা ক্রোম পিরুসিয়া হচ্ছে ইফতারির মূল আইটেম। আলু, পেঁয়াজ ও মসলা দিয়ে মাখা একধরনের রুটি এটি। হুরমাসিকা নামের যে খাবারটি ইফতারিতে থাকবে, সেটা হলো চিনি, মাখন, ডিম ও ময়দা দিয়ে বানানো একধরনের মিষ্টি।
মিসর
মিসরীয়দের ইফতার শুরু হয় কামার আল দিন দিয়ে। এপ্রিকট বা খুবানি নামের এক ফলের শরবত এটি। সেই সঙ্গে থাকে কচি পাটের পাতা, রসুন, ধনিয়া ও মুরগির বুকের মাংস দিয়ে বানানো মোলাখিয়া নামের খাবার। থাকে কুনাফা নামের এক মিষ্টি, যার মধ্যে থাকে পনির ও বাদাম। আর আঙুর পাতায় সেদ্ধ করা পোলাওয়ের চাল, মাংস ও মসলার এক পাতুরি।
ভারত ও পাকিস্তান
এ দুটি দেশের মধ্যে মুসলমানদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জাতি রয়েছে। ভিন্নতা রয়েছে তাদের ইফতারেও। তবে দুটি দেশের মুসলমানদের মধ্যে ইফতারির আইটেমে বেশ কিছু খাবার একই। যেমন রুহ আফজা শরবত। সবজির বড়া, যাকে বলে পাকোড়া। সুজির হালুয়া, ঘুঘনি ছাড়াও থাকে বিভিন্ন ধরনের কাবাব। দুটি দেশের ইফতারিতে হালিম একটি অনিবার্য উপাদান। অনেকে আবার বিরিয়ানি পছন্দ করেন। এ ছাড়া জিলাপি ও দইবড়াও ইফতারিতে থাকে।
ইন্দোনেশিয়া
জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। এখানকার মুসলমানরা রোজা ভাঙে এস টিমুন সুরি শরবত দিয়ে। এটি নারকেলের পানি ও তরমুজ দিয়ে বানানো।
এরপর তারা খায় সবজি দিয়ে বানানো খাবার বাকওয়ান। ইফতারির প্রধান খাবার বুবুর। সুগন্ধি চালের সঙ্গে মুরগির মাংস, বাদাম ও মটরশুঁটি দিয়ে বানানো খাবার এটি। এ ছাড়া থাকে কোলাক পিসাং। এটা হলো নারকেলের পানি, চিনি দুধ ও কলা মিশিয়ে বানানো খাবার, যার মধ্যে থাকে পানডান পাতা।
মালয়েশিয়া
গোলাপজলের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে যে শরবত বানানো হয়, সেটা দিয়ে মালয়েশীয়দের ইফতার শুরু হয়। সেই সঙ্গে খান সায়ুর লোধা নামের সবজির স্যুপ। ইফতারের মূল খাবারটি হচ্ছে বিফ রেন্ডিনং। অনেকটা মাংসের বিরিয়ানি ভাবা যেতে পারে। সেরি মুকা নামের দুই রঙের মিষ্টি দিয়ে ইফতার সম্পন্ন হয় তাঁদের।
নাইজেরিয়া
জবা ফুলের পাপড়ি দিয়ে বানানো শরবত, নামও তার জবা—এটা নাইজেরিয়ার মুসলমানদের ইফতারের পানীয়। সেই সঙ্গে থাকে মোই মোই নামের পুডিং। ভাজা মুরগির সঙ্গে জোলাফ নামের পোলাও আর ফলের সালাদ।
ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিনের রোজাদাররা তামির হিন্দ নামের এক শরবত খান। নামটার মধ্যে রয়েছে হিন্দুস্তান ও তেঁতুলের কথা। এটা তেঁতুলের শরবত। এখানে ইফতারের এক জনপ্রিয় আইটেম টমেটো ও শসার সালাদ, যার নাম দাগগা। এর সঙ্গে থাকে মাকলুবাহ। এতে থাকে পোলাও, বেগুন, মাংস ও সবজি। আর থাকে কাতায়েভ নামের এক পিঠা, যা বাদাম ও চিজ দিয়ে বানানো।
তুরস্ক
শালগম আমাদের খুব পরিচিত সবজি। আর তুরস্কের লোকেরা শালগমের শরবত খেয়ে রোজা ভাঙেন। তুরস্কের রোজাদারদের ইফতারিতে থাকে কাচিক, দোলমা, মুহালেবি।
আমরা যেমন দইচিড়া খাই, তুরস্কের নাগরিকেরা তেমনি দইশসা খান। আর এটার নাম কাচিক। দোলমা শব্দটি বাংলা ভাষায় প্রচলিত। আর সেটা এসেছে তুরস্ক থেকে। আমরা খাই পটোলের দোলমা। আর তুর্কিরা খায় পোলাও, ভেষজ সবজি আর মাংসের দোলমা। দুধ, দারুচিনি আর বাদাম দিয়ে তৈরি মুহালেবি হচ্ছে তুরস্কের ইফতারির এক জনপ্রিয় মিষ্টি। যা একধরনের পুডিং।
ইরান
ইরানের মুসলমানদের প্রিয় পানীয় হচ্ছে গোলাপজল ও জাফরানের শরবত। সঙ্গে তাঁরা চা খান। সেই সঙ্গে ইফতারিতে খান এস রেসতে। এটাকে অনেকটা ইরানের নুডলস স্যুপ বলা যেতে পারে। আরও থাকে ঘেমেইয়ে। এটি টমেটোর সস, জাফরান দিয়ে ভাপানো মাংস, যার সঙ্গে থাকে পোলাও। মিষ্টি খাবারের মধ্যে থাকে সোলেজ জর্দ, মানে আমাদের মিষ্টি জর্দা। আরও দুটি খাবার ইরানের রোজাদারদের কাছে জনপ্রিয়, যা আমরাও খেয়ে থাকি। সেগুলো হলো হালিম ও জিলাপি।
সৌদি আরব
খেজুরের জন্য বিখ্যাত সৌদি আরবের ইফতার শুরু হয় খেজুর দিয়ে। এরপর তাঁরা পান করেন কাহওয়া। কাহওয়া শব্দটি আমাদের কাছে পরিচিত না হলেও একে আমরা চিনি। আমরা মজা করে দোকানে গিয়ে বা বাসায় যে কফি পান করি, সেই কফি শব্দটি এসেছে এই আরবি কাহওয়া থেকে। তবে আরবদের অনেকে কফির সঙ্গে জাফরান ও খেজুরের রস মিশিয়ে খান।
সৌদি আরবের ইফতারিতে থাকে সামবোসা, মানে সমুসা। মাদামসে নামের খাবার, যা কিনা তৈরি হয় ফাভা বিন দিয়ে। থাকে জারেশ, যা বানানো হয় মাংস ও ময়দা দিয়ে। সোরবা মানে ঝোল। মোতাব্বাক মানে মসলা, ডিম ও সবজি। কাবাস হচ্ছে মুরগি, ভেড়া অথবা সামুদ্রিক উপাদান দিয়ে তৈরি খাবার। আরও থাকে কাতায়েভ।
এসব খাবার ছাড়াও সেসব দেশ তো বটেই, অন্য অনেক দেশের মুসলমানরাও ইফতারিতে ভিন্ন ভিন্ন পদের খাবার খেয়ে থাকেন, যেগুলো কম মজাদার নয়।