পরিবারের সবাই চাইত কুদরাত-এ-খুদা কোরআনের হাফেজ হোক। এ জন্য তাঁকে ছোটবেলায় হাফেজি মাদ্রাসায় ভর্তি করা হলো। তাঁর এক চাচাতো ভাই কলকাতায় লেখাপড়া করতেন। তিনি গ্রীষ্মের ছুটিতে এসেছেন বাড়িতে বেড়াতে। তিনি কুদরাত-এ-খুদার জন্য নিয়েছেন বর্ণবোধ নামে একখানা আদর্শলিপির বই। এক পয়সা মোটে দাম ছিল সেই বইখানার।
একদিন সকালে সেই চাচাতো ভাই কুদরাত-এ-খুদাকে কাছে ডাকলেন। বইখানা মেলে ধরে কিছু পড়া দেখিয়ে দিলেন। বললেন, পড়াগুলো যেন ঠিক ঠিকভাবে করা হয়। কিন্তু দুপুর না হতেই দেখলেন কুদরাত-এ-খুদা পড়া বাদ দিয়ে খেলা করে বেড়াচ্ছেন। চাচাতো ভাই হেঁকে বললেন, ‘এই হতভাগা দৌড়ে বেড়াচ্ছিস যে পড়া হয়েছে?’
জবাবে কুদরাত-এ-খুদা বললেন, ‘হয়েছে।’
চাচাতো ভাই তাঁর কথা বিশ্বাস করলেন না। যাচাই করার জন্য তাঁকে বইটা আনতে বললেন। কিন্তু পড়া ধরার পর প্রমাণ হলো কুদরাত-এ-খুদা মিথ্যে বলেননি। ঠিক ঠিকই পড়াগুলো করে ফেলেছেন! চাচাতো ভাই তাঁর মেধার পরিচয় পেয়ে অবাক হলেন। তিনি কুদরাত-এ-খুদার বাবা-মাকে অনুরোধ করলেন তাঁকে যেন স্কুলে ভর্তি করানো হয়। তাঁর সেই অনুরোধ বৃথা গেল না। কুদরাত-এ-খুদাকে স্কুলে ভর্তি করানো হলো।
ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা জন্মেছিলেন অবিভক্ত বাংলার বীরভূম জেলার মাড়গ্রামে। ১৯০০ সালের ১ ডিসেম্বর। মাড়গ্রামসহ সেই বীরভূম জেলা এখন ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের অংশ। তাঁর বাবার নাম খোন্দকার আবদুল মুকিত। তিনিও উচ্চশিক্ষিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছিলেন আবদুল মুকিত। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের গোলামি করতে রাজি ছিলেন না। তাই চাকরি করেননি কখনো। আবদুল মুকিত খুব ধর্মভীরু ছিলেন। তিনি কলকাতার তালতলার এক পীরের মুরিদ ছিলেন। কুদরাত-এ-খুদা যেদিন জন্মালেন, সেদিন তিনি ওই পীরের দরগায় ছিলেন। সেই পীর সাহেবই ছেলের নাম রাখলেন মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা।
১৯০৯-১০ সালের দিকে কুদরাত-এ-খুদাকে কলকাতায় পাঠানো হলো। ভর্তি হলেন এমই স্কুলে। স্কলারশিপ নিয়ে এমই পাস করলেন তিনি। তারপর ভর্তি হলেন কলকাতার এক মাদ্রাসায়। ১৯১৮ সালে সেই মাদ্রাসা থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করলেন তিনি। এরপর ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। একটানা ছয় বছর সেখানে লেখাপড়া করলেন। ১৯২৫ সালে রসায়ন বিদ্যায় এমএসসি ডিগ্রি লাভ করলেন। দীর্ঘ ছয় বছরের কলেজজীবন খারাপ কাটেনি কুদরাত-এ-খুদার। এমএসসিতে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো এক শিক্ষক নাকি আরেকজনকে অবৈধভাবে কিছু নম্বর বেশি দিয়ে প্রথম করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সব জায়গায় তো ভালো-মন্দ দুরকম মানুষই থাকে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিবাদ করে তা হতে দিলেন না। ফলে কুদরাত-এ-খুদাই প্রথম হয়ে রইলেন।
সেকালে ভালো ফলাফল করলে বিদেশে পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি দেওয়া হতো। ঢাকা ও কলকাতা দুই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। দুটোই রাষ্ট্রীয় বৃত্তি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাড়িতে টেলিগ্রাম করে কুদরাত-এ-খুদাকে ডেকে আনলেন বৃত্তির জন্য। তিনি এলেন, কিন্তু তাঁকে বৃত্তি দেওয়া হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কুদরাত-এ-খুদার একজন পরিচিত শিক্ষক ছিলেন। আবদুর রহীম নাম তাঁর। তিনি এ কথা শুনে রেগে গেলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কুদরাত-এ-খুদার সব কাগজপত্র চেয়ে পাঠালেন। তিনি খতিয়ে দেখলেন বিষয়টা। শেষ পর্যন্ত কুদরাত-এ-খুদাকে বৃত্তি দেওয়া হলো। ডিএসসি করার জন্য বিলেতে চলে গেলেন তিনি। ভর্তি হলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ডিএসসি মানে ডক্টরেট অব সায়েন্স। কুদরাত-এ-খুদা থিসিস শুরু করলেন জে এফ থর্প নামের এক শিক্ষকের কাছে। থর্প প্রথম দিকে তাঁকে ভালো চোখে দেখতেন না। কারণ, তিনি কুদরাত-এ-খুদার শিক্ষক প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে পছন্দ করতেন না। তাই প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের যেসব ছাত্র থর্পের কাছে ডিএসসির জন্য যেতেন, তাঁদেরও তিনি অবহেলা করতেন। কুদরাত-এ-খুদাকেও অবহেলা করতে লাগলেন থর্প। অন্য ছাত্রদের তিনি থিসিসের বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতেন। কিন্তু কুদরাত-এ-খুদাকে নিজে বুঝে নিতে বলতেন। এটাই বরং আমাদের বিজ্ঞানীর জন্য ভালো হলো। নিজের মতো কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, তিনটি থিসিস লেখার মতো উপাত্ত জোগাড় করে ফেলেছেন। তিনটি থিসিস তিনি তৈরিও করে ফেললেন। তাঁর এই কাজ দেখে খুব খুশি হলেন থর্প।
আগের সেই অবহেলা আর রইল না। ১৯২৯ সালে ডিএসসি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এলেন কুদরাত-এ-খুদা। তিনিই তখন একমাত্র মুসলমান ডিএসসি ডিগ্রিধারী।
ডিএসসি লাভ করেও কুদরাত-এ-খুদাকে দুবছর বেকার থাকতে হলো। এরপর ১৯৩১ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পাঁচ বছর পরে তিনি রসায়ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হন।
১৯২৬ সাল। এ বছরই তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছাপা হয় লন্ডনের জার্নাল অব কেমিক্যাল সোসাইটিতে। ১৯২৯ সালে একই জার্নালে আরও একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯৩০ সালে চাকরি পাওয়ার আগেই কুদরাত-এ-খুদা স্টেরিও রসায়ন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রিতে মোট ১৪টি প্রবন্ধ ছাপা হয় তাঁর। তাঁর প্রকাশিত মোট গবেষণামূলক প্রবন্ধের সংখ্যা ১০২টি।
১৯৪২ সালে কুদরাত-এ-খুদা কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে আবার ফিরে আসেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। একবারে প্রিন্সিপাল হয়ে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়। কুদরাত-এ-খুদা কলকাতা ছেড়ে চলে আসেন ঢাকায়। যোগ দেন তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের জনশিক্ষা দপ্তরে পরিচালক পদে। তবে সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না। কারণ, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তিনি মানতে পারেননি।
লন্ডনের বিখ্যাত নেচার পত্রিকাতেও তাঁর দুটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছাপা হয়। তিনি রিং সিস্টেমের ওপর একটা তত্ত্ব দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রসায়নশাস্ত্রে তা স্থায়ী হয়নি। যাহোক, ১৯৫০ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান কুদরাত-এ-খুদা। চলে যান করাচিতে। কিন্তু সেখানে তিনি সুখে ছিলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের দেখতে পারত না। কুদরাত-এ-খুদার বাড়িতে রাতে ইটপাটকেল পড়ত।
১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন কুদরাত-এ-খুদা। ১৯৫৫ সালে তাঁকে পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারের পূর্বাঞ্চলীয় শাখার চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। এ সময় তিনি তেলাকুচা থেকে বারোটি জৈব রাসায়নিক উপাদান নিষ্কাশন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তা ছাড়া তুলসী, বিষকাঁটালি, গুলঞ্চ, কালমেঘ ইত্যাদি উদ্ভিদেরও জৈব উপাদান নিষ্কাশন করতে সক্ষম হন। এই গবেষণাগারেই তিনি পাটকাঠি নিয়ে নানা গবেষণা শুরু করেন। পাটকাঠি থেকে মণ্ড তৈরির ফর্মুলা আবিষ্কার করতে সক্ষম হন তিনি। পরে সেই মণ্ড থেকে কাগজ তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। পাটকাঠি এই মণ্ড থেকে পারটেক্স বা পার্টিকেল বোর্ড তৈরির ফর্মুলা তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন। পার্টিকেল বোর্ড আজ ব্যবহৃত হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে।
পাট, লবণ, কাঠ-কয়লা, মৃত্তিকা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ নিয়েও গবেষণা করেন কুদরাত-এ-খুদা। রস ও গুড় থেকে মল্ট ভিনেগার তৈরির ফর্মুলাও তাঁর আবিষ্কার। বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের ১৮টি আবিষ্কারের পেটেন্ট রাইট বা মেধাস্বত্ব রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি পাটসংক্রান্ত।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে। এই শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে আজও মাইলফলক হয়ে আছে। কুদরাত-এ-খুদা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। বিজ্ঞান লেখক হিসেবেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যুদ্ধোত্তর বাংলার কৃষি ও শিল্প নামের বইটি প্রকাশ করে বিশ্বভারতী। তাঁর বিজ্ঞানের সরস কাহিনী ও বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী নামে বই দুটি বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক ও মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে।
১৯৭৭ সালের ৪ অক্টোবর মহান এই বিজ্ঞানী, লেখক, সংগঠক ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।