চ্যাটজিপিটি ব্যবহারে কম শিখছে শিক্ষার্থীরা

কেউ কেউ ভাবতে পারে, চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়তো পড়াশোনায় অনেক সাহায্য করতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি একটা হাই স্কুলে যা ঘটেছে, তা চিন্তার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা তুরস্কের কিছু হাই স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা পরীক্ষা করেছেন। তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন, গণিত অনুশীলনের সময় চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করলে পরীক্ষার ফল ভালো হয় নাকি খারাপ?

গবেষকেরা এই পরীক্ষা চালানোর জন্য শিক্ষার্থীদের তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন। একদলকে অনুশীলনের সময় চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় দলকেও চ্যাটজিপিটি দেওয়া হয়েছে, তবে তারা সরাসরি এআইয়ের কাছে গণিতের সমাধান চাইতে পারেনি। মানে সরাসরি উত্তর না দিয়ে চ্যাটজিপিটি ইশারা-ইঙ্গিতে ওদের সাহায্য করেছে। অনেকটা একজন টিউটরের মতো। আর তৃতীয় দল কোনো এআইয়ের সাহায্য পায়নি। তারা নিজেরাই সমস্যাগুলো সমাধান করেছে।

পরীক্ষায় দেখা গেছে, যারা চ্যাটজিপিটির সাহায্য নিয়ে গণিত অনুশীলন করেছে, তারা তৃয়ীয় দলের চেয়ে ৪৮ শতাংশ বেশি অঙ্ক করতে পেরেছে। এটুকু শুনে মনে হতে পারে, চ্যাটজিপিটি শিক্ষার্থীদের দারুণ সাহায্য করেছে!

কিন্তু আসল চমকটা এলো পরীক্ষার রেজাল্টে। দেখা গেল, চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা শিক্ষার্থীরা একই বিষয়ের পরীক্ষায় ১৭ শতাংশ খারাপ রেজাল্ট করেছে! মানে, প্র্যাকটিসের সময় ভালো করলেও আসল পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে, আরেক দল শিক্ষার্থী যারা চ্যাটজিপিটির একটু অন্যরকম সংস্করণ ব্যবহার করেছিল, মানে যারা এআই থেকে সরাসরি সমাধান পায়নি, তারাও প্র্যাকটিসের সময় দারুণ ফল করেছিল! চ্যাটজিপিটি ছাড়া প্র্যাকটিস করা শিক্ষার্থীদের তুলনায় তারা ১২৭ শতাংশ বেশি অঙ্ক ঠিক করেছিল। 

কিন্তু পরীক্ষার পর দেখা গেল, এই এআই শিক্ষকের সাহায্য নেওয়া শিক্ষার্থীরাও অন্যদের চেয়ে ভালো ফল করতে পারেনি। যারা শুধু নিজেরাই অঙ্ক অনুশীলন করেছে, মানে কোনো ধরনের এআইয়ের সাহায্যে নেয়নি, তাদের পরীক্ষার ফল এদের মতোই ছিল। কিন্তু অনুশীলনের সময় কিন্তু এআইয়ের সাহায্য নেওয়া শিক্ষার্থীরা ১২৭ ভাগ বেশি অঙ্ক করেছিল। পরীক্ষা তা ধরে রাখতে পারেনি তারা। 

গবেষকরা এই গবেষণাপত্রের নামই দিয়েছেন ‘জেনারেটিভ এআই ক্যান হার্ম লার্নিং’ মানে এই শিখনের ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হতে পারে। তাঁরা বাবা-মা আর শিক্ষকদের পরিষ্কারভাবে জানাতে চেয়েছেন, এখনকার সহজে পাওয়া এআই চ্যাটবটগুলো শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় ক্ষতি করতে পারে। 

গবেষকদের ধারণা, এর প্রধান কারণ হতে পারে, শিক্ষার্থীরা নিজেরা চেষ্টা না করে চ্যাটবটের কাছে সরাসরি সমাধান চেয়েছে। নিজেদের অঙ্ক সমাধানের যে দক্ষতা, তা তারা তৈরি করতে পারেনি। 

তাছাড়া চ্যাটজিপিটি সবসময় সঠিক উত্তর দেয় না। পরীক্ষায় দেখা গেছে, চ্যাটবট প্রায় অর্ধেক সময় অঙ্কের ভুল উত্তর দিয়েছে। সরাসরি অঙ্ক ভুল করেছে ৮ শতাংশ। আর ধাপে ধাপে অঙ্ক করতে গিয়ে ভুল করেছে ৪২ শতাংশ সময়! তবে শিক্ষক-সদৃশ চ্যাটজিপিটিতে এই ভুলের পরিমাণ কম ছিল। 

এই গবেষণাটি এখনো কোনো জার্নালে প্রকাশিত হয়নি। তবে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এসএসআরএন নামে একটা ওয়েবসাইটে এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।

এটা শুধু একটা দেশের একদল শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা গবেষণা। এটা নিয়ে আরও গবেষণা করতে হবে। তবে এই পরীক্ষাটাও কিন্তু অনেক বড় ছিল। নবম থেকে একাদশ শ্রেণির প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী এতে অংশ নিয়েছিল। গবেষকরা সবাইকে একই ধরনের গণিতের চারটা আলাদা বিষয়ের ওপর অঙ্ক করতে দেন। শুরুতে ৯০ মিনিটের অনুশীলন সেশন চলে। তারপর হয় পরীক্ষা।

আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখা গিয়েছিল। পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে গবেষকেরা একটা জরিপ চালিয়েছিলেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা বলেছিল, চ্যাটজিপিটির কারণে তারা কম শিখেছে বলে তাদের মনে হয় না। কিন্তু বাস্তবে তাই হয়েছিল। এমনকি এআই শিক্ষকের সাহায্য নেওয়া শিক্ষার্থীরাও ভেবেছিল তারা অন্যদের চেয়ে ভালো করবে, কিন্তু তাদের ফলও তেমন ভালো ছিল না। বরং যারা এইআইয়ের সাহায্য না নিয়ে শুধু নিজেরা চেষ্টা করে অনুশীলন করেছে, তারাই পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো করেছে।

গবেষকরা চ্যাটজিপিটির সাহায্য নিয়ে শেখার বিষয়টাকে অটোপাইলটের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বিমানের চালকেরা সবসময় যদি অটোপাইলটে ভরসা করেন, তাহলে বিপদের সময় নিজ হাতে বিমান ওড়াতে গিয়ে ভুল হতে পারে। তাই নিয়ম করে চালকদের হাতে চালানো অভ্যাস বজায় রাখতে হয়। ঠিক তেমনি, পড়াশোনায় যদি আমরা এআইয়ের ওপর বেশি ভরসা করি, তাহলে নিজের শেখার ক্ষমতা কমে যেতে পারে।

তবে চ্যাটজিপিটিই প্রথম প্রযুক্তি নয় যা শিক্ষার ক্ষেত্রে সুবিধা আর অসুবিধা দুটোই নিয়ে এসেছে। টাইপরাইটার আর কম্পিউটারও হাতে লেখার প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দিয়েছে। ক্যালকুলেটর আমাদের গণনার অভ্যাস কমিয়েছে। আর এখন এআই আমাদের চিন্তার অভ্যাস কমিয়ে দিতে পারে। 

চ্যাটজিপিটি দিয়ে হয়তো একটা সমস্যার উত্তর মিলবে, কিন্তু যদি নিজেরা না ভাবি, তাহলে পরের সমস্যায় পড়তে হবে। আর সেটাই হবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি।

সূত্র: পপুলার সায়েন্স

আরও পড়ুন