বাড়িতে বিশাল চুরি। মায়ের গয়না, বোনের জমানো মাটির ভাঁড়, বাবার জমির দলিলের সঙ্গে দাদুর লাঠিটাও নেই। বাড়ির কাজের লোক, গণি মিয়া বেশ দুঃখী দুঃখী মনে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায়। পুলিশ এসে টুকটাক জিজ্ঞাসাবাদ করে চলে গেল। কেউ কিছু না বুঝলেও মনে মনে কিছু একটা ভাবছে বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য পিকু। ভেতরের ঘরে গিয়ে আলমারির হাতলটা দেখেই চোর সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ হয় তার। পাশের বাসার রিমনকে সঙ্গে নিয়ে সে নিজেই নামে এই অভিযানে। বোনের রুম থেকে কিছুটা পাউডার নিয়ে প্রথমেই আলমারির হাতলে ছড়িয়ে দেয় সে। আর রিমন ইতিমধ্যে গণি মিয়ার পানির গ্লাসটাকেও নিয়ে এসেছে। একটু পরেই ‘ধরে ফেলেছি, ধরে ফেলেছি’ চিৎকার করতে করতে দুজনেই রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এল। বলো তো ওরা কী দেখে চোরকে বুঝতে পারল? ঠিক ধরেছ। আঙুলের ছাপ দিয়ে চোর ধরার এই কায়দাকানুন কিন্তু আজকের নয়।
সেই মিসরীয় সভ্যতার সময় থেকেই অপরাধীদের আঙুলের ছাপ নিয়ে রাখা হতো পাথরের গায়ে। চারকোলের সেই ছাপ কিন্তু অপরাধীর পরিচয় নয়, বরং সাম্রাজ্যের ঘৃণিত ব্যক্তিদের নামের তালিকার পরিবর্তে জমা করে রাখা হতো আঙুলের ছাপগুলো। তা ছাড়া মিসরের বিভিন্ন সাম্রাজ্যে চুক্তি স্বাক্ষরেও দেখা মেলে সম্রাটদের আঙুলের ছাপের। ১৮৯৭ সালের দিকে কলকাতায় চালু করা হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো। এখানে কাজ করছিলেন আমাদের উপমহাদেশের আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বোস। সর্বোপরি তাঁদের সহযোগিতায় আঙুলের ছাপ বিভাজনের প্রথম পদ্ধতি ‘হেনরি ক্লাসিফিকেশন’ উদ্ভাবন করেন স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি।
সব মিলে গেলেও এক হবে না এই আঙুলের ছাপ। যমজেরা ছোট থেকেই বেড়ে ওঠে একই প্রকৃতির ডিএনএ নিয়ে। তাদের আঙুলের ছাপও কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতির। কোনো দুটি মানুষের আঙুলের ছাপ মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা ৬৪ মিলিয়নে একবার। তাই এই পরিচয় প্রতিটি মানুষের সবচেয়ে আপন পরিচয়।
আঙুলের ডগায় এই ছাপগুলো তৈরি হয় চামড়ার বিভিন্ন স্তরের কোষ মিলিয়ে। চমকপ্রদ বিষয় হলো মানুষের পায়ের ও হাতের এমন ঢালু কাটা দাগগুলো কিন্তু তৈরি হয় তার জন্মেরও তিন মাস আগে। মায়ের গর্ভে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি ও চারপাশের পরিবেশের ওপর নির্ভর করে এই ছাপগুলোর ভিন্নতার মাপকাঠি। এ ছাড়া ত্বকের মধ্য স্তরটিও একই সময়ে পরিপূর্ণ হতে শুরু করে। বাইরের স্তরটি গঠনের সময় ভেতরের স্তরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড় হয়। আর তারই ফলে আঙুলের মাথায় এমন উঁচু আকৃতি দেখা যায়।
আঙুলের ছাপের প্রাথমিকভাবে তিনটি গঠন লক্ষ করেন গবেষকেরা। এগুলো হলো আর্চ, লুপ ও হোর্ল। সাধারণত আর্চ বলতে যেসব আঙুলের ছাপের দাগগুলো আঙুলের মাথায় এসে সামান্য বেঁকে গেছে। লুপ গঠনে আবার দাগগুলো বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়ে আঙুলের ডগা থেকে চারদিকে। আর হোর্ল গঠনের ক্ষেত্রে একেবারে মধ্য বিন্দু থেকে ক্রমান্বয়ে বড় বড় বৃত্তে সেজে ওঠে গোটা ছাপটি। সাধারণভাবে এমন গঠন দেখা গেলেও এগুলোর মিশ্রণেই আরও জটিল ও ভিন্নতর আঙুলের ছাপের নজির মেলে এই সামান্য আঙুলের ডগায়। পরের পৃষ্ঠার ছবিতে বিষয়টি বিস্তারিত তুমি বুঝতে পারবে।
তাই আঙুলের ছাপকে আরও ভালোভাবে চিনতে চাইলে পড়াশোনা করতে হবে Dactyloscopy নিয়ে। Dactylo-এর অর্থ আঙুল বা পায়ের পাতা আর scopy অর্থ পর্যবেক্ষণ করা। অর্থাৎ Dactyloscopy-এর অর্থ দাঁড়ায় আঙুল বা পায়ের পাতার বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করা। আঙুলের ছাপের মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত করার এই গোটা বিষয়কে কেন্দ্র করে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যাত্রা শুরু করে ফরেনসিক বিজ্ঞান। আর্জেন্টিনার বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা জুয়ান ভুসেনটিক প্রথমবারের মতো অপরাধী শনাক্ত করার কাজে আঙুলের ছাপের ব্যবহার চালু করেন। তাঁর তৈরি করা ভুসেনটিক পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনিই প্রথমবার ভিন্ন ভিন্নভাবে অপরাধীদের আঙুলের ছাপ সংরক্ষণে সফল হন। তবে আঙুলের ছাপের আগে প্রায় তিন দশক যাবৎ ফ্রেঞ্চ পুলিশ ও গবেষক অ্যালফোনস বার্টিলনের উদ্ভাবিত পদ্ধতিই ব্যবহার করা হচ্ছিল অপরাধীদের তথ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে। বার্টিলন পদ্ধতিতে অপরাধীর দেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ হাড়ের মাপের তথ্য সংগ্রহ করা হতো।
এই আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করা কিন্তু আরেক মুশকিল কাজ। সাধারণভাবে ভিন্ন ভিন্ন আলো (বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের) ব্যবহার করে ছাপগুলো দেখা যায়। তবে স্টীম সুপারগ্লু নামের আরেকটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন গবেষকেরা। এমন কোনো বস্তু, যেটা স্পর্শ করা যাবে সহজে, সেটিকে বাষ্পীভূত সুপারগ্লুর একটি বিশেষ চেম্বারে রাখা হয়। কিছু সময় পরে আঙুলের ছাপ বরাবর ওই গ্লু এঁটে গিয়ে ছাপটি ফুটে ওঠে। আবার নাইনহাইড্রিন, অ্যামাইনো অ্যাসিড আর অজৈব লবণের মিশ্রণ কাজে লাগিয়ে সংগ্রহ করা যায় আঙুলের ছাপ। ডায়াজোফ্লুরেন-৯-ওয়ান নামের আরেক যৌগ ছাপের ওপর ছড়িয়ে নীল-সবুজাভ আলো দিলেই দেখা যায় ছাপ। এ ছাড়া গবেষণাগারে আরও নানা রকম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় এই জটিল আঙুলের ছাপ সংগ্রহের জন্য।
তবে ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারের কাজ করার পদ্ধতি কিন্তু একটু আলাদা। আমরা যখন স্ক্যানারগুলোতে আঙুল রাখি, তখন এটি আমাদের আঙুলের ডগায় ওই দাগকাটা ভাঁজে রক্ত চলাচলের পথ বুঝতে পারে। কারণ, রক্তের এই দাগগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে রক্তপ্রবাহ এগোয়, তথা ওই স্থানের তাপের পরিবর্তন ঘটে। আর স্ক্যানারটি সেই তথ্যের ভিত্তিতেই তৈরি করে নেয় আঙুলের ছাপের একটি ডিজিটাল অনুলিপি। এ ছাড়া সিমস সেন্সর ব্যবহার করে আঙুলের ডগার বিভিন্ন প্রান্তের আলোকপ্রাপ্যতার হিসাব করে কম্পিউটার তৈরি করে আঙুলের ছাপ। অন্যদিকে ক্যাপাটিভ স্ক্যানারের সাহায্যে আঙুলের বিভিন্ন প্রান্তের অবস্থান বুঝে কম্পিউটার ছাপের ছবি তৈরি করতে পারে। এসব তথ্য একটি কোডার যন্ত্রের মাধ্যমে বদলে ফেলা হয় ডিজিটাল তথ্যে।
আঙুলের ছাপের চোর ধরার গল্প তো অনেক হলো। তবে তোমার যদি সেটাই না থাকে? যাহ্, তা আবার হয় নাকি? হয় বৈকি। মানুষের ডিএনএর তিন ধরনের সমস্যার কারণে তাদের আঙুলের ছাপ সৃষ্টিতে সমস্যা হয়। সেগুলো হলো Naegeli-Franceschetti-Jadassohn syndrome (NFJS), Dermatopathia pigmentosa reticularis (DPR) এবং Adermatoglyphia। প্রথম দুটির কারণে হাত-পায়ের ত্বক মাত্রাতিরিক্ত শক্ত বা নরম হয়। ফলে ত্বকে দাগ থাকলেও সেগুলো ছাপ সৃষ্টি করতে পারে না। এ-জাতীয় রোগের রোগীদের ঘাম ও রক্ত পরিবহনেও বিশেষ অসুবিধা হয়। অন্যদিকে, Adermatopathia রোগ হলে আঙুলের ডগায় কোনো রকম দাগই থাকে না।
তবে আমাদের মতোই প্রাণিজগতের আরেকজনেরও কিন্তু রয়েছে আঙুলের ছাপ। কোয়ালা ভালুকদের গাছে গাছে থাকার ফলে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ওদের আঙুলেও মানুষের মতো ছাপ রয়েছে। সেটা এমনই কাছাকাছি যে গবেষকদের কোয়ালা আর মানুষের আঙুলের ছাপ আলাদা করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। তবে আজ পর্যন্ত কেউ তার অপরাধের দায় ঘুমপ্রিয় এই প্রাণীটিকে দেয়নি।