এভাবেও পুরান ঢাকায় ঘোরা যায়

‘আই হ্যাভ ডলার। ক্যান্ট কনভার্ট। ড্রিংক মি টি প্লিজ।’

সন্দেহের দৃষ্টিতে নিজেকে সাবেক রাষ্ট্রদূত পরিচয় দেওয়া লোকটির দিকে তাকালাম। তাঁর চোখে চশমা, কিন্তু একটা ডাঁট ভাঙা। পরনে শার্ট-লুঙ্গি। পাশ থেকে চা-বিক্রেতা বললেন, ‘আজ সেই কখন থেইকা এই লোক জ্বালাইতেছে সবাইরে। মনে হয় মেন্টাল।’ সেটাই মনে হলো। লোকটাকে অপ্রকৃতস্থই লাগছে।

আমি এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি ওয়ারীতে। পুরান ঢাকায় ঘুরে বেড়াবার পরিকল্পনা আজ। শুরুটা হবে বলধা গার্ডেন দিয়ে। সকাল নয়টার মধ্যে সবার চলে আসার কথা। নাফি আর আমি অবশ্য একটু আগেভাগেই উপস্থিত। বাকিদের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে টঙের দোকানে দাঁড়িয়েছিলাম। এর মধ্যে আচমকা ‘রাষ্ট্রদূত’-এর আবির্ভাব! অজস্র প্রশ্ন করলেন আমাদের। পাশাপাশি দিলেন অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি করার তথ্য। চায়ের পর এবার তার আবদার সিগারেটের।

‘দেখুন, ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমরা এটা কেনা সমর্থন করি না।’ আপত্তি জানালাম। এতক্ষণ হেসে হেসে কথা বলা লোকটির চেহারা হঠাৎ কঠিন হয়ে উঠতে শুরু করল। ঝামেলা হতে পারে। বলধা গার্ডেনের দিকে পা বাড়াব কি না, ভাবছি। কিন্তু অবাক করে দিয়ে ‘রাষ্ট্রদূত’ বলে উঠলেন, ‘নাইস টু মিট ইউ।’

আরও পড়ুন

বলধা গার্ডেনে আরণ্যক

এত এত পাখির কিচিরমিচির আমি আগে কখনো শুনিনি। ভোর হওয়ার আগে বৃষ্টি হয়েছে একদফা। অন্য রকম একটা ঘ্রাণও পাওয়া যাচ্ছে এর ফলে। মূল ফটক থেকে কিছুদূর আগাতেই চোখে পড়ল একটা বাঁধানো পুকুর। তার সামনে ব্যায়াম করছেন একদল প্রবীণ। তাঁদের বিপরীতেই পেলাম লাল রঙের সূর্যঘড়ি। এটা থেকে কী করে সময় বুঝতে হয়, তা জানা লাগবে। আকাশে অবশ্য মেঘ। আজ কৌতূহল মিটবে কি না, কে জানে!

অসংখ্য ফুল, পাতা, গাছ চোখে পড়ছে। দূর থেকে দেখা গেল, জলাধারে ঢাউস সাইজের পাতা ভাসছে।

বাকিরাও বোধ হয় এতক্ষণে চলে এসেছেন। ‘বোধ হয়’ বলতে হচ্ছে। কারণ, এখানে প্রায় কেউই কাউকে চিনি না। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করার প্রতিষ্ঠান ‘হেরিটেজ ওয়াক ঢাকা’র ফেসবুক ইভেন্ট দেখে এসেছি সবাই। প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র সজীব বর্মণ জানান, ‘এই নগরীর ঐতিহ্যের অনেক কিছুই আমাদের অজানা। আজ আমরা হাঁটতে হাঁটতে গল্প-আড্ডার মধ্য দিয়ে ঢাকাকে দেখব নিজেদের মতো করে। এর আগে চলুন পরিচিত হওয়া যাক।’

দেখা গেল নানা ঘরানার সতেরো জন জড়ো হয়েছি। কেউ আইন পেশায় আছেন, গান আর লেখালেখি নিয়ে আছেন কেউ। ফোকলোর রিসার্চার যেমন পাওয়া গেল, তেমনি উপস্থিতির কথা জানান দিলেন একজন ব্যাংকার। এসেছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, স্থপতি, বিসিএস কর্মকর্তাও।

আরও পড়ুন

হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। সজীব বর্মণ জানান, জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ৩ দশমিক ৩৮ একর জায়গার ওপর এই বাগান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সময়টা ১৯০৯ সাল। এ বাগানের দুটি অংশ—সিবলি ও সাইকি। সিবলি অংশটি সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে সাইকি অংশের জন্য প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।

অসংখ্য ফুল, পাতা, গাছ চোখে পড়ছে। দূর থেকে দেখা গেল, জলাধারে ঢাউস সাইজের পাতা ভাসছে। ভালো করে দেখতে এগিয়ে গেলাম। কাদা হয়ে আছে জায়গাটা। পিছলে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তাই পা ফেলতে হচ্ছে সাবধানে। কাছে গিয়ে মনে হলো সেই পাতা আকৃতিতে ডালার মতো। নাম অ্যামাজন লিলি। আরও অনেক প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদের কথা জানা গেল। ভূর্জপত্র, ক্যামেলিয়া, স্বর্ণ অশোক, আফ্রিকান টিউলিপ—বাহারি নাম সেসবের।

ওখান থেকে বেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিতে হলো। পুকুরের অপর পাশ শেষ হয়েছে সেখানে। ঘাটের ওপর দাঁড়িয়ে আছে জয় হাউস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি লিখেছিলেন এখানে বসেই। দু-তিনজন ঘাট পেরিয়ে পুকুরের কাছাকাছি চলে গেলেন। মাছের চলাচল সেখানে স্পষ্ট। কুয়েটের শিক্ষার্থী আতিক ক্যামেরা রেখে নোটবুকে স্কেচ করতে তুলে নিলেন পেনসিল।

আরও পড়ুন

ক্রিশ্চিয়ান সিমেট্রিতে এপিটাফ

এ অংশের কবরগুলো অনেক আগের। ব্রিটিশ উপনিবেশের আগে নানা দেশের বণিকেরা আসতেন।

পরবর্তী গন্তব্য নারিন্দার খ্রিষ্টান কবরস্থান। প্রবেশদ্বার পেরোতেই বুকটা ধক করে উঠল। খুবই ছোটো আকৃতির একটা কবর। কোনো নবজাতকের হয়তো।

এ অংশের কবরগুলো অনেক আগের। ব্রিটিশ উপনিবেশের আগে নানা দেশের বণিকেরা আসতেন। গাইডের ভূমিকায় থাকা সজীব বর্মণ দুটো কবরের মাঝখানে নির্দেশ করে বললেন, এখানে সমাহিত আছেন জিনেট ভ্যান তাসেল। এটি যে একটি কবর, প্রথম দেখাতে তা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু ভালো করে খেয়াল করলে স্পষ্ট হয়।

অবহেলার শিকার হওয়া এই ভ্যান তাসেল কে? সবার চোখেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। সহযোগী সাদিয়া আক্তারের কাছ থেকে একটি লেমিনেটিং করা কাগজ নিলেন সজীব। সেটি দুটো ছবি আর একটি পেপার কাটিংয়ের কোলাজ। ছবিতে একজন নারীকে দেখা গেল। বুঝতে অসুবিধা হলো না, তিনিই কেন্দ্রীয় চরিত্র।

দেয়ালে ঝুলছে তখন ১৮৯২ সালের ক্যালেন্ডার। বেলুন তখন বিশ্বজুড়ে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। বিশাল আকৃতির বেলুন ওড়ানো হচ্ছে। তাতে চড়ে বসে ভেসে বেড়াচ্ছেন দুঃসাহসীরা। বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মাধ্যমে মনুষ্যবাহী বেলুন প্রদর্শনীর আয়োজন চলছে কলকাতাতেও। নবাব আহসানউল্লাহ ঢাকায় সে রকম একটি প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিলেন। আমন্ত্রণ জানালেন জিনেট ও তাঁর স্বামী পার্ক এ ভ্যান তাসেলকে। তাঁরা রাজি হলেন। দিনক্ষণ ঠিক করে চলল প্রচারণা। নির্ধারিত দিনে আহসান মঞ্জিলের প্রাঙ্গণ, ছাদ ও বুড়িগঙ্গার দুই ধারের দালানগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল।

আরও পড়ুন

বিকেলের দিকে বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে জিনেট তাঁর যাত্রা শুরু করলেন। বেলুন তাঁকে ভাসিয়ে নিল ছয় হাজার ফুট উঁচুতে। ততক্ষণে নদীর এপারে চলে এসেছেন তিনি। প্যারাসুট মেলে দিলেন নামার জন্য। কিন্তু হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া তাঁকে নিয়ে গেল শাহবাগে। নবাবদের সেখানকার বাগানবাড়ির উঁচু ঝাউগাছে আটকে গেল সেটি। জিনেট ঝুলতে থাকলেন মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে। তাঁকে উদ্ধার করতে বাঁশ বাঁধা হলো। কিন্তু বিপত্তি বাধল নেমে আসার সময়। মাঝপথে খুলে গেল বাঁশের বাঁধন। জিনেট মাটিতে আছড়ে পড়লেন নির্মমভাবে। মারাত্মক আহত অবস্থায় মারা গেলেন দুই দিন পর। সেই থেকে জিনেটের নামলিপিহীন কবর পড়ে আছে অযত্ন অবহেলায়। ব্যাপক গবেষণা ও অনুসন্ধানের পর তাঁর কবর খুঁজে বের করেছিলেন শামীম আমিনুর রহমান।

এর মধ্যেই দূর থেকে চোখে পড়ল অন্য রকম স্থাপনা—কলম্বো সাহেবের কবর

অচেনা ভিনদেশির প্রতি সমবেদনা নিয়ে আমরা পা বাড়াই। চারদিকে গাছপালা, ঘাস, নির্জনতা। মশাও আছে অবশ্য। দেখি, সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার গণকবর। শতাব্দীপ্রাচীন কবর থেকে সাম্প্রতিক কবরের সারি শুরু হয়। তফাত করা যায় এপিটাফ ও স্তম্ভের ধরন দেখে। এর মধ্যেই দূর থেকে চোখে পড়ল অন্য রকম স্থাপনা—কলম্বো সাহেবের কবর। বেশ উঁচু এই সমাধিস্তম্ভের চারপাশে চারটি প্রবেশদ্বার। সমাধির একদম ওপরে গম্বুজ আচ্ছাদিত আট কোনা বরুজও দেখা গেল। দেয়ালে আছে শিলালিপি। বিমগুলোতেও নকশা করা।

জোহান জোফানির ১৭৮৬ সালে আঁকা নাগাপন ঘাটের অনুলিপি দেখালেন সজীব। কলম্বো সাহেবের সমাধি দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে আছে চিত্রকর্মটিতে। সজীব জানান, একটি বিশাল বটগাছ এই সমাধিস্তম্ভকে ঘিরে রেখেছিল। সেটিকে কাটা হয়েছে।

আরও পড়ুন

সুলতানি আমলের মসজিদ

চা-শিঙাড়া খেয়ে বিনত বিবির মসজিদ দেখতে এলাম আমরা। ১৪৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার প্রাচীনতম এই মসজিদ সিরামিকের টুকরা দিয়ে অলংকৃত। চারপাশের বহুতল ভবনের দাপটে মসজিদটিকে দূর থেকে দেখা দুষ্কর। একতলা মসজিদটি ভালোভাবে দেখতে পাশের একটি দালানের ছাদে উঠতে হলো। চোখে পড়ল চার কোনায় চারটি সরু মিনার, দুটি গম্বুজ। পুরোনো মসজিদের পাশে তৈরি করা হয়েছে ছয়তলা নতুন ভবন।

কখনো মুগ্ধতা, কখনো হতাশা

ব্যবসায়ী ও সমাজসংস্কারক রেবতী মোহন দাসের বাড়ির ব্যাপারটা আরেকটু দুঃখজনক
ছবি : আতিকুর রহমান

সাধারণ, তিল, পনির—তিন ধরনের বাকরখানির স্বাদ নেওয়ার পর পথচলা শুরু হলো আবারও। অপলক বিস্ময় নিয়ে আমরা হাঁটছি। অচেনা নস্টালজিয়া ভর করেছে যেন। কিছুক্ষণ পরপরই অবশ্য মুগ্ধতার জায়গায় জেঁকে বসছে হতাশা। স্থাপনাগুলোর বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে। চলছে দখলের উৎসব।

ব্যবসায়ী ও সমাজসংস্কারক রেবতী মোহন দাসের বাড়ির ব্যাপারটা আরেকটু দুঃখজনক। এটিকে অনেকে চেনে সূত্রাপুর জমিদারবাড়ি হিসেবে। প্রধান ফটক পেরুলেই দেখা যায়, দীর্ঘ কোরিন্থিয়ান কলামের স্থাপনা। বাড়িটির হলঘরে নাকি বেশ কিছু তৈলচিত্রও ছিল। কিন্তু সেসবের আর কোনো হদিস নেই। বরং এটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের কার্যালয় হিসেবে!

আরও পড়ুন

একই রকম দৃশ্য দেখা গেল ফরাশগঞ্জের বড়বাড়িতে গিয়ে। নিচে ফার্নিচার তৈরির কারখানা। ওপরের একটা অংশে মানুষ থাকছে। অন্য অংশটি রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। ঐতিহ্যের এত নিদর্শনের সংরক্ষণ নিয়ে উদাসীনতা স্পষ্ট। আবার সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে সতর্কতাও জরুরি। এসব প্রসঙ্গে আমরা আলাপে মশগুল হলাম শান্তিগ্রামে। এটি বিস্কুট ফ্যাক্টরির অরিজিনেটর আবিরের ‘আস্তানা’। আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট নিয়ে কাজ করেন তিনি। সেই সকাল থেকে হাঁটতে থাকায় আমরা প্রত্যেকেই ক্লান্ত। মধু লেমনেড খেতে খেতে তাই একটু জিরিয়ে নেওয়া।

যবনিকার আগে

ভাওয়াল স্টেটের ধ্বংসাবশেষ, রূপলাল হাউজ, প্রাণ বল্লভ জিউ মন্দির, নর্থব্রুক হল পেরিয়ে আমরা এলাম বিউটি বোর্ডিংয়ে। শামসুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, নিতুন কুণ্ড, ফজলে লোহানী, কাইয়ুম চৌধুরীর মতো সাহিত্য-সংস্কৃতির দিকপালেরা আড্ডা দিতেন এখানে। নিচতলায় খাবারের ব্যবস্থা আছে। দ্বিতীয় তলায় অবশ্য যাওয়া গেল না। কর্তৃপক্ষ বললেন সংস্কারের জন্য বন্ধ আপাতত।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার মুহূর্ত। সবার মধ্যে দারুণ একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল এতক্ষণে। এখন বিদায়ের পালা। কেউ কেউ বাসার পথ ধরবেন। আর কয়েকজন উঁকি দেবেন শাঁখারীবাজার। সবাই একটা গ্রুপ ফটো তুললাম শেষবারের মতো।

বাসায় ফেরার রুট সাজাতে কাশ্মীরি বিরিয়ানি হাউসে বসে পড়লাম। এখান থেকে রিকশায় করে প্রথমে সচিবালয় মেট্রোরেল স্টেশনে যাওয়া যেতে পারে। সেখান থেকে কারওয়ান বাজার স্টেশন। বাকিটা পথ হেঁটেই যাওয়া যাবে। হঠাৎ খেয়াল হলো, ইতিহাসের অলিগলি থেকে ঘুরে এসে আধুনিক সময়ের যানবাহনে চড়ে বসতে যাচ্ছি। একটু অদ্ভুতই লাগল। জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘পিরামিড’ হয়তো এখানে প্রাসঙ্গিক—

—বেলা বয়ে যায়!

গোধূলির মেঘ-সীমানায়

ধূম্র মৌন সাঁঝে

নিত্য নব দিবসের মৃত্যুঘণ্টা বাজে!

শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভষ্মবহ্নি জ্বলে!

পান্থ ম্লান চিতার কবলে

একে একে ডুবে যায় দেশ, জাতি,—সংসার সমাজ,

কার লাগি হে সমাধি, তুমি একা বসে আছ আজ

আরও পড়ুন