আবার চাই নিরাপদ সড়ক

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠন হয় ৮ আগস্ট। এর মাঝখানে দেশে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বল্প উপস্থিতির কারণে কিছু মানুষ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চেষ্টা করে। গণভবন, সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন এলাকায় অরাজকতা তৈরি হয়। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতি সামলাতে দায়িত্ব পালন করে শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে কেউ সড়ক সামলায়, কেউ গণভবন ও সংসদ ভবন পরিস্কারে অংশ নেয়। নিরাপত্তা দিতে এলাকায় এলাকায় পাহারার কাজ করে অনেকে। সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে কেউ দেয়াললিখন করে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকা পরিস্কার করাসহ সড়ক বিভাজকে গাছও লাগিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এ সব কাজে অংশ নেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছে আমরা জানতে চেয়েছি তাদের অভিজ্ঞতা ও অংশগ্রহণ নিয়ে। আজ থাকছে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম নিয়ে লেখা। আসহাবিল ইয়ামিনের গ্রন্থনায় বিস্তারিত।

আমরা যখন ২০১৮ সালে আন্দোলন করেছিলাম, তখন আমাদের মূল দাবি ছিল ‘নিরাপদ সড়ক চাই’। ২০১৪ সালের গণ-আন্দোলনের পর বেশ কিছুদিন রাস্তায় ছিলেন না ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। শৃঙ্খলা ফেরাতে রাস্তায় নেমেছিলাম আমরা। যানজটের এই ঢাকা শহরে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা তাঁদের হাতের নির্দেশনার মাধ্যমে রাস্তার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতেন। যখন ট্রাফিক পুলিশ ছিল না, তখন ট্রাফিক মানছিল না কেউই। কোনো ডান-বাম নেই, কোনো সিগন্যাল নেই, কোনো আইন নেই। আর অনেক জায়গায় তো কোনটা রাস্তা আর কোনটা ফুটপাত, তা বোঝাও মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থা দেখে আমরা শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদেরই রাস্তায় নামতে হবে। শুরুতে অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিলাম কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিগন্যালে। যখন এটা ফেসবুক ও অন্যান্য গণমাধ্যমে ভাইরাল হলো, তখন আমাদের সঙ্গে অনেক শিক্ষার্থী এসে যুক্ত হলো। আমি ট্রাফিক সামলানোর দায়িত্বে ছিলাম ধানমন্ডি ও এর আশপাশের এলাকায়।

আমি ও আমার কিছু বন্ধু এবং সিনিয়রসহ মোট আট-নয়জন মিলে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ছিলাম। পরে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও ২০–২৫ জন শিক্ষার্থী। পরে দেখা গেল, এত শিক্ষার্থী এসেছে যে গাড়ির চেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। তখন আমরা সবাই মিলে কে কোথায় দাঁড়াবে, কে কোন লেন দেখবে, কোন লেন দিয়ে মোটরসাইকেল যাবে, কোন লেন দিয়ে রিকশা যাবে, কোন লেন দিয়ে বড় গাড়ি যাবে, তা ঠিক করলাম। শুধু একটি লেন রাখলাম অ্যাম্বুলেন্স এবং জরুরি যানবাহনগুলোর জন্য। যানবাহনগুলো নিয়ম মেনে যাচ্ছে কি না, তা দেখছিল কয়েকজন। এমন অনেক চালককে আমরা থামিয়েছি, যাদের বয়স ১৮ বছরের কম। কারও কারও গাড়ির লাইসেন্স বা ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। হেলমেট ছাড়াই মোটরসাইকেল চালাচ্ছে অনেকে। মোটরসাইকেলে দুজনের যাওয়ার কথা, অথচ যাচ্ছে তিনজন। আর যেহেতু অনেকেই আইন অমান্য করছিল আমাদের বয়সী যারা, তাদের শাস্তি হিসেবে আমাদের সঙ্গে কাজে লাগিয়েছিলাম। কিছু গাড়ি সন্দেহ হলে সেগুলো আটকে তল্লাশি করেছি আমরা। মোহাম্মদপুরের বাসস্ট্যান্ডে একটা গাড়ি থেকে প্রায় ৩৩ লাখ টাকা পাই আমরা। সঙ্গে সঙ্গে তা জানাই সেনাবাহিনীকে। তারা এসে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নিলেন।

আরও পড়ুন

আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল সবাই যেন নিয়ম মেনে চলে আর ট্রাফিক জ্যাম যেন না লাগে। শুরুর দিকে রাস্তায় গাড়ি ছিল কম, রাস্তায় খুব একটা ঝামেলা হয়নি। পরে আস্তে আস্তে যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করল, তখন অনেক বেশি গাড়ি রাস্তায় ছিল। সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের একটু বেগ পেতে হয়েছে। তবে চেষ্টা করেছি যেন কোনো দুর্ঘটনা কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে। সবাই নিয়ম মেনেই যাচ্ছিল। কিন্তু মূল ঝামেলাটা করছিল অটোরিকশাচালক, বাসচালক আর সিএনজিচালক। তারা কিছুতেই নিয়ম মানতে রাজি না।

শুরু থেকে সবাই আমাদের পাশে ছিল। যেহেতু আমরা শিক্ষার্থী, সারা দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, অনেকেই আমাদের পাশে ছিলেন। পানি, ছাতা, ক্যাপ, খাবার দিয়েই সাহায্য করেছেন আমাদের। দিনশেষে যখন বাসায় ফিরতাম, চেহারার অবস্থা দেখে অভিভাবকেরা একটু রাগারাগি করতেন। তারপরও আবার পরদিন যেতেও দিত। আশা করি, শিগগিরই রাস্তা নিরাপদ হবে আবার।

লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বাদশ শ্রেণি, সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা

আরও পড়ুন