স্টিফেন হকিং চোখের পাতাও ফেলতে পারতেন না, কিন্তু বই লিখতেন
১৪ মার্চ পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যুদিন। ২০১৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ৭৬ বছর বয়সে। কিন্তু ২১ বছর বয়সেই তাঁর মারাত্মক অসুখ ধরা পড়ে। যে অসুখের চিকিৎসা নেই এবং যার পরিণতি মৃত্যু। ৫৫ বছর ধরে সেই রোগ নিয়েই তিনি কেবল বেঁচেছিলেন তা–ই নয়, একপর্যায়ে কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর, শরীরের কোনো অংশ নড়াচড়া করতে পারতেন না, এ অবস্থাতেই তিনি বই লিখতেন, সভা-সেমিনারে যোগ দিতেন।
স্টিফেন হকিং পৃথিবীর সেরা মহাকাশবিজ্ঞানীদের একজন, যাঁর লেখা ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের একটা। তিনি ‘ব্ল্যাক হোলস অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ বইয়ে তাঁর অসুস্থতার গল্প, শৈশবের গল্প আর ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ লেখার গল্প আমাদের শুনিয়েছেন। ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেন স্টিফেন হকিং। তিনি যখন ছাত্র, অক্সফোর্ডে পড়েন, তখন তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর একটা রোগ আছে, তিনি ঝাপসা দেখেন কখনো কখনো। তাঁর ২১ বছর বয়সে, ১৯৬৩ সালে, তিনি হাসপাতালে যান টেস্ট করাতে। তখন জানা গেল, তাঁর মোটর নিউরন ডিজিজ হয়েছে। এটা আর সারবে না। তিনি ধীরে ধীরে অচল হয়ে যাবেন এবং তিনি মারা যাবেন। সেটা কত তাড়াতাড়ি, তা তিনি জানতেন না। হয়তো ছয় মাস, হয়তো কয়েক বছর। তখন তাঁর পাশের বিছানায় লিউকেমিয়া রোগে আক্রান্ত এক বালককে তিনি দেখেন। সে–ও মারা যাবে। স্টিফেন হকিং ভাবলেন, আমার অবস্থা ওর চেয়ে ভালো। আমি কবে মারা যাব, তা জানি না। আর এখন তো আমি রোগটাকে অনুভব করতে পারছি না।
স্টিফেন হকিং হাসপাতাল থেকে ফিরলেন। তাঁর মনে হলো, তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামি। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, তিনি জীবনকে আগের চেয়ে বেশি করে উপভোগ করতে শুরু করলেন এবং কাজ করাটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন। তিনি বিয়ে করলেন। কাজ করে চললেন। তাঁর চলাচল সীমিত হয়ে আসতে লাগল। হুইলচেয়ার ছাড়া তিনি চলতে পারেন না। এভাবে চলল প্রায় এক যুগ। ১৯৮৫ সালে, তাঁর ৪৩ বছর বয়সে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলেন। এরপর তাঁর একটা অপারেশন হলো। এরপর বন্ধ হয়ে গেল তাঁর কথাও। তখন তিনি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতেন চোখের পাতা ফেলে। কেউ একজন তাঁর সামনে একটা অক্ষর ধরত, আর তিনি চোখের পাতা ফেলে সেটাকে অনুমোদন করতেন। তারপর তাঁর জন্য একটা কম্পিউটার সফটওয়্যার এল, যেটা দিয়ে চোখের পাতা ফেলে লিখতে পারতেন। তিনি কথা বলতে পারতেন না, কম্পিউটারের মাধ্যমে তাঁর চিন্তাগুলো লেখা হতো। এভাবে তিনি বই লিখেছেন। ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ও লিখেছেন প্রতিবন্ধিতা সত্ত্বেও। পাতার পর পাতা সংশোধন করেছেন। তিনি এভাবে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তৃতাও দিয়েছেন। ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকেই যাঁর জীবনাবসান হওয়ার কথা ছিল, সেই তিনি ২০১৬ সালেও বেঁচে ছিলেন, বিপুলভাবে। তিনি চলতে পারতেন না, নড়তে পারতেন না, চোখের পাতা ছাড়া কিছুই নড়াতে পারতেন না, কথা বলতে পারতেন না, কিন্তু তিনি লিখেছেন, গবেষণা করেছেন, লেকচার দিয়েছেন। ভাবা যায়!
স্টিফেন হকিং মজার মানুষ। কয়েক বছর আগে ইংল্যান্ডে তাঁকে বাচ্চারা জিজ্ঞেস করেছিল, জায়ান মালিক (জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা) ওয়ান ডিরেকশন (গানের দল) ছেড়ে দিয়েছেন, অন্য কোনো জগতে কি জায়ান মালিক সেই ব্যান্ডে ফিরতে পারেন না?
স্টিফেন হকিং বলেছেন, ‘আরেকটা গ্যালাক্সিতে হয়তো আরেকটা ওয়ান ডিরেকশন আছে, জায়ান মালিক সেখানে তার ব্যান্ড ছেড়ে দেয়নি।’
অন্য গ্রহ থেকে এলিয়েনরা এসে পৃথিবী ধ্বংস করবে কি না। স্টিফেন হকিং জবাব দেন, তার চেয়েও বড় শঙ্কা হলো পৃথিবীতে যে পরিমাণে আণবিক বোমা আছে, তা পৃথিবীর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেন, ভুল করে কোনো দুর্বল দেশের পারমাণবিক বোমার সুইচে কোনো পাগল বা সন্ত্রাসী ঢুকে পড়ে সুইচ টিপে দিলেই পৃথিবী শেষ। কারণ, সেটাকে প্রতিরোধ করতে সব দেশই তার তার সুইচ টিপে দেবে। হকিং বলেন, তাই আমাদের উচিত সব সরকারকে চাপ দেওয়া অস্ত্র কমানোর জন্য।
স্টিফেন হকিং বলেন, একটা অসুস্থ কৌতুক আছে, পৃথিবীতে এলিয়েন আসে না। কারণ, কোনো এলিয়েন প্রজাতি যখন খুব উন্নতি করে, তখন তারা নিজেরাই নিজেকে ধ্বংস করে। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, পৃথিবীর ক্ষেত্রে তা ঘটবে না।’
স্টিফেন হকিং ৭৬ বছর বয়সে মারা গেছেন মৃত্যুর নোটিশ পাওয়ার ৪৫ থেকে ৪৭ বছর পর।
কিন্তু এর মধ্যে স্টিফেন হকিংরেখে গেলেন অসাধারণ সব কাজ।
‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ তিনি লিখেছেন খুবই সোজা করে। একটা মাত্র ফর্মুলা ই=এম সি স্কয়ার ছাড়া আর কোনো সূত্র এই বইয়ে নেই। বইটাতে একটা মজার কথা আছে। সময় আসলে সব জায়গায় সমানভাবে বয়ে চলে না। পাহাড়ের ওপরে আর সমুদ্রের পাশে সময় একই গতিতে চলে না। স্টিফেন হকিং বলছেন, দুই যমজ শিশুর একটাকে পাহাড়ের ওপরে, আরেকটাকে সমুদ্রপৃষ্ঠের সমান উচ্চতায় রাখলে অনেক দিন পর দেখা যাবে, দুজনের বয়স দুই রকম। তিনি বলছেন, এটা কোনো তাত্ত্বিক কথা নয়। মহাকাশে যাঁরা থাকেন, তাঁরা জানেন, তাঁদের সময়টা আলাদা। আর সমুদ্রের নিচে যখন সংকেত পাঠানো হয়, সেটা পৌঁছানোর সময়টা যে পাহাড়ের ওপরে যিনি থাকবেন, তার চেয়ে আলাদা, এ হিসাব কষেই পৃথিবীর বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদেরা বাস্তবের কাজগুলো করে থাকেন।
আমরা স্টিফেন হকিংয়ের কাছ থেকে সাহস পাই। প্রেরণা পাই। তিনি যে অদম্য। আমরা সামান্য প্রতিকূলতা ভেঙে পড়ি। স্টিফেন হকিং তাঁর শারীরিক প্রতিকূলতাকে জয় করে নিয়েছিলেন।