একজন ১৪ বছর বয়সী কিশোরের মানসিক স্বাস্থ্যের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে তারা কী দেখে, কত সময় কাটায়, তার ওপর নির্ভর করে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য। সারাক্ষণ এই মাধ্যমগুলোতে সময় কাটালে স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে দ্বিমত নেই। এখন প্রশ্ন উঠেছে, শিশু-কিশোরদের কতক্ষণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত?
কিশোর-কিশোরীসহ প্রাপ্তবয়স্কদের ওপরও ব্যাপক প্রভাব রাখে ফোন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। জনস্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, নাগরিক স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে প্রভাবিত হয়। কারণ, আধুনিক সময়ে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমেই বেশি সময় কাটায় মানুষ।
গত মার্চ মাসে একটি বিল পাস হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ অঙ্গরাজ্যে। যুগান্তকারী বিলটিতে স্বাক্ষর করেছেন ইউটাহর রিপাবলিকান গভর্নর স্পেন্সার কক্স। শিশু-কিশোরদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার সীমিত করার উদ্দেশ্যে বিলগুলোয় স্বাক্ষর করেন তিনি। নতুন এ আইনে বলা হয়েছে, বাবা-মা বা অভিভাবকেরা সন্তানদের ব্যক্তিগত মেসেজ দেখতে পারবেন। সন্তানেরা কাকে ফলো করছে, নিজের টাইমলাইনে কতক্ষণ স্ক্রল করছে, এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী এই সিদ্ধান্তগুলো নেবেন তাঁরা। ইউটাহর গভর্নর বলেছেন, উইটাহ আগামী মাসগুলোয় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আদালতের দ্বারস্থ হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা এবং লুইজিয়ানার মতো রাজ্যগুলোও এমন নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে শিশু-কিশোরদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগের জন্য সবার আগে আইন করেছে উইটাহ। এই আইনে অপ্রাপ্তবয়স্কসহ সব ব্যবহারকারীর জন্য টিকটক এবং ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার সীমিত করার কথা বলা হয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দায়ী। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, ‘যদি আমাদের ছেলেমেয়ের ক্যানসার হয় বা তারা গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়, তাহলে আমাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু মানসিক বিষণ্নতা ও উদ্বেগে ভুগলে আমরা কিছু মনে করি না।’
ইউটাহর গভর্নরের মতে, এ আইনের মাধ্যমে উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং আত্মহত্যার মতো ভয়ানক ক্ষতিকারক সমস্যাগুলো হ্রাস পাবে। ২০১৩ সালের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খুব বেশি ব্যবহার ছিল না। মানসিক স্বাস্থ্যে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাবও ছিল না। এই প্রভাব থেকে রক্ষা করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে এই আইনের প্রয়োগ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকদের স্বাধীনতা রক্ষা তাঁদের সংবিধান দ্বারা সংরক্ষিত। স্বাধীনতার মূল কথা হলো ‘প্রতিটি মানুষই সমান এবং একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি।’ স্বাধীনতার ধারণায় অনেক দেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো আইন পাস হলে অন্যান্য দেশ সেটিকে অনুসরণ করে। শিশু-কিশোরদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সময় ও কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অন্যান্য দেশ এ রকম আইন তৈরি করে কি না, সেটি এখন দেখার বিষয়। এগুলো যেভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তাতে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালে প্রতি পাঁচজন কিশোরীর মধ্যে প্রায় তিনজন ‘গভীর দুঃখ’ অনুভব করেছে। মারাত্মক পর্যায়ে আত্মহত্যার চিন্তা করেছে তিনজনের একজন। ২০১১ সাল থেকে প্রতিটি রিপোর্টে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর হার বেড়েছে। চার-পাঁচ বছর আগেই শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আইনটি করা যেত। দেরি করে হলেও শুরু হয়েছে, এটিই আশার কথা।
অবশ্য আইনটি আইনি জটিলতার মুখোমুখি হয়েছে। প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান এবং স্বাধীনতাবাদীরা প্রশ্ন তুলেছেন আইনটি নিয়ে। শিশু-কিশোরদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার সীমিত করার জন্য তাদের বয়স যাচাই করতে হবে। বয়স যাচাই করায় সরকার কতটা যুক্ত থাকবে? গভর্নর নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, তিনি এটা নিয়ে চিন্তিত নন। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনে তিনি কাজ করবেন।