ভূতে ধরলে কী করবে?

অনেক আগের কথা। আমাদের গ্রামের পাশেই ছিল বিশাল এক মাঠ। সেই তেপান্তরের মাঠে সন্ধ্যার পর কেউ যেত না। কারণ, ভূতের উৎপাত। এক সকালে বন্ধুরা সেই মাঠে খেলতে গিয়েছি। ভূত বিশ্বাসীদের ধারণা, ভূতেরা সূর্য উঠলেই চম্পট দেয়। দিনের আলোয় ওদের ভয়। সূর্য ডুবলে তারা কাউকে একা পেলে ঘাড় মটকে খায়।

সেদিন দেখি, মাঠের মাঝে পুকুরপাড়ে এক অপরিচিত লোক অচেতন হয়ে পড়ে আছে। ভয় পেয়ে গেলাম। নিশ্চয়ই ভূতের কাণ্ড। তার চোখেমুখে একটু পানি ছিটিয়ে দিতেই সে চোখ খুলল। কিন্তু মুখে আতঙ্কের ভাব। সে বলল, রাতে সে কী ভীষণ বিপদে পড়েছিল। দূরের এক গ্রামে সে থাকে। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে আরেক গ্রামে যেতে হয়। ভেবেছিল, সন্ধ্যার আগেই মাঠ পেরিয়ে যাবে। কিন্তু মাঠের মাঝামাঝি যেতেই ঘোর অন্ধকার। সেটা ছিল অমাবস্যার রাত। ভয় ভয় করছে। কিন্তু তখন তো আর উপায় নেই। সাহসে পা চালিয়ে যায়। হঠাৎ তার কানে এল নাকি কণ্ঠ। একজন বলছে, অনেক দিন মানুষের মাংস খাইনি, আজ পেয়েছি। অন্যজন বলছে, তুই কেন? আমি খাব। এসব শুনে সে ভয়ে কাঠ।

ওদিকে দূরে আলোর ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ মাঠের এখানে-সেখানে দপ করে নীল আগুনের শিখা জ্বলে উঠেই মিলিয়ে যায়। লোকটা বুঝল, ভূতের পাল্লায় পড়েছে, তার আর রক্ষা নেই।

এরই মধ্যে মনে পড়ে গেল তার ক্লাস টিচারের কথা। ছোটবেলায় তিনি বলেছিলেন, মাথা ঠান্ডা রেখে বুদ্ধি খাটিয়ে চললে ভূতের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব। সে তাই সাহস করে এগিয়ে গেল। দুই ভূত ঝগড়া করছে। সে ভাবল, এই সুযোগ। ভূত দিয়েই এ বিপদ থেকে বাঁচতে হবে। সে হাতজোড় করে বলল, বাবারা, তোমরা আমার মাথা মটকে খাও, আপত্তি নেই, শুধু একটা অনুরোধ।

দুই ভূত চেঁচিয়ে উঠল, কিসের অনুরোধ, তোকে এখনই খাব।

—খাও, কিন্তু একজন খাও। দুজনে টানাহেঁচড়া করে খেতে গিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়ো না।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক কথাই তো। তাহলে আমি খাব।

সঙ্গে সঙ্গে অন্য ভূত বলল, তা কেন, আমি সিনিয়র, আমিই খাব।

এভাবে দুই ভূতের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে লোকটা একটু অবসর পেল। কিছুক্ষণ পর সে ভূতদের ডেকে বলল, তোমরা ঝগড়া কোরো না। চলো যাই ওই পুকুরে। তোমরা দুজন একসঙ্গে ডুব দাও। যে বেশিক্ষণ ডুবে থাকতে পারবে, সে-ই আমাকে খাওয়ার যোগ্য হবে। কী, ঠিক কি না? দুই ভূতে তাতেই রাজি। লোকটা পুকুরপাড়ে বসে বলল, এই যে, আমি আম্পায়ার। দেখব কে বেশিক্ষণ ডুবে থাকতে পারে।

ভূতেরা তাতেই রাজি। দিল দুজন একসঙ্গে ডুব। কিছু পরে ছোট ভূত মাথা উঠিয়ে দেখে অন্য ভূত তখনো ওঠেনি। সে লোকটাকে বলল, খবরদার, বলেছিস তো তোর জান কবচ। বলেই সে দিল ডুব। এরপর সিনিয়র ভূত উঠে দেখে জুনিয়র তখনো ওঠেনি। সেও চোখ পাকিয়ে বুঝিয়ে দিল কথা ফাঁস করলে ঘাড় মটকাবে। তাড়াতাড়ি সেও দিল ডুব। এরপর দুই ভূতের ডুবাডুবি চলতে থাকল। ওদিকে সকাল হয়ে এল। আলো দেখে দুই ভূত দিল চম্পট।

লোকটা যখন দেখল ভূত নেই, তখনই তার শরীর কাঁপতে থাকল। ভীষণ বিপদ থেকে বেঁচে গেলে যে আতঙ্ক হয়, এটা সেই অনুভূতি। শরীর অবশ হয়ে এল। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল পুকুরপাড়ে।

এরপরের কাহিনি তো আগেই বললাম। একটু গরম দুধ খেয়ে সে সুস্থ হল। বড় হয়ে সেই লোকটার কথা ভেবে খুব মজা পেতাম। কারণ, ভূত বলে তো কিছু নেই। লোকটা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল মনের ভয়ে। সেই মাঠের পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল জলাশয়। সেই পানিতে শেওলা, জলজ উদ্ভিদ ভরে থাকত। ওই সব লতাগুল্ম পচে পানিতে তৈরি করত মিথেন গ্যাস। বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে ওই গ্যাস মাঝেমধ্যে জ্বলে উঠত। দিনের আলোয় দেখা যায় না। রাতে মনে হয় এদিক-ওদিক আলোর ঝলক। নিশ্চয়ই অশরীরী। প্রেতাত্মা। এ আলোর ঝলককেই গ্রামবাংলায় বলে আলেয়া। সেখান থেকেই রাতে খোলা মাঠে ভূতের আড্ডা বসে, এমন কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

সেই লোকটা আসলে মনের ভয়ে কাবু হয়ে কল্পনায় ভূতদের পানিতে ডুবাডুবি করিয়ে রাত পার করেছিল। সেখানে ভূতের ব্যাপার ছিল না। কিন্তু ছোটবেলায় ওই লোকটার মুখে ভূতের কাহিনি শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। বাস্তবে ভূত বলে কিছু না থাকলেও ভূতের গল্পের মজা আছে। সেজন্যই এ স্মার্ট যুগেও ভূত টিকে আছে!