গোল্ডফিশের স্মৃতি কি মাত্র তিন সেকেন্ডের

গোল্ডফিশছবি: লাইভ সায়েন্স

কাচের জার বা অ্যাকুয়ারিয়ামে প্রায়ই দেখা যায়, একটা কমলা রঙের মাছ ঘুরছে। ইতিউতি সাঁতার কাটছে। খাবার দিলে গপগপ করে খেয়ে ফেলে। সম্ভাবনা আছে মাছটি গোল্ডফিশ। খুব পরিচিত এবং পোষা মাছ হিসেবে জনপ্রিয়। এই মাছ দুই কারণে বিখ্যাত। এক, ঝলমলে কমলা রং আর খারাপ স্মৃতিশক্তির জন্য। অনেকেই মনে করেন, সবচেয়ে ভুলোমনা মাছ বুঝি গোল্ডফিশ। প্রচলিত আছে, গোল্ডফিশের মেমোরি মাত্র তিন সেকেন্ডের। ঘটনার মাত্র তিন সেকেন্ডের মধ্যে গোল্ডফিশ ব্যাপারটি ভুলে যায়। কারও স্মৃতিশক্তি কম হলে লোকে বলে, অমুকের গোল্ডফিশ মেমোরি।

গোল্ডফিশের স্মৃতিশক্তি কম, এই ভাবনা অমূলক। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে আছে অনেক বছর ধরে। অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককুয়ারি ইউনিভার্সিটির মাছের অনুভূতি–বিশেষজ্ঞ কুলাম ব্রাউন লাইভ সায়েন্সকে বলেছেন, বিস্ময়কর ব্যাপার হলো বিশ্বের সবখানেই বিষয়টি প্রায় একই রকম। কিছু জায়গায় মনে করা হয়, গোল্ডফিশের স্মৃতি মাত্র ২ সেকেন্ড, কোথাও ভাবা হয় ৩, সর্বোচ্চ ১০ সেকেন্ড পর্যন্ত। সব সময়ই স্বল্প সময়ের স্মৃতিশক্তি হিসেবে ধরা হয়।

বাস্তবে গোল্ডফিশের (বৈজ্ঞানিক নাম ক্যারাসিয়াস অরাটাস) স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। সপ্তাহ, মাস, এমনকি বছর ধরে এর স্মৃতি থেকে যায়। অন্তত ১৯৫০–এর দশক থেকেই এই তথ্য বিজ্ঞানীরা জানেন, প্রচার করেন।

বিজ্ঞানী কুলাম ব্রাউন ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে গোল্ডফিশসহ বিভিন্ন মাছের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি মনে করেন, ভুল ধারণাটি ছড়িয়েছে মাছের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে না জানার কারণে। এ ছাড়া অপরাধবোধ থেকেও ধারণাটি এসেছে। সাধারণত যাঁরা পোষা প্রাণীর মালিক, প্রায়ই দেখা যায়, তাঁরা প্রাণীর যত্ন নেন না। প্রথম কিছুদিন আগ্রহ থাকলেও পরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অনেক সময়ই বন্ধন থাকে না। এভাবে প্রায়ই গোল্ডফিশকে ছোট জার বা নোংরা অ্যাকুয়ারিয়ামে রাখেন। অযত্ন আর অবহেলার অপরাধবোধ থেকে বাঁচতে তাঁরা মনে করেন, পোষা প্রাণীটির বুঝি অনুভূতি কম, এটি বুঝি কষ্ট পাচ্ছে না।

গোল্ডফিশের বুদ্ধিমত্তা

বাস্তবে গোল্ডফিশের স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। গোল্ডফিশের ওপর হাজারো গবেষণা হয়েছে। দেখা গেছে, এই মাছের চমৎকার স্মৃতি আছে। এগুলো শিখতে পারে। প্রতিনিয়ত গবেষণার পরিমাণ বাড়ছে। গবেষণার বেশির ভাগই মাছের খাবারের সঙ্গে জড়িত। যেমন যদি গোল্ডফিশকে অ্যাকুয়ারিয়ামের শুধু এক পাশে খাবার দেওয়া হয়, তবে এগুলো দ্রুত শিখে ফেলে কোথায় খাবার পাওয়া যাবে। খাওয়ার সময় অ্যাকুয়ারিয়ামের সে পাশে গিয়ে অপেক্ষা করে।

একইভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে, যদি একটি লাল প্যাডেলে ধাক্কা দিয়ে খাবার পুরস্কার হিসেবে পাওয়া যায়, তাহলে নীল রঙের প্যাডেলে গোল্ডফিশ ধাক্কা দেবে না। অল্প সময়ে গোল্ডফিশ লাল প্যাডেলে ধাক্কা দেওয়া শেখে। নীল প্যাডেলে ধাক্কা দেয় না। পরীক্ষা শেষ হওয়ার অনেক পরেও এই রং বেছে নিতে পারে গোল্ডফিশ। এই ধরনের পরীক্ষার সময় রঙের বদলে বুদ্‌বুদ থেকে শুরু করে গানও ব্যবহার করে দেখা হয়েছে। দেখা গেছে, গোল্ডফিশ একই রকম সাড়া দেয়। স্মৃতিতে থেকে যায় অভিজ্ঞতা।

গোল্ডফিশ সমস্যার সমাধান করতে পারে। জাল এড়ানো, পাজলের মধ্যে বাধা এড়িয়ে চলা শিখতে পারে। কীভাবে এই কাজ সপ্তাহ পরেও করতে পারে। এমনকি কয়েক মাস পরেও মনে রাখতে পারে।

গোল্ডফিশের স্মৃতি

গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে, গোল্ডফিশ মানুষকে চিনতে পারে। মানুষের চেহারা মনে রাখতে পারে। দীর্ঘ সময় নির্দিষ্ট মানুষকে দেখতে না পেলেও মনে রাখে। মানুষটি সামনে এলে চিনতে পারে। অনেক গোল্ডফিশের মালিক দাবি করেছেন, পোষা গোল্ডফিশ তাঁদের অন্যদের থেকে আলাদা করে চিনতে পারে।

মাছ গবেষণায় অনেক সময় গোল্ডফিশ ব্যবহার করা হয়
ছবি: লাইভ সায়েন্স

ঠিক কত সময় কোনো স্মৃতি গোলফিশের মনে রয়ে যায় বলা কঠিন। গোল্ডফিশের জন্য ভয়ংকর কোনো অবস্থার স্মৃতি বেশি সময় ধরে রয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। দিন, সপ্তাহ, মাস বা বছর ধরে স্মৃতি থাকতে পারে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এগুলোর স্মৃতি তিন সেকেন্ডের বেশি সময় ধরে থাকে।

গবেষণায় প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। কারণ, বেশির ভাগ মানুষ প্রতিদিন জীবিত মাছের দেখা পায় না। আবার মানুষ মনে করে, পোষা প্রাণী হিসেবে কুকুর বা বিড়ালের সঙ্গে যেমন করে মেশা যায় বা সময় কাটানো যায়, মাছের সঙ্গে তেমন করা যায় না। মাছ থাকে পানিতে। মানুষ মাছের অ্যাকুয়ারিয়ামের বাইরে থাকে। এ কারণে গোল্ডফিশ মেমোরি নিয়ে ভুল ধারণা থেকেই যায়।

ভালোভাবে যত্ন নিলে গোল্ডফিশ প্রায় ২০ বছর বাঁচে। বসবাসের জন্য সমৃদ্ধ অ্যাকুয়ারিয়াম, পর্যাপ্ত চলাফেরার জায়গা ও খেলার জন্য অন্যান্য মাছ রাখলে পোষা গোল্ডফিশ কয়েক বছর ধরে কিছু অভিজ্ঞতা অবশ্যই মনে রাখতে পারবে।