বিতর্কের ‌বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ

সৌরদীপ পাল ও সাজিদ আসবাত খন্দকার

বাংলাদেশের হয়ে বিতর্কের ‘বিশ্বকাপ’ WUDC (World Universities Debating Championships) জিতেছে ‘ব্র্যাক এ’। সৌরদীপ পাল ও সাজিদ আসবাত খন্দকার—ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর হাত ধরে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে এই সম্মান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। অথচ ২০১৩ সালের আগে এই প্রতিযোগিতার প্রাথমিক পর্বই পার হতে পারেনি বাংলাদেশের কোনো দল। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলা সেই দেশ আজ চ্যাম্পিয়ন! নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অসামান্য এক প্রাপ্তি এটা। হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড কিংবা প্রিন্সটনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের দলগুলোকে হারিয়ে সাড়া ফেলে দেওয়ার গল্পটা বিতার্কিকদের নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার। তাঁদের অর্জনে বিশ্বমঞ্চে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা। সেই গল্পই তোমাদের বলব আজ।

সাজিদ ও সৌরদীপ স্নাতক করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে। বর্তমানে স্নাতকোত্তর করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিতর্কে তাঁদের অর্জন অনেক। অর্জনের খাতায় জ্বলজ্বল করছে কেমব্রিজ আইভি, অস্ট্রালসের মতো অভিজাত টুর্নামেন্টের খেতাব। কিন্তু একটা জায়গায় আক্ষেপ ছিল সৌরদীপের। দেশের হয়ে বিতর্কের সর্বোচ্চ অর্জনটা নেই তাঁর। বিতর্কের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নটাকে পূরণ করতে সাজিদকে সঙ্গী করে সিদ্ধান্ত নিলেন, শেষবারের মতো লড়াইয়ে নামবেন তিনি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে লড়বেন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ।

এই চ্যাম্পিয়নশিপ আসলে কী? এই টুর্নামেন্ট পরিচিত বিতর্কের বিশ্বকাপ বা ‘ওয়ার্ল্ডস’ নামে। আর ওয়ার্ল্ডসের ওপেন ক্যাটাগরির বিজয়ীদের বলা হয় ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন। এই প্রতিযোগিতার প্রতিটি দল এতই তুখোড় যে শুরুতে কোনোভাবে বোঝার উপায় নেই কারা হবে চ্যাম্পিয়ন। ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতায় সেরা হওয়াটা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। বছরের পর বছর বিতার্কিকেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান বিশ্বমঞ্চে নিজেদের তুলে ধরতে। অসাধারণ সব বিতার্কিকের কৃতিত্বে সমৃদ্ধ এই প্রতিযোগিতার ইতিহাস। কেউ হয়েছেন পার্লামেন্টের সদস্য, কেউ বা জনপ্রিয় লেখক। বিজয়ী দল বিরাট কোনো অর্থ পুরস্কার পায় না। শুধু পায় ট্রফি। সেই ট্রফির মূল্য কতটা, তা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে ফেলেছ।

প্রতিবছর আয়োজিত এই বিশ্বকাপের এবারের আয়োজক ছিল সার্বিয়ার ইউনিভার্সিটি অব বেলগ্রেড। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় বিশ্বের ৩৬৪টি দল। কোভিড বিধিনিষেধের কারণে পুরো আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়েছে অনলাইনে।

বিতর্কের কয়েকটি ধরন আছে। সাধারণত আমরা টিভিতে যে বিতর্ক দেখি, তা হলো সনাতনী বিতর্ক। আমাদের দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে দেখা মেলে এশিয়ান পার্লামেন্টারি বিতর্কের। আরেকটি ধরন হলো ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ডিবেট। যেখানে প্রতি দলে দুজন করে মোট চারটি দল একে অপরের মুখোমুখি হয়।

বিতর্কের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত নবীন। ১৯৭৬ সালে শুরু হওয়া ওয়ার্ল্ডসের ইতিহাসে বাংলাদেশের মূল কাব্য রচনা শুরু ২০১৩ সাল থেকে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ই সেবার ইএসএল ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। আর সর্বশেষ গত বছর বুয়েটের হয়ে শীর্ষ সংশপ্তক ও জুমানা তানুজা পৌঁছান ইএফএল ক্যাটাগরির ফাইনাল অবধি। ক্যাটাগরির ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকছে? একটু বুঝিয়ে বলা যাক।

বিতর্কে ভাষায় সাবলীলতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দাবার বোর্ডে কিংবা ফুটবলের মাঠে কে কোন ভাষায় কথা বলেছে, তা খেলায় প্রভাব ফেলে না। কিন্তু বিতর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন নয়। সবাইকে এক ভাষাতেই বিতর্ক করতে হবে বিশ্বকাপে। তাই যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, তাদের পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনাটাও অন্যদের থেকে বেশি। তাদের কথা মাথায় রেখে কিছু ক্যাটাগরি করা হয়। এগুলো হলো ইংলিশ অ্যাজ সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ (ইএসএল), ইংলিশ অ্যাজ ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ (ইএফএল) ও ওপেন। যেসব দেশের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, তারা ওপেনের পাশাপাশি বাকি দুটি ক্যাটাগরিতেও বিবেচ্য হবে। আর যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি, তারা শুধু ওপেন ক্যাটাগরিতে বিবেচ্য হবে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের মাতৃভাষা ইংরেজি না হলেও খুবই ভালো বিতর্ক করে আমরা চাইলে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের সঙ্গে লড়াই করতে পারব ওপেন ক্যাটাগরিতে সেরা হওয়ার জন্য। কিন্তু ব্যাপারটা কি অসম্ভব কঠিন, কল্পনা করতে পারো?

আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই বিতর্কের চল কম। এর মাধ্যমে কত দূর যাওয়া সম্ভব, তা অনেকেরই অজানা। ফলে বিতর্কের পথচলা কখনোই মসৃণ নয়। বাধা আসে অনেক। সৌরদীপ ও সাজিদের জন্যও তাই কাজটা সহজ ছিল না। অনেক দিন ধরে বিতর্ক করছেন তাঁরা, ধীরে ধীরে সর্বোচ্চ প্রাপ্তির জন্য তৈরি করেছেন নিজেদের। নিয়মিত বিতর্ক করেছেন, শিখেছেন। হারলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বারবার। অসামান্য ধৈর্যের সঙ্গে লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। সঙ্গে সম্বল বিতর্কের প্রতি বুকভরা ভালোবাসা।

আট দিনব্যাপী চলা বিতর্ক বিশ্বকাপে খেলতে হবে ৯টি ম্যাচ। প্রতিটিতেই আলাদা আলাদা বিতর্কের বিষয়, যাকে বলা হয় ‘মোশন’। যেমন ফাইনাল ম্যাচের মোশন ছিল, বিশ্বে ডলারের প্রতি নির্ভরতা কমানোকে এই সংসদ সমর্থন করে।

বিচারকদের রায়ে পয়েন্ট পাবে দলগুলো। পয়েন্টের দিক থেকে এগিয়ে থাকা দলগুলো পৌঁছাবে নকআউট পর্বে। সেখানে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল পেরিয়ে ফাইনাল। বুকভরা আশা নিয়ে অপেক্ষা করেছে বাংলাদেশের বিতর্কের সব শুভাকাঙ্ক্ষী। নকআউট পর্বের আগেই চমক দেখাল ব্র্যাক এ। মুখোমুখি বিতর্কে হারাল হার্ভার্ড, ইম্পেরিয়াল কলেজ, অক্সফোর্ডসহ আরও চমৎকার সব বিতর্ক দলকে। সবাইকে থমকে পৌঁছাল নকআউট পর্বে। এবার ইতিহাস সৃষ্টি করে প্রতিযোগিতার মূল ক্যাটাগরি ওপেনে পঞ্চম স্থানে থেকে। পুরো আয়োজনে নকআউট পর্বে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি সৌরদীপ ও সাজিদের ব্র্যাক এ। ইতিহাস এতটুকুতে থাকলেও হয়তো হাসিমুখে বিদায় নিত বাংলাদেশ। কিন্তু বিতার্কিকদের বারুদ বড় তাজা। সবাইকে বিস্মিত করে টিম ব্র্যাক এ পৌঁছে গেল ফাইনালে। ২৬ জুলাইয়ের সেই রাতটায় না ঘুমিয়েই স্বপ্ন দেখা শুরু করল সবাই। ততক্ষণে সৌরদীপ ও সাজিদের ঠাঁই বাংলাদেশের বিতর্কের ইতিহাসের পাতায়।

ফাইনালের চার দল হলো আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ফিলিপাইনের অ্যাতেনিও দে ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয় ও সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর।

ফাইনালের মোশনের কথা তো বলেছি একটু আগে। বিশ্ব অর্থনীতি বিবেচনায় বিষয়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শেষ এই ম্যাচে বিচারক ছিলেন ৯ জন। তাঁরা কখনো মুগ্ধ হয়েছেন সৌরদীপের যুক্তিতে, কখনো প্রিন্সটনের শিয়াও কে লুয়ের যুক্তিখণ্ডনে। এশিয়ান পাওয়ার হাউস অ্যাতেনিও দে ম্যানিলাও কিছু কম যায় না। অনেকেরই ফাইনাল ফেবারিট ছিল এই বিতর্ক দল। লড়াই হয়েছে হাড্ডাহাড্ডি। স্ক্রিনের সামনে সেই বিতর্ক দেখে নিশ্বাস আটকে গিয়েছিল অনেকেরই। রুদ্ধশ্বাস সেই ফাইনালের ফলাফল তোমরা সবাই এখন জানো।

সৌরদীপ পাল ও সাজিদ আসবাত খন্দকার

৯ জন বিচারকই রায় দিয়েছেন ব্র্যাকের পক্ষে। স্ক্রিনের সামনে যখন দলটার নাম ভেসে উঠেছিল, তখন আনন্দে মেতে উঠেছে বিতর্ক–সংশ্লিষ্ট সবাই। শত প্রতিবন্ধকতার ভিড়েও বিতর্ককে ভালোবেসে যাওয়ার ফলাফল পেয়েছে মানুষগুলো। সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে বিশ্ব জয়ের খেতাব এখন ‘ব্র্যাক এ’র।

সৌরদীপ পাল আর সাজিদ আসবাত খন্দকারের হাত ধরে শুরু হওয়া স্বপ্নটা সবে উড়তে শিখল। এখনো বাকি অনেক পথ। এই কিশোর আলো হাতে স্বপ্নাতুর তুমিই হয়তো সামনে ওড়াবে লাল–সবুজের পতাকা। বিশ্বমঞ্চে গর্ব নিয়ে করবে যুক্তির লড়াই। স্বপ্নের সেই ডানায় ভর দিতে তুমি প্রস্তুত তো?

বিতর্ক রইল তোমার অপেক্ষায়।

(কিশোর আলোর আগস্ট ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত)