স্বপ্ন কেন মনে থাকে না
অনেক সময় ঘুমের মধ্যে আমরা স্বপ্ন দেখি যে পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার হলে বসে কলম কামড়াচ্ছি। কোনো অঙ্কই করতে পারছি না। পরীক্ষার আগে সব ঠিক ছিল, কিন্তু এখন কেমন গুলিয়ে গেছে। সময়ও যেন শেষ হচ্ছে না। অসহায় লাগছে। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেলে তোমরা নিশ্চয়ই নিজেকে আবিষ্কার করো বিছানায়।
আসলে পরীক্ষা নিয়ে খুব চিন্তা করায় রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পরীক্ষার স্বপ্ন দেখি আমরা। ঘুম ভাঙলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি।
তোমার মাথায় যদি হঠাৎ বুদ্ধি খেলে যায়, পরীক্ষার প্রশ্ন স্বপ্নে দেখেছি। প্রশ্নটা লিখে রাখি। যদি ওই প্রশ্নগুলোই কমন পড়ে যায়! চটজলদি খাতা–কলম নিয়ে বসে পড়লে। কিন্তু প্রশ্নগুলো যেন কী ছিল। কিছুতেই মনে করতে পারবে না। এখন প্রশ্ন হলো, কেন স্বপ্ন মনে থাকে না?
আমরা জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটাই। আর ঘুম মানেই শুধু বিশ্রাম নয়, ঘুমের একটা বড় অংশজুড়ে আমরা স্বপ্ন দেখি। বেশির ভাগ সময় স্বপ্ন মনে থাকে না। মাঝেমধ্যে যা–ও একটু মনে থাকে, তা কিছুক্ষণ পরই ভুলে যাই। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
এই একই ঘটনা যদি জেগে থাকা অবস্থায় হতো, তাহলে নিশ্চয়ই চিকিৎসকের কাছে ছুটে যেতাম। মানে কিছু একটা ঘটল, আর আমরা একেবারে তা ভুলে গেলাম! কী ভয়ংকর! ভাবো একবার। কিন্তু স্বপ্ন ভুলে যাওয়া একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা নিয়ে প্রশ্ন করাটাই যেন অস্বাভাবিক। তবে বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করেছেন অস্ট্রেলিয়ার মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক টমাস আন্দ্রিয়োঁ। তিনি বলেন, আমরা আসলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্বপ্ন ভুলে যাই। যারা বলে স্বপ্ন দেখে না, তারাও আসলে স্বপ্ন দেখে। শুধু খুব দ্রুত ভুলে যায় বলেই মনে থাকে না। কিন্তু সেগুলো এত দ্রুত ভুলে যায় যে বলে, স্বপ্ন দেখে না। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যারা জীবনে কোনো দিন স্বপ্ন মনে রাখতে পারেনি বা যারা বলে যে স্বপ্ন দেখে না, তাদের ঠিক সময় জাগিয়ে দিলে স্বপ্নের কথা মনে করতে পারে।
ঠিক কেন এমন হয়, তা পুরোপুরি জানা না গেলেও বিজ্ঞানীরা ঘুমের সময় আমাদের স্মৃতি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু ধারণা পেয়েছেন। ধারণাগুলো আমাদের স্বপ্ন ভুলে যাওয়ার অদ্ভুত ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করতে পারে।
আমরা ঘুমিয়ে পড়লে মস্তিষ্কের সব অংশ একসঙ্গে ঘুমায় না। ২০১১ সালে নিউরন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমানোর সময় যে অংশ সব শেষে ঘুমায়, তার নাম হিপোক্যাম্পাস। এই অংশই আমাদের স্মৃতিকে স্বল্প মেয়াদ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। আন্দ্রিয়োঁর মতে, হিপোক্যাম্পাস ঘুম থেকে দেরিতে জাগে। তাই ঘুম ভাঙার পর কয়েক মিনিটের মধ্যে যদি আমাদের মাথায় স্বপ্নের কিছু থাকেও, সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ, তখনো হিপোক্যাম্পাস পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। এর মানে এ–ই নয় যে ঘুমের সময় হিপোক্যাম্পাস কিছু করে না। বরং তখন ওই অংশ পুরোনো স্মৃতি সাজিয়ে রাখে, নতুন কিছু সংরক্ষণ করে না। অনেক বিজ্ঞানী বলেন, ঘুমের সময় হিপোক্যাম্পাস পুরোনো স্মৃতি মস্তিষ্কের অন্য অংশে পাঠায়, কিন্তু নতুন কোনো তথ্য গ্রহণ করে না।
আরেকটা কারণ হলো, ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থ অ্যাসিটাইলকোলিন আর নোর–অ্যাড্রেনালিনের পরিমাণ অনেক কমে যায়। অ্যাসিটাইলকোলিন পরে আবার স্বাভাবিক স্তরে ফিরে আসে, কিন্তু নোর–অ্যাড্রেনালিন থাকে কম। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই অদ্ভুত মিশ্রণই আমাদের স্বপ্ন ভুলে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
তবে সব স্বপ্ন এক রকম নয়। যেমন সকালে দাঁত ব্রাশ করার সময় কী কী ভাবছিলে, তা মনে থাকে না। কারণ, এসব ভাবনা অতি সাধারণ আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেক স্বপ্নও এ রকম। একঘেয়ে, এলোমেলো বা আবেগহীন স্বপ্ন মস্তিষ্ক মনে রাখার প্রয়োজন মনে করে না। কিন্তু যদি স্বপ্নটা অনেক বেশি আবেগময়, ভয়ানক বা নাটকীয় হয়, তাহলে সেটা মনে থাকার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, এমন স্বপ্ন আমাদের মাঝরাতে জাগিয়ে দিতে পারে। আর সে সময় মস্তিষ্কে স্মৃতি জমা হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
স্বপ্ন মনে রাখতে চাইলে কিছু পদ্ধতি কাজে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের মনোরোগবিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক রবার্ট স্টিকগোল্ড রাতে ঘুমানোর আগে একটু বেশি পানি পান করার পরামর্শ দিয়েছেন। এতে মাঝরাতে বাথরুমে যাওয়ার জন্য ঘুম ভাঙবে। আর সে সময় স্বপ্ন মনে পড়তে পারে। আবার ঘুমাতে যাওয়ার আগে মনে মনে বলতে পারো, আমি স্বপ্ন মনে রাখব। আর ঘুম ভাঙার পর সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলো না বা নড়াচড়া কোরো না। যতক্ষণ পারো, চুপচাপ শুয়ে থেকে স্বপ্নটা মনে করার চেষ্টা কোরো। এতে হিপোক্যাম্পাস স্মৃতিটুকু ধরে রাখার একটু সময় পাবে।
তবে এমন পরীক্ষা করে তোমাকে যে স্বপ্ন মনে রাখতেই হবে, তেমন কোনো কথা নেই। তোমার যদি মনে হয়, তুমি কখনো স্বপ্ন দেখো না, তাহলে একটু চেষ্টা চালিয়ে দেখতে পারো।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স