ঢাকা কমিক্স ১০ বছর হলো। ঢাকা কমিক্সের কর্ণধার মেহেদী হক এ নিয়ে লিখলেই বরং ভালো হতো। কিন্তু ঘটনাচক্রে আমাকে লিখতে হচ্ছে। কারণ, সম্ভবত এর পূর্ব ইতিহাসের সঙ্গে আমিও বোধ হয় কিছুটা জড়িত। আমি কার্টুন আঁকতাম। সব কার্টুনিস্টই একসময় কমিকস আঁকা শুরু করে। সেই অলিখিত ফর্মুলায় আমিও বোধ করি একসময় কমিকস আঁকা শুরু করলাম। বেশ কিছু কমিকস চরিত্র নিয়ে এদিক–ওদিক আঁকি বা আঁকার চেষ্টা করি। কিন্তু কমিকস ছাপার ব্যাপারে কেউ খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। মেহেদী তখন উন্মাদ-এ আঁকত। বয়স খুবই কম। একদিন সে একটা পুরো কমিকস এঁকে নিয়ে এল। ওর আঁকা সেই গোড়া থেকেই সুন্দর। ওর প্রথম কমিকস দেখে আমরা মুগ্ধ। কিন্তু উন্মাদ-এ তো আর কমিকস ছাপা হয় না। কী করা? সেই কমিকসটি পাঠানো হলো মোটামুটি পরিচিত এক প্রকাশকের কাছে। কমিকসটি সিরিয়াস টাইপের একটা অ্যাডভেঞ্চার টাইপ কাহিনি। যদ্দুর মনে পড়ে কাহিনিটা ছিল এমন, গল্পের একটা চরিত্র হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের সেই প্রকাশকও মেহেদীর কমিকস নিয়ে উধাও হয়ে গেল। এই লেখা পর্যন্ত তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
মেহেদী হতাশ, আমিও হতাশ। মূল ক্রিমিনাল আমি। কারণ, আমিই ওই প্রকাশককে দিয়েছিলাম কমিকসটা। এখন কী করা? মেহেদীর প্রথম কমিকসটা রীতিমতো অদৃশ্য হয়ে গেল। যখনকার কথা বলছি, তখন ঘরে ঘরে বা অফিসে অফিসে কম্পিউটারের এত চল ছিল না। কাজেই হার্ডডিস্ক থেকে উদ্ধার করা হবে, এ রকম সম্ভাবনাও শূন্য। তা ছাড়া পুরো কমিকসটা ম্যানুয়ালি মেহেদীর হাতে আঁকা।
যখনকার কথা বলছি, তখন এক–দুজন ছাড়া কেউ কমিকস ছাপতে চায় না। শেষ পর্যন্ত আমি মেহেদীকে বললাম:
—মেহেদী, এক কাজ করলে হয় না?
—কী কাজ?
—নিজেরাই একটা কমিকস প্রতিষ্ঠান খুলে বসি চলো। নিজেদের কমিকস নিজেরাই ছাপব।
মেহেদী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল...না, ভুল বললাম দীর্ঘতম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তাকে খুব উত্সাহী মনে হলো না। কিন্তু পরদিন সে হন্তদন্ত হয়ে ধানমন্ডির ১৯ নম্বর রোডের উন্মাদ অফিসে এসে হাজির। যথেষ্ট উত্তেজিত মনে হলো তাকে।
—আহসান ভাই, নাম ঠিক করেন।
—কিসের নাম?
—কমিকস প্রতিষ্ঠানের নাম। আমাদের কমিকস আমরাই বের করব।
—ওহ্ দারুণ!
সবাই হইহই করে উঠল। সেদিন অফিসে ছিল লেখক হাসান খুরশীদ রুমী, এটিএন নিউজের কাজী তাপস, লেখক কাম ডাক্তার কল্লোল, ছড়া লেখক রোমেন রায়হান...এ রকম আরও অনেকে।
‘আমাদের কমিকস আমরাই বের করব।’ মেহেদীর কথাই আমার মনে পড়ল। একবার আমরা কয়েক বন্ধু কাজীদার (কাজী আনোয়ার হোসেন) কাছে গিয়েছিলাম একটা ইন্টারভিউয়ের জন্য। তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন:
‘আমি এখানে–ওখানে লিখতে লিখতে লেখক হয়ে উঠিনি। আমি যা লিখেছি, তা নিজেই ছেপেছি।’
আমার তখন মনে হয়েছিল আরে কী আশ্চর্য, উন্মাদও তো তা–ই। আমি এখানে–ওখানে আঁকতে আঁকতে কার্টুনিস্ট হয়ে উঠিনি। নিজেরা যা এঁকেছি, সেটা নিজেদের পত্রিকায় (উন্মাদ) ছাপতে ছাপতে কার্টুনিস্ট হয়ে উঠেছি।
এখন মেহেদীও তা–ই বলল...নিজেদের কমিকস নিজেরাই ছাপাতে ছাপতে আমরা একদিন দেশের সেরা কমিকস আর্টিস্ট হয়ে উঠব এবং আমাদের প্রতিষ্ঠান হবে কমিকসের সেরা প্রতিষ্ঠান। তা–ই হয়েছে।
এবার আসা যাক ঢাকা কমিক্সের নামের ব্যাপারটায়, কীভাবে এল এই নাম? অনেক ধরনের নামই এসেছিল। সবশেষে বিস্তর আলোচনা–সমালোচনা–পর্যালোচনায় ফাইনাল হলো ‘বাংলাদেশ কমিকস’। পরে আবারও অনেক আলাপ–আলোচনা (শিঙাড়া, পুরি, চা আরও কী সব হাবিজাবি ধ্বংস) করে ঠিক হলো, নাম হবে ‘ঢাকা কমিক্স’। ঢাকা থেকেই যেহেতু বের হবে, তখন ঢাকা কমিক্সই ঠিক আছে। পৃথিবীর কমিকস ওয়ার্ল্ডে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে চেনানোও আমাদের একটা পবিত্র দায়িত্ব হতে বাধা কোথায়?
মেঘে মেঘে ঢাকা কমিক্সের বেলা কম হয়নি। সত্যি ১০ বছর পর যখন পেছনের দিকে তাকাই, তখন দেশের বাংলা কমিকসের সাফল্য ছাড়া তো আর কিছু দেখি না এবং এর সবটুকুই অলরাউন্ডার কার্টুনিস্ট মেহেদী হকের একক ক্রেডিটই বলব। ইতিমধ্যে সে ‘কমিকসের রাজপুত্র’ বলে তার অদৃশ্য মুকুটে একটা পালক গুঁজে নিয়েছে। ভারত থেকে কমিকসের সেরা পুরস্কার ‘নারায়ণ দেবনাথ পদক’ নিয়ে এসেছে। জয়তু ঢাকা কমিক্সের কর্ণধার মেহেদী হক!
তবে সবকিছুরই একটা ফান পার্ট থাকে। এটা দিয়েই শেষ করি। ঢাকা কমিক্সের তখন মার মার কাট কাট অবস্থা। সব পত্রিকা স্ট্যান্ডে ঢাকা কমিক্সের কমিকস পাওয়া যায়। একদিন উন্মাদ–এর সার্কুলেশনের দায়িত্বে যে আছে, সে এসে বলল:
—বস, খবর খারাপ।
—কী হইছে?
—পত্রিকা স্ট্যান্ডগুলাতে উন্মাদ–এর বিক্রি কইমা গেছে।
—ক্যান?
—ঢাকা কমিক্স বেশি বিক্রি হয়।
—হায় হায়! বলে কী! এ তো দেখি খাল কেটে কুমির...না ঢাকা কমিক্স এনেছি আমরা...কী করা। সব অফিসেই কিছু দুষ্টু লোক থাকে; উন্মাদ অফিসও তার ব্যতিক্রম নয়। তারা বুদ্ধি দিল, ‘চলেন বস, কুমিল্লা কমিকস নামে আমরাও কমিকস নামাই।’ এবার আমার দীর্ঘশ্বাস ফেলার পালা। সেই মেহেদীর মতো দীর্ঘতম দীর্ঘশ্বাস ফেলার সময় হয়েছে এবার আমারও।
তারপরও বলি, প্রিয় প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা কমিক্স’ এগিয়ে যাক আরও ১০ বছর...এবং এরপর আরও ১০ বছর...এবং আরও...।