পাসপোর্ট এল কেমন করে

সম্ভাবনা আছে এই লেখা তুমি পড়ছ স্মার্টফোনে। সবার হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। এই ডিভাইস আসার আগে ফিচার ফোন ব্যবহার করত সবাই। কিন্তু তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করি, বলো তো, কবে মানুষ ফিচার ফোন ব্যবহার করা শুরু করে? তোমার বয়স যদি ১২ বছরের মধ্যে হয়, তবে সম্ভাবনা আছে তুমি বলবে, ১০০ বছর আগে। আসলে ১০০ বছর আগে কোনো মোবাইল ফোনই ছিল না।

পাসপোর্টের বিষয়টিও এমন। তোমার মনে হতে পারে, পাসপোর্ট কবে আবিষ্কৃত হলো? নিশ্চয়ই বহু বহু বছর আগে। দেশ যত দিন ধরে আছে, পাসপোর্ট নিশ্চয়ই তত দিন ধরেই আছে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাসপোর্ট ছাড়া তো যাওয়াই যায় না। কিন্তু আসলেই কি তা–ই? এক দিক থেকে তোমার অনুমান সত্যি। তবে আধুনিক পাসপোর্ট শুরু হয়েছে মাত্র ১০০ বছর আগে।

১৯২০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয় পাসপোর্টের ব্যবহার। জাতিসংঘের আগের নাম ছিল লিগ অব নেশনস। বিশ্বব্যাপী শান্তি বজায় রাখার জন্য পাসপোর্টের ধারণাটি বাস্তবায়ন করা হয়। লাখ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শান্তি বজায় রাখার জন্য সমাধান খুঁজছিল অনেক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা তাঁদের দেশে অভিবাসীদের স্রোত কমানোর জন্য পাসপোর্ট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। এভাবে ১৯২১ সালে ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট পাস করে যুক্তরাষ্ট্র। আইনটি জরুরি কোটা আইন নামেও পরিচিত। এই আইন দিয়ে অন্য কোনো দেশ থেকে আসা অভিবাসীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

সাফল্যও আসে রাতারাতি। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০ সালে অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৮,০৫,২২৮। ১৯২২ সালে এই সংখ্যা কমে হয় ৩,০৯,৫৫৬।

দেশের সীমানা ও শাসকের ধারণা প্রথম যখন শুরু হয়, পাসপোর্টের ধারণাও আসে তখন থেকেই। তখন অবশ্য পাসপোর্ট শব্দটি ছিল না, বলা হতো ট্রাভেল ডকুমেন্ট। এই ডকুমেন্টের কথা প্রথম পাওয়া যায় হিব্রু বাইবেলে। বুক অব নেহেমিয়া বা নেহেমিয়ার স্মৃতিকথায় পাসপোর্টের ধারণার কথা লেখা আছে।

প্রাচীন পারস্যের রাজা আরটাক্সারেক্সেসের সময়ের কথা। ৪৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে নেহেমিয়া নামে একজন প্রফেট ছিলেন। যিনি রাজার কাপ বহনকারী বা রাজকীয় টেবিলে পানীয় ঢালার কাজ করতেন। রাজা তাঁর জন্য চিঠি স্বাক্ষর করেছিলেন। এই চিঠির উদ্দেশ্য ছিল, ইউফ্রেটিস থেকে জুডোতে নিরাপদে যাওয়ার জন্য পথে যে দেশগুলো পড়ে, সেখানে তিনি যেন নিরাপদ থাকেন। নেহেমিয়ার ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল জেরুজালেমের প্রাচীর পুনর্নির্মাণ করা।

এরপর ব্রিটেনে ১৪১৪ সালে পার্লামেন্টের একটি আইনে হেনরি পঞ্চমের শাসনামলে একটি ‘নিরাপদ আচরণ’ নথির কথা জানা যায়। এটি ছিল রাজকীয় নথি। রাজা যে কারও জন্য এই নথি ইস্যু করতে পারতেন। এ জন্য ইংরেজ হওয়ার প্রয়োজন ছিল না।

অন্য কোনো দেশে গেলে ইমিগ্রেশন কর্মীরা প্রথমেই চায় পাসপোর্ট। পাসপোর্ট দিয়ে সবার পরিচয় যাচাই করে ইমিগ্রেশন। কোন দেশের নাগরিক, তা লিখে রাখা হয়। তুমি যে দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করবে, ধরা হয়, নাগরিক হিসেবে তোমাকে সেই দেশের সরকার সুরক্ষা দেবে।

ফরাসি ভাষায় পোর্টেস ইংরেজিতে পাসপোর্ট। এর অর্থ নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ বলেন, পোর্ট থেকে পোর্টেস এসেছে। পোর্টেস মানে সমুদ্রবন্দর বা শহরের প্রাচীর। ইংল্যান্ডের রাজা ১৬৪১ সালের ১৮ জুন একটি পাসপোর্ট জারি করেছিলেন। যেটির নমুনা এখনো আছে। ১৭৯৪ সাল থেকে সেক্রেটারি অব স্টেট অফিস থেকে পাসপোর্ট ইস্যু করা শুরু হয়। এই সময় থেকে ইস্যু করা প্রতিটি ব্রিটিশ পাসপোর্টের রেকর্ড আছে। বিদেশি নাগরিকেরাও এই পাসপোর্ট পেতেন। ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত পাসপোর্ট ফরাসি ভাষায় লেখা হতো। তখন পাসপোর্ট ব্রিটিশ পরিচয়পত্র হিসেবে কাজে লাগত। অবশ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়নি।

প্রথম আধুনিক ব্রিটিশ পাসপোর্ট ছিল আট ভাঁজের একটি পৃষ্ঠা। ওপরে কার্ডবোর্ডের কভার। মেয়াদ ছিল দুই বছর। একটি ছবি থাকত। স্বাক্ষর করার জায়গা ছিল। মজার ব্যাপার ছিল, মুখের আকৃতি কেমন, কী বৈশিষ্ট্য আছে—এসবসহ একটি ব্যক্তিগত বিবরণ লেখা থাকত। কারও কপাল বিস্তৃত হলে লেখা থাকত—কপাল: চওড়া। নাক বড় আর চোখ ছোট হলে কী লেখা থাকত, বুঝতেই পারছ। কিন্তু কারও নাক থ্যাবড়া হলে তুমি তো তার পরিচয়পত্রে লিখে দিতে পারো না, নাক: থ্যাবড়া। তাই অনেকেই এই বিবরণগুলো পছন্দ করেনি।

তাই পাসপোর্টকে মানসম্মত করার জন্য লিগ অব নেশনসের মধ্যে একটি চুক্তির হয়। এরপর ১৯২০ সালে বিখ্যাত আগেকার দিনে নীল রঙের পাসপোর্ট ব্যবহার শুরু হয়। আর সবশেষে এখন আমরা পাই ই-পাসপোর্ট। এই পাসপোর্টে বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষিত থাকে। আঙুলের ছাপ, চোখের আইরিশ ইত্যাদি যে কাউকে আলাদাভাবে শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এই প্রযুক্তি প্রথম চালু করে মালয়েশিয়া। এরপর অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ড, বাংলাদেশসহ বহু দেশ এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে।