প্রতি চার বছর পরপর মানুষ আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। এর মধ্যে ঘুরেফিরে আসে আজব শব্দ—ইলেকটোরাল কলেজ। এটি কী? এটি কি কোনো পড়াশোনার জায়গা? নামের মধ্যে কলেজ আছে, তার মানে তো কলেজই হওয়া উচিত। আসলে এতে পড়াশোনার কোনো বিষয় নেই। যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার জন্য ইলেকটোরাল কলেজ–পদ্ধতি অনুসরণ করে। বিষয়টি খানিকটা বিভ্রান্তিকর। প্রক্রিয়াটি কীভাবে কাজ করে সেটি সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।
স্কুলে আমরা যেমন ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচন করি, বিষয়টির সঙ্গে ইলেকটোরাল কলেজের মিল আছে। ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনি জেতেন। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আরও জটিল। জনগণের ভোট সরাসরি কমলা হ্যারিস বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে যাবে না। এর বদলে তাঁদের কাছে ভোট যাবে ইলেকটোরাল কলেজের মধ্য দিয়ে। ইলেকটোরাল কলেজ হলো এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিত্বকারী নির্বাচকেরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন।
ইলেকটোরাল কলেজ হলো কয়েক শ মানুষের একটি দল, যারা নির্বাচক হিসেবে পরিচিত। নিজের রাজ্যের ভোটারদের পক্ষে ইলেকটররা কথা বলেন। তাঁরা সাধারণত রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন। কেউ রাজনৈতিক কর্মী, আবার কেউ কাজ করেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে । তুমি ইলেকটরকে দলের অধিনায়ক বা ক্লাস ক্যাপ্টেন ভাবতে পারো। যে ক্লাস ক্যাপ্টেন ছাত্রদের হয়ে শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে। প্রতিটি রাজ্যে বিভিন্ন সংখ্যক ইলেকটর বা নির্বাচক থাকেন। একজন ইলেকটরের ভোট একটি।
নির্বাচনের দিন সবাই নিজেদের রাজ্যে ভোট দেন। এ বছর ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভোটের দিন। ভোট দেওয়া শেষ হলে রাজ্যের কর্মকর্তারা সব ভোট গণনা করবেন।
ঝামেলা শুরু হয় এখানেই। নিয়ম অনুযায়ী যে প্রার্থী কোনো রাজ্যে সর্বাধিক ভোট জিতবেন, তিনি ওই রাজ্যের সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাবেন। মেইন এবং নেব্রাসকার হিসাব আলাদা। এই দুই জায়গায় ভোটের পদ্ধতি আলাদা। নিউইয়র্কে কোনো প্রার্থী যদি ৫১ শতাংশ ভোট পান, তবে নিউইয়র্কের ২৮টি ইলেকটোরাল ভোটের সব কটিই তিনি পাবেন।
কোন রাজ্যে কত ইলেকটোরাল ভোট হবে তা নির্ভর করে রাজ্যের জনসংখ্যার ওপর। যে রাজ্যগুলোতে বেশি মানুষ বাস করেন, সেখানে ইলেকটোরাল ভোট বেশি। যেমন ক্যালিফোর্নিয়ায় ৫৪ জন ইলোকটোরেট, টেক্সাসে ৪০ জন। আলাস্কা ও ডেলাওয়ারে জনসংখ্যা সবচেয়ে কম। এখানে ইলেকটোরাল ভোট মাত্র তিনটি। তুমি যদি সব রাজ্য, মানে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যের সব ইলেকটোরাল ভোট যোগ করো, তাহলে মোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোট হবে।
ইলেকটোরাল কলেজ থাকার সুবিধা হলো, প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীদের পুরো দেশে মোট কত ভোট জিতলেন সেটি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট জিতলেই হবে। ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোটের অর্ধেকের কিছু বেশি আর কি।
প্রায় প্রতিটি রাজ্যে আইন আছে—ওই রাজ্যের বাসিন্দারা নিজ রাজ্য মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দিতে বাধ্য। অর্থাৎ প্রতিটি রাজ্যে ভোট গণনা করলেই আমরা বুঝে যাব কে প্রেসিডেন্ট পদে জিতেছেন। এরপর রাজ্যগুলো ফলাফল নিশ্চিত করবে। ১৭ ডিসেম্বর ইলেকটররা আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের ভোট দেওয়ার জন্য একত্র হবেন। ৬ জানুয়ারি কংগ্রেস ফলাফল গণনা ও নিশ্চিত করবে। ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নেবেন।
এখন তোমার মনে হতে পারে, এত প্যাঁচানোর দরকার কি? এভাবে কেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে?
ইলেকটোরাল কলেজ রাখার কারণ জানতে হলে ফিরতে হবে আমেরিকার প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে। নতুন দেশে কীভাবে একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হবে তা নিয়ে দ্বিমত ছিল। কারও মত ছিল শুধু কংগ্রেসের সদস্যরাই ভোট দেবেন। আবার কেউ কেউ মনে করতেন, দেশের সবারই প্রেসিডেন্ট পদে ভোট দেওয়া উচিত। আরেক দলের চিন্তা ছিল, যেসব রাজ্যে বেশি মানুষ থাকবেন, তাঁরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অনেক বেশি ক্ষমতা পাবেন। তাই সবাই মিলে সবার মত রক্ষা করার পদ্ধতি হিসেবে আনলেন ইলেকটোরাল কলেজ।
২৩৭ বছরের পুরোনো এই ব্যবস্থাকে সবাই ন্যায্য মনে করেন না। কেউ কেউ মনে করেন, কয়েকটি ‘সুইং স্টেটের’ ভোটারদের ক্ষমতা খুব বেশি। যেসব রাজ্যে শেষ মুহূর্তে ঠিক হয়, কোন প্রার্থী এই রাজ্যে জিতবেন, সেটিই সুইং স্টেট। এই মতের লোকেরা মনে করেন, সবচেয়ে বেশি ভোট যিনি পাবেন, তিনিই জিতবেন। সব সময় বেশি ভোট পেয়ে জেতা যায়নি। ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ বেশি ভোট পেয়েছিলেন। তবে মাত্র ২৩২টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে নির্বাচনে হেরে যান। রাজনীতিবিদ ও অ্যাক্টিভিস্টরা এই পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছেন; কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউই এই পরিবর্তন করতে পারেননি। এখনো ইলেকটোরাল কলেজ–পদ্ধতি আমেরিকান গণতন্ত্রে কাজ করে। এভাবেই এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস