মানুষ যেমন সমাজে পরিবার নিয়ে বাস করে, তেমনটা আছে প্রাণীদের মধ্যেও। আমাদের মতো প্রাণীদেরও রয়েছে সমাজব্যবস্থা। কোনো প্রাণীর পরিবারের প্রধান পুরুষ, আবার কোনোটার নারী। আজ আমরা জানব মাতৃতান্ত্রিক প্রাণীদের কথা।
বেশির ভাগ মাতৃতান্ত্রিক প্রাণীই স্তন্যপায়ী। এদের আয়ু সাধারণত বেশি হয় এবং সন্তান জন্ম দেয় কম। তবে সব নারী প্রাণী একভাবে দল পরিচালনা করে না। যেমন নারী হায়েনারা জোট গঠন করে পুরুষ হায়েনাদের কাবু করে রাখে। আবার আফ্রিকান নারী হাতিরা জোর না করে বরং বুদ্ধি দিয়ে পুরুষ হাতিদের সঙ্গে বোঝাপোড়া করে। এবার চলো, মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ৫টি প্রাণী সম্পর্কে জানা যাক।
পৃথিবীর বৃহত্তম স্থলজ প্রাণী হলো আফ্রিকান সাভানা হাতি। নিঃসন্দেহে হাতির প্রজাতির মধ্যেও সবচেয়ে বড়। আফ্রিকান এই হাতির রয়েছে বিভিন্ন দল বা পাল। প্রতিটি পালে থাকে শতাধিক হাতি। এর মধ্যে প্রায় ১০টি নারী হাতি তাদের বাচ্চাদের নিয়ে থাকে। সব কটি পালের দায়িত্বেই থাকে একেকটি নারী হাতি। আবার এই সব কটি পালের মানে পুরো আফ্রিকান হাতিদের মধ্যে থাকে একটা প্রধান নারী হাতি। সাধারণত হাতিদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক হাতিটি প্রধান হয়ে থাকে।
হাতিরা কোথায় যাবে, কীভাবে, কোন পথ ধরে যাবে, এসব এই প্রধান হাতিই ঠিক করে। কোনো সংকটে পড়লেও হাতিদের উদ্ধার করার দায়িত্ব পালন করে প্রধান হাতিটি। এটা কিন্তু সহজ কোনো দায়িত্ব নয়। প্রতিদিনের খাবার ও জলপানের ব্যবস্থা করতে করতে সারা দিন চলে যায় তার। একেকটি হাতির প্রতিদিন প্রায় ১৪০ কেজি গাছপালা ও ১৯০ লিটার পানি প্রয়োজন। সম্পূর্ণ দলের জন্য এসবের ব্যবস্থা করা সহজ কথা নয়।
যদিও প্রধান হাতি সব হাতির জন্য খাবার এনে এক জায়গায় জড়ো করে না। সবাই নিজের নিজের মতো করেই গাছপালা ও পানি খায়। কিন্তু কোথায় শিকারি বসে নেই, তা হিসাব করে খুঁজে বের করতে হয় প্রধান হাতিকেই।
অনেক সময় নেতৃত্ব দখল করতে প্রধান হাতির সঙ্গে অন্য নারী হাতির তুমুল মারামারি হয়। মাঝেমধ্যে তো প্রধান হাতি মারাও যায়। তখন তৈরি হয় শূন্যস্থান। ফলে আবার দলের সবচেয়ে বয়স্ক নারী হাতিকে প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মৌচাকে যে ছোট ছোট মৌমাছি দেখ, তার সব কটি কিন্তু এক রকম নয়। একটা মৌচাকে সাধারণত তিন ধরনের মৌমাছি দেখা যায়। এর মধ্যে একটা হলো কর্মী মৌমাছি। ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ করতে হলে এই কর্মী মৌমাছি যাবে। মৌচাক তৈরি করতে হলেও কর্মী মৌমাছির ডাক পড়বে। এরা নারী মৌমাছি হলেও বন্ধ্যা। বাচ্চা ফোটাতে পারে না। তাই এদের সব সময় খাটতে হয়। আরেকটা হলো পুরুষ মৌমাছি। এদের তেমন কোনো কাজ নেই। রানি মৌমাছির সঙ্গে সময় কাটানোই এদের একমাত্র কাজ। রানি মৌমাছি হলো দলের প্রধান। একটা মৌচাকে মাত্র একটা রানি মৌমাছি থাকে। পুরুষ মৌমাছির সঙ্গে সময় কাটানো ও ডিম পাড়া এর কাজ।
একটি রানি মৌমাছি বছরে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ডিম পাড়ে। আর পুরো জীবনে ডিম পাড়তে পারে ১০ লাখের বেশি। একটা রানি মৌমাছি বাঁচে প্রায় পাঁচ বছর। মৃত্যুর আগে আবার একটা রানি মৌমাছিকে সব দায়িত্ব দিয়ে যায় সে। একের বেশি রানি মৌমাছি জন্মালে মেরে ফেলা হয় যেকোনো একটিকে। একটা মৌমাছিকে বেছে নিয়ে সেটাকে ভালো ভালো খাইয়ে বড় করে তোলা হয়। সেটিই পরে নতুন রানি হিসেবে পরিচিত হয়।
এই প্রাণী অত্যন্ত সামাজিক ও বুদ্ধিমান। এদের মধ্যেও কোনো নারী হায়েনা দলের দেখাশোনা করে। প্রতিটি দলে ৬ থেকে ৯০টি হায়েনা থাকে। পুরুষ ও নারী হায়েনাদের মধ্যে আকারে তেমন পার্থক্য না থাকলেও নারী হায়েনা অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হয়। এদের শক্তিও থাকে পুরুষ হায়েনার চেয়ে কিছুটা বেশি।
হায়েনা কিন্তু অনেক বুদ্ধিমান। দেখতে অনেকটা কুকুরের মতো। কিন্তু এই আকার নিয়েও এরা বাঘ বা সিংহের খাবার চুরি করে। বনের রাজার খাবার চুরি করা তো আর সহজ কথা নয়। অনেক সময় হায়েনাদের দলে সদস্য বেশি থাকলে এরা ডাকাতি করে। মানে বাঘ বা সিংহ কোনো পশু শিকার করলে, এরা গিয়ে হামলা করে শিকার কেড়ে নেয়।
অর্কা বা ঘাতক তিমি শুশুক পরিবারের সবচেয়ে বড় প্রাণী। সাদাকালো এই ঘাতক তিমি দেখতে সম্ভবত সবচেয়ে সুন্দর। উত্তর মহাসাগর থেকে দক্ষিণ মহাসাগর পর্যন্ত সবখানে এদের দেখা পাওয়া যায়। সমুদ্রের শিকারিদের মধ্যে এরা অন্যতম। এদের দলে একসঙ্গে ২০টির বেশি অর্কা থাকতে পারে। এদের প্রধান নারী সদস্য আক্রমণের সময় নেতৃত্বে থাকে।
একটা প্রাপ্তবয়স্ক ঘাতক তিমি ২৩ থেকে ৩২ ফুট লম্বা হতে পারে। ওজন হয় প্রায় ৬ টন। এরা ৫০ থেকে ৮০ বছর বেঁচে থাকে। বেশির ভাগ অর্কা ছোট মাছ খায়। তবে কিছু কিছু অর্কা আবার সিলমাছ ও শুশুকের ছোট প্রজাতিও খায়। এরা নিজেদের পছন্দমতো সমুদ্রে শিকার করে বেড়ায়। কারণ, এদের শিকার করার মতো কোনো প্রাণী সমুদ্রে নেই।
এই প্রাণী দেখতে অনেকটা ভূতের মতো! রাতের আঁধারে এদের মুখে আলো ফেললে তোমার তা-ই মনে হবে। লাতিন ‘লেমুর’ শব্দের অর্থ ‘ভূতের মতো’। এদের দেখতে পাওয়া যায় আফ্রিকায়। সম্ভবত সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে আফ্রিকার মাদাগাস্কারে এরা ছিল।
লেমুর সামাজিক প্রাণী ও দলগতভাবে বাস করে। প্রধাণত নারী লেমুরই দলের সর্বেসর্বা। এরা ঘ্রাণ ও বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। একটা দলে প্রায় ২৫টি লেমুর একসঙ্গে থাকে। অনেক সময় খাবার নিয়ে পুরুষ ও নারী লেমুরের মধ্যে আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা যায়। কিন্তু নারীদের সঙ্গে পুরুষ লেমুর পেরে ওঠে না। ফলে নারী লেমুরের কথাই মেনে নেয়।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স, অ্যানিমেল ডট প্ল্যানেটস