সাগরে ঘুরে বেড়ায় অজস্র ক্রিলের ঝাঁক। ক্রিল হলো একধরনের কুচো চিংড়ি। এরা সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায় ঝাঁক বেঁধে। প্রতিটি ঝাঁকে থাকে কোটি কোটি ক্রিল। টন টন ওজন এসব ঝাঁকের। এসব কুচো চিংড়ির প্রধান শত্রু বিভিন্ন প্রজাতির তিমি। একেকটা নীল তিমি দিনে ৩০ টন ক্রিল মাছ খায়। অর্থাৎ এগুলোর মিলিত ওজন সাতটা পুরুষ হাতির সমান!
১৯১০ থেকে ১৯৭০ দশক পর্যন্ত সারা বিশ্বে তিমির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে শুরু করে। কারণ, মানুষের চোরা শিকার। তিমির তেল ও মাংস অত্যন্ত উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। এর লোভেই বিশ্বজুড়ে চলে তিমির ধ্বংসযজ্ঞ। আশার কথা হলো, ১৯৭০-এর দশকের দিকে পরিবেশবাদীরা সচেতন হয়ে ওঠেন। পাস হয় তিমি শিকার বন্ধে প্রয়োজনীয় আইন। সারা বিশ্বের সরকারগুলো তিমি শিকারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আপাতত বিলুপ্তির হাত থেকে বেঁচে যায় তিমিরা।
কিন্তু মজার বিষয় অন্যখানে।
যখন তিমির সংখ্যা কমে যায়, তখন অনেক বিজ্ঞানীই ভেবেছিলেন যে বিশ্বের মহাসাগরগুলোয় ক্রিল মাছের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এই মাছের একটা বিস্ফোরণ আশা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেটা হয়নি। উল্টো ক্রিল মাছ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়।
এর কারণ কী?
অনুসন্ধানে নামেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। ২০১১ সালে। একটা বিস্ময়কর ফলাফল পাওয়া যায় তাঁদের গবেষণা থেকে। তাঁরা দেখেন যে ক্রিল কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে তিমি কমে যাওয়া। অর্থাৎ তিমি কমে গেলে আনুপাতিক হারে কমে যায় ক্রিল মাছও। আসলে ব্যাপারটা উল্টো হওয়ার কথা ছিল।
কেন এমনটা ঘটে?
এখানেই রয়েছে বাস্তুতন্ত্র বা খাদ্যশৃঙ্খলের সেই চিরন্তন সম্পর্ক। গবেষকেরা খুব ভালো করে অনুসন্ধান করে জানতে পারেন যে বিশাল বিশাল তিমি দিনে যে পরিমাণ ক্রিল মাছ খায়, তাদের মলত্যাগের পরিমাণও সে রকম বিশাল।
তিমি মলত্যাগ করার পর, সেগুলো পানিতে মিশে যায় বা জমা হয় সাগরের তলদেশে। এগুলো জৈবসার হিসেবে কাজ করে। ফলে সাগরের পানিতে সবুজ প্ল্যাঙ্কটনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আর এই প্ল্যাঙ্কটনই হলো ক্রিল মাছের প্রধান খাবার।
তাই বিশ্বজুড়ে যখন তিমির নিধনযজ্ঞ চলে, তখন আশঙ্কাজনকহারে কমে যায় ক্রিল মাছের সংখ্যা। কম তিমি মানেই তাদের মলত্যাগ কমে যাওয়া। আর মল কমে যাওয়ার ফলে কমে যায় প্ল্যাঙ্কটনের জন্য দরকারি জৈব সারের পরিমাণ। ফলে প্ল্যাঙ্কটনের সংখ্যাও কমে যায় উল্লেখযোগ্য হারে। খাবারের অভাবে থমকে যায় কুচো চিংড়ির বংশবিস্তার। কমে যায় মহাসাগরজুড়ে ক্রিলের সংখ্যা।
এই ব্যাপারটাই জীববিজ্ঞানে ক্রিল প্যারাডক্স নামে পরিচিতি পায়। যেখানে শিকারির মৃত্যুতে শিকারের সংখ্যা বাড়ার পরিবর্তে উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। অর্থাৎ একটা প্যারাডক্সের জন্ম দেয়। হিসাবটা এমন যে তিমির সংখ্যা বেশি মানে বেশি বেশি ক্রিল শিকার। ফলে কমে যায় ক্রিলের সংখ্যা। তাহলে তিমি মাছ কমে গেলে ক্রিলের সংখ্যা বাড়ার কথা। সেটা না হয়ে উল্টো তিমি মাছের সংখ্যার অনুপাতে কমে যায় ক্রিলের সংখ্যাও। পুরাই স্ববিরোধী বা প্যারাডক্স্যিাল ব্যাপার!
বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে এই প্যারাডক্স। আমরা প্রকৃতির অনেক কিছুকেই অপ্রয়োজনীয় ভেবে সেগুলো ধ্বংসে মেতে উঠি। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোরও কোনো না কোনো প্রয়োজন আছে প্রকৃতিতে। সেগুলো ধ্বংস করে নিজেরাই পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছি। তার ফলে হয়তো মানবসভ্যতাও একটু একটু করে হুমকির মুখে পড়ছে!