৩০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি আর বিরোধের মধ্য দিয়ে শেষ জলবায়ু সম্মেলন
আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৯-এর আলোচনা শেষ হয়েছে তীব্র বাদানুবাদের মধ্য দিয়ে। এর জন্য সময় লেগেছে অতিরিক্ত ৩৩ ঘণ্টা। অবস্থা এমন হয়েছিল যে আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
এ সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করতে বার্ষিক ৩০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এই অর্থের পরিমাণ নিয়ে সমালোচনা চলছে। দরিদ্র দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এই অর্থ যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাতিসংঘের জলবায়ু সংস্থার প্রধান সাইমন স্টিয়েল বলেছেন, ‘কঠিন হলেও আমরা একটি চুক্তি করতে পেরেছি।’
জলবায়ু সম্মেলনে এবারের আলোচনাগুলো গত বছরের চুক্তি মেনে এগোয়নি। গত বছর জ্বালানির উৎস হিসেবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছিল।
শনিবার বিকেলে উন্নয়নশীল এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো সম্মেলন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোটের চেয়ার (মুখপাত্র) সেড্রিক শুস্টার বলেছেন, ‘আমি বাড়িয়ে বলছি না। আমাদের দ্বীপগুলো ডুবে যাচ্ছে! কীভাবে আশা করেন আমরা আমাদের দেশের নারী, পুরুষ এবং শিশুদের কাছে এমন একটি দুর্বল চুক্তি নিয়ে ফিরে যাব?’
তবে স্থানীয় সময় রোববার ভোররাত তিনটায় চুক্তিতে কিছু পরিবর্তনের পর অংশ নেওয়া দেশগুলো চুক্তি অনুমোদন করে। তখন সদস্যরাষ্ট্রগুলো উল্লাস ও করতালির মাধ্যমে চুক্তিকে স্বাগত জানায়। তবে এই চুক্তিতে ভারত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে চুক্তি নিয়ে হতাশা রয়ে গেছে। সুইজারল্যান্ড, মালদ্বীপ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো অভিযোগ করেছে, এই চুক্তিতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বিষয়ে কথাগুলো খুব দুর্বল। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর সিদ্ধান্তটি ২০২৫ সালের পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনার জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে।
বার্ষিক ৩০০ বিলিয়ন ডলারের এই প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে দরিদ্র দেশগুলো স্বীকৃতি পেয়েছে। এই দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। অথচ দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা সবচেয়ে কম।
সরকারের অনুদান এবং বেসরকারি খাত থেকে আসবে ৩০০ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই অর্থসহায়তা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই অর্থ ব্যবহার করে দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে অগ্রসর হতে পারবে।
অবশ্য ২০০৯ সালের সম্মেলনে যে অর্থের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উপলব্ধ তহবিলের মাত্র ৪০ শতাংশ অনুদান দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচের কথা বলা হয়েছিল। এই চুক্তি শেষ হয়েছে এ বছর। ৩০০ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি ২০৩৫ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন বলে একমত হয়েছে দেশগুলো। এই বছর প্রায় নিশ্চিতভাবে (যেহেতু বছর এখনো শেষ হয়নি) সবচেয়ে উষ্ণ বছর হতে যাচ্ছে। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ এবং প্রাণঘাতী ঝড়ের কবলে পড়েছে বিশ্ব।
এবারের সম্মেলনের শুরুতে উদ্বোধনী দিনে আলোচিত বিষয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন। তিনি ১০ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি ট্রাম্প সন্দেহপ্রবণ। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি থেকে সরিয়ে নেবেন। প্যারিস সম্মেলনে দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য একটি রোডম্যাপ দিয়েছিল।
উন্নত দেশগুলো এ বিষয়ে খুব সচেতন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জলবায়ু তহবিলে এক পয়সাও দেবেন না। ফলে যে ঘাটতি তৈরি হবে, উন্নত দেশগুলোকে তা পূরণ করতে হবে। ফলে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হবে।
এবারের সম্মেলনকে বিশেষজ্ঞরা দেখছেন উন্নত দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে এটি ‘ত্রুটিপূর্ণ আপস’ হিসেবে।
২০২৫ সালে ব্রাজিলের বেলেম শহর কপ৩০ অনুষ্ঠিত হবে। এ সম্মেলন নিয়ে দেশগুলো আশাবাদী। কারণ, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমাজন রেইনফরেস্টের বন উজাড় কমানোর লক্ষ্যে কাজ করছেন তিনি।
এবারের জলবায়ু সম্মেলনের ছিল আজারবাইজানের বাকু শহরে। আজারবাইজান পুরোপুরি একটি জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশ। ভূরাজনৈতিক কারণে এবার তারা জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজনের সুযোগ পেয়েছে।
বিবিসি অবলম্বনে