মানুষ তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কত কিছুই করে। নিষ্ঠুর শাসকেরা যুদ্ধে জড়ায়। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ইয়েমেনে যুদ্ধে জড়িয়েছে হুতি বিদ্রোহী আর সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ও দেশটির সরকার। ফিলিস্তিনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধ বাধিয়েছে ইসরায়েল। পশ্চিমারা তাতে মৌন সমর্থন দিচ্ছে। আর ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণ করতে যুদ্ধে জড়িয়েছে রাশিয়া। এই যুদ্ধের দুই বছর পূর্তি হয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারি।
রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। কথাটা এ আধুনিক সময়ে এসেও সত্য। আজ থেকে তিন বছর আগেও কি কেউ ভাবতে পেরেছিল, এ সময়ের অন্যতম আধুনিকতার ধারক–বাহক ইউরোপের দেশগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে? এই যুদ্ধ শুরুর পর গোটা ইউরোপের মানুষ অবাক হয়েছে, হতাশা প্রকাশ করেছে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে। কিন্তু ওই যে বললাম, শাসক। যুদ্ধ আসলে শাসকদের ইচ্ছা–অনিচ্ছার ব্যাপার। কিন্তু ক্ষতি হয় কাদের? আসলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষেরা। সত্যিকার অর্থেই তাই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক নানা গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছে, দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষেরা যুদ্ধ চায় না। আর চাইবেই–বা কেন? এই দুই দেশ তো একসময় একসঙ্গে ছিল। অনেকের ক্ষেত্রে তো এমনও হয়েছে যে স্বামী রাশিয়ায় থাকেন আর স্ত্রী থাকেন ইউক্রেনে। সীমান্তবর্তী এলাকায় এমন অনেক মানুষের বসবাস ছিল, যাঁরা প্রায়ই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আরেক দেশে যেতেন। কিন্তু এই যুদ্ধ তাঁদের জীবন বদলে দিয়েছে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া তো দূরের কথা, সীমান্ত এলাকায় এখন থাকাই দায়। ফলে উদ্বাস্তু হয়েছেন।
জার্মানভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর ১ কোটি ৭০ লাখ ইউক্রেনীয় বিভিন্ন সময় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এর মধ্যে অনেকে আবার ফিরেও এসেছেন। আর জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, যুদ্ধ শুরুর পর গত দুই বছরে ৩৭ লাখ মানুষ ভিটেমাটি ছেড়েছে, তবে নিজ দেশের ভেতরেই আছে। ৬৫ লাখ মানুষ দেশ ছেড়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার ফলকার তুর্ক এই যুদ্ধের দুই বছর পূর্তিতে বলেছেন, আসলে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আর ফেরেনি।
সংখ্যাটা আমাদের কাছে কম মনে হতে পারে। ইউক্রেনের জনসংখ্যার হিসাবটা জানলে সংখ্যাটা বোঝা সহজ হয়ে যাবে। দেশটির জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে চার কোটি। অর্থাৎ প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ তার ঘর হারিয়েছে।
এবার আসা যাক শিশুর হিসাবে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছ ২২ লাখ শিশু। এই শিশুদের অনেকেই তাদের মা-বাবাকে মরতে দেখেছে। কেউ হারিয়েছে বন্ধুকে। কেউ কেউ এখন আছে আশ্রয়শিবিরে। তাদের খাবারসহ নানা ধরনের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।
যুদ্ধে সেনা যেমন মরে, তেমনি সাধারণ মানুষও মরে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ৩১ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। এর আগে ২০২২ সালের শেষ দিকে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিয়েছিল ইউক্রেন। সেই সময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক জানিয়েছিলেন, রুশ বাহিনীর হামলা শুরুর পর ১৩ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। তবে রাশিয়া দাবি করে থাকে ইউক্রেনের এই সংখ্যা আরও বেশি। আর এই যুদ্ধ শুরুর এক বছর পরই ইউক্রেন দাবি করেছিল, তাদের হাতে রাশিয়ার দেড় লাখ সেনা মারা পড়েছে। যদিও রাশিয়া এর কোনো হিসাব দেয় না। ফলে প্রকৃত সংখ্যা অনুমান করা কঠিন।
জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, এই যুদ্ধ ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে ১০ হাজারের বেশি। আর আহত হয়েছে প্রায় ২০ হাজার।
এ যুদ্ধের কারণ কী? কেনই–বা রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাচ্ছে। এ হামলার অন্যতম কারণ হলো নিরাপত্তা। রাশিয়া যেমন নিরাপত্তা চায়, তেমনি ইউক্রেনও নিরাপত্তা চায়। এ জন্য ইউক্রেন যেতে চায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোয়। আর এখানেই মূলত সংকট। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চান না তাঁর আশপাশের কোনো দেশ অর্থাৎ পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশ ন্যাটোয় যোগ দিক। আশপাশের কোনো দেশ ন্যাটোয় যোগ দিলে পুতিনের চিরশত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা তার দেশের পাশে চলে আসবে। এই অনিরাপত্তা পুতিন চান না। ফলে ইউক্রেন ন্যাটো জোটে যেতে তোড়জোড় শুরু করলে পুতিনও নিজের ক্ষমতা জানান দেওয়া শুরু করেন। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন শুরু করেন। একটা সময়, অর্থাৎ ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করেন। এই যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনের নিয়ন্ত্রণও নেয় রাশিয়া। যদিও সব এলাকার নিয়ন্ত্রণ এখন রুশ বাহিনীর হাতে নেই। তারপরও চারটি অঞ্চলকে নিজেদের মানচিত্রের সঙ্গে যুক্ত করেছে রাশিয়া।
এই করতে গিয়ে রাশিয়ার ক্ষতি কম হয়নি। তারা সেনা হারিয়েছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসে, অস্ত্র গেছে—সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আর দেশ রক্ষা করতে গিয়ে ইউক্রেনীয়রা জীবন দিয়েছে, দিচ্ছে এখনো। যুদ্ধের শুরুর দিকে ইউক্রেন শুধু আত্মরক্ষা করেছে। এখন সেই পরিস্থিতি নেই, আত্মরক্ষার পাশাপাশি রাশিয়ার বিভিন্ন স্থাপনায় হামলাও চালাচ্ছে। তবে সেটা সংযতভাবেই চালাচ্ছে। যেমন তারা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারে যে মূল কার্যালয়, সেখানে সরাসরি হামলা চালায়নি। ইউক্রেন এর আশপাশে, বিমানবন্দরের আশপাশে হামলা চালিয়ে। ইউক্রেন আসলে এটা বুঝিয়ে দিয়েছে—এসব স্থাপনায় হামলা চালানোর সক্ষমতা তাদের আছে। রাশিয়ার সামরিক স্থাপনা যেমন যুদ্ধজাহাজে হামলা চালাচ্ছে ইউক্রেন। তবে বেসামরিক কোনো স্থাপনা যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালে হামলা চালাচ্ছে না। মূলত এ কারণেই রাশিয়ায় সাধারণ মানুষ মরছে না। কিন্তু রাশিয়া অবশ্য তা করছে না। নির্বিচার হামলা চালাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ মরছে।
এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কী, এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিশ্লেষণের ওপর নজর দেওয়া যেতে পারে। তারা বলছে, ধারণা করা হচ্ছিল, পশ্চিমা দেশগুলোর অব্যাহত সমর্থনে ইউক্রেন বাহিনী রাশিয়াকে পিছু হটতে বাধ্য করবে। কিন্তু পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা। দেশটির পাঁচ ভাগের এক ভাগ ভূখণ্ড এখন রাশিয়ার দখলে। যুদ্ধে এখন সুবিধাজনক অবস্থানে রাশিয়া।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধের দুই বছর পূর্তিতে সেনাদের উদ্দেশে সরাসরি বলে দিয়েছেন, ‘আমরা জানি, কাজটা আপনাদের জন্য কঠিন। আপনাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা যেন পরিপূর্ণভাবে পালন করতে পারেন, সে জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তার সবকিছুই আমরা করব।’
অর্থাৎ পুতিন পিছু হটবেন না। এদিকে ইউক্রেনের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিরোধীদের চাপের মুখে পড়েছেন। ইউক্রেনের জন্য অর্থ দিতে গিয়ে খানিকটা বিপাকে পড়তে হচ্ছে বাইডেনকে। ফলে পশ্চিমা সহায়তা আটকে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র ও গোলাবারুদের সংকটে ভুগছে ইউক্রেন বাহিনী। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্রদের প্রতি দ্রুত সহায়তা পাঠানোর অনুরোধ জানাচ্ছেন। তবে খুব সুবিধা হচ্ছে না। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে ইউক্রেনের বাহিনী।
যুদ্ধ শুরুর পর ধারণা করা হচ্ছিল, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিলে বিপদে পড়বে দেশটি। কারণ, পশ্চিমাদের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখবে না, এতে ধসে পড়বে দেশটির অর্থনীতি, এমনটাই ধারণা ছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না। ইউরোপ-আমেরিকায় তেল বিক্রি বন্ধ হলেও তেল বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে যায় চীন–ভারতসহ কয়েকটি দেশে।
উল্টো চাপে পড়েছে ইউরোপের দেশগুলো। রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি না পাওয়ায় খরচ বেড়েছে। আর জ্বালানিতে খরচ বাড়া মানে হলো উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া। বলা হচ্ছে, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নাভিশ্বাস উঠেছে ইউরোপে বসবাসরত মানুষদের। কোনো কোনো পণ্যের দাম দেড় গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।
এদিকে ইউরোপের মানুষেরাও এই চাপ আর নিতে চাইছে না। যেমন সম্প্রতি ইউক্রেনের কৃষিপণ্যকে সুবিধা দেওয়ার জন্য একটি আইন পাস করার উদ্যোগ নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই আইন পাসকে ঘিরে রাস্তায় নেমে এসেছেন ইউরোপের কৃষকেরা। তাঁরা বলছেন, ইউক্রেনকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া যাবে না।
জেলেনস্কির ওপর আগে থেকে খেপে আছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২৪ সালের দিকে মার্কিন নির্বাচনে তিনি যদি জিতে যান তবে ইউক্রেনের সাহায্য পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। আবার মিত্রদেশের নাগরিকেরা এখন আর ইউক্রেনের পাশে থাকতে চাইছে না। অর্থাৎ ইউক্রেন আস্তে আস্তে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। ফলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ ইউক্রেন কত দিন চালিয়ে যেতে পারবে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। এ পরিস্থিতিতে একটি প্রশ্নই সামনে আসে, তাহলে কি রাশিয়া যুদ্ধে জিতে যাবে?
কথা হলো, এই আধুনিক সময়ে এসে যদি একটি দেশ অস্ত্রের মুখে পরাজিত হতে বাধ্য হয়, তাহলে সভ্যতা এগোল কোথায়? অস্ত্র কি এখন ক্ষমতার উৎস? শাসক কি এখন তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অস্ত্র ব্যবহার করেই যাবে? মানুষ আধুনিক হওয়ার অর্থ হলো, হানাহানি বন্ধ হওয়া, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে যাওয়া। সেটা হচ্ছে কোথায়? ইউক্রেনে যে শিশুটা রাশিয়ার হামলায় মা-বাবাকে হারাচ্ছে, তার ক্ষতিপূরণ কি এই পুতিন, এই জেলেনস্কি, এই বাইডেন দিতে পারবেন?