বছরের শেষ মাসটা সব সময়ই খুব স্পেশাল। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে লম্বা ছুটি তো পাওয়া যায় কেবল এই সময়েই। করোনায় উল্টেপাল্টে যাওয়া শিক্ষাবর্ষের কারণে গত কয়েক বছর এই ছুটিটা ঠিকঠাক টেরই পাওয়া যায়নি। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে ফিরেছে, ফিরেছে ছুটির আমেজটাও। বছরজুড়ে এত এত পড়াশোনা শেষে শীতের মৌসুমের এই ছুটিও তাই একটু বিশেষভাবেই কাটানো উচিত।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে নিশ্চয়ই ছুটি নিয়ে নানা পরিকল্পনা করে ফেলেছ তোমরা। কেউ যাচ্ছে নানুবাড়ি, আবার কেউ যাবে দাদুবাড়ি। কেউ কেউ হয়তো ভাবছ শুয়ে-বসেই কাটিয়ে দেব পুরো ছুটি। কারও আছে হাজারটা পরিকল্পনা। আমি অবশ্য ছুটির আগে বুঝেই উঠতে পারি না যে ছুটির সময় কোনটা ছেড়ে কোনটা করব।
তুমিও যদি আমার মতো দ্বিধায় থাকো, চলো, তোমাকে ছুটি কাটানোর কয়েকটা উপায় বাতলে দিই।
বই আর বই
এক-দেড় মাসের গোটা একটা ছুটি কেবল বই পড়েই কাটিয়ে দিয়েছিলাম একবার। কম্বলের নিচে দিন-রাত নতুন নতুন গল্পের বই পড়ে কাটাচ্ছি, কেউ কিছু বলছে না, ভাবতেই তো আনন্দ লাগে। ছুটিতে ধুলা ঝেড়ে বের করতে পারো তোমার না পড়া বইগুলো। বইয়ের দুনিয়াটা যদি তোমার কাছে নতুন হয়, তবে কিশোরদের জন্য লেখা জনপ্রিয় বইগুলো হতে পারে তোমার ছুটির সেরা সঙ্গী।
‘তিন গোয়েন্দা’, ‘ফেলুদা’ কিংবা ‘প্রফেসর শঙ্কু’র সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর হয় না। পড়তে পারো শিশু-কিশোরদের জন্য মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা আমি তপু, দীপু নাম্বার টু, টুকুনজিল, হাতকাটা রবিন, আমার বন্ধু রাশেদ, শান্তা পরিবার, কাবিল কোহকাফী, রাশাসহ অন্য বইগুলো। আম আঁটির ভেপু, রামের সুমতি, ফ্রাঙ্কেস্টাইন, উভচর মানব, টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি, আঙ্কেল টমস কেবিন, রবিনসন ক্রুসো, গালিভারস ট্রাভেলস-এর মতো চিরায়ত সাহিত্যগুলো পড়ে ফেলো এই ছুটিতে। গোটা ‘হ্যারি পটার’ সিরিজ পড়ে ফেলতে পারলে আরও দারুণ হয়। নন-ফিকশন পড়তে চাইলে উল্টে দেখতে পারো মসলার যুদ্ধ কিংবা সোফির জগৎ।
ছুটিতে পড়ার মতো আরও ১০০ বইয়ের সন্ধান দিই তোমাদের। ‘১০০ বইয়ের চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামের এই লেখায় পাবে তোমাদের জন্য সেরা ১০০ বইয়ের তালিকা।
দেখতে পারো
নেটফ্লিক্সের ‘মাই লিস্ট’-এ আমার অনেক সিনেমা জমে গেলে মনে হয় কাঁধে ভারী কী যেন একটা নিয়ে ঘুরছি। বারবার মনে হয়, বেছে রাখা সব কটি সিনেমা এখনই দেখে ফেলি। কিন্তু এত এত সিনেমা দেখে ফেলার সময় কই বলো। তোমারও যদি আমার মতো ‘পরে দেখব’ ভেবে জমিয়ে রাখা সিনেমার লিস্ট থাকে, তবে সেই লিস্ট খালি করার সবচেয়ে ভালো সময় এই ছুটি। লম্বা লিস্ট না থাকলেও খুঁজে খুঁজে দেখে ফেলতে পারো কিশোর উপযোগী সিনেমাগুলো। দাঁড়াও, তোমাকে কিছু সিনেমার নাম বলি।
দ্য আয়রন জায়ান্ট চলচ্চিত্রটি এক রোবট ও মানুষের বন্ধুত্বের গল্প। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা নির্মিত হয়েছে টেড হিউসের উপন্যাস দ্য আয়রন ম্যান অবলম্বনে। কাছাকাছি ধরনের আরেকটি চলচ্চিত্র কেভ দ্য ইয়েলো ডগ। ছোট্ট মেয়ে নানসাল আর তার কুকুরের গল্পটি প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা, সততা, নিষ্ঠার এক অমূল্য উদাহরণ।
তুমি যদি অ্যানিমে পছন্দ করো, তবে দেখতে পারো কিমি নো না ওয়া (ইয়োর নেম) ও স্পিরিটেড অ্যাওয়ে। জাপানের ভিন্ন দুই জায়গার একটি ছেলে ও একটি মেয়ের গল্প কিমি নো নো ওয়া। আর ১০ বছরের এক মেয়ের সুপারন্যাচারাল পাওয়ারের গল্প স্পিরিটেড অ্যাওয়ে। রহস্য ও অ্যাডভেঞ্চারে ঘেরা চলচ্চিত্র দুটি অ্যানিমে চলচ্চিত্রের জগতে বেশ জনপ্রিয়।
সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী, গুপি গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে, গুপি বাঘা ফিরে এল—সিনেমাগুলো যদি এখনো না দেখে থাকো, তবে এই ছুটিতে এগুলো একদমই মিস কোরো না। শিশু-কিশোরদের জন্য সেরা বাংলা চলচ্চিত্রের তালিকায় এই সিনেমাগুলো বেশ ওপরের দিকে আছে।
এ ছাড়া আরও যেসব সিনেমা দেখতে পারো এই ছুটিতে—দ্য সং অব দ্য সি (২০১৪), ওয়ালি (২০১৭), বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট (১৯৪৬), ওয়াজা (২০১২), দ্য হোয়াইট ব্যালুন (১৯৯৫), অলিভার টুইস্ট (১৯৪৮), শন দ্য শিপ দ্য মুভি (২০০৫), ফাইন্ডিং নিমো (২০০৫), মাই নেইবার তোতোরো (১৯৮৮), দ্য রেলওয়ে চিলড্রেন (১৯৭০), প্লে টাইম (১৯৬৭), সিঙ্গিং ইন দ্য রেইন (১৯৫২), বাইসাইকেল থিভস (১৯৪৮), ইটস আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ (১৯৪৬), দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব রবিনহুড (১৯৩৮), কিং কং (১৯৩৩)।
শিখে ফেলো নতুন কিছু
ছুটির এই সময়টা কাজে লাগিয়ে শিখে ফেলতে পারো নতুন কিছু। আচ্ছা, তুমি কি সাঁতার কাটতে পারো? না পারলে সাঁতারটা শিখে ফেলতে পারো এই ছুটিতে। সাঁতার শেখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শীতকালে সাঁতার শিখতে হলে একটু সাবধানে শেখো কিন্তু, বেশিক্ষণ পানিতে থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।
আরও যেটা শেখা যায়, সেটা হলো সাইক্লিং। আমার বন্ধুরা বেশ অল্প বয়সেই সাইকেল চালানো শিখে ফেলেছিল। ওরা শাঁ শাঁ করে সাইকেল চালাত, আমি শুধু বসে বসে দেখতাম। ক্লাস ফাইভের বার্ষিক পরীক্ষার ছুটিতে কোমর বেঁধে নেমেছিলাম সাইকেল চালানো শিখতে। দ্রুতই শিখে ফেলেছিলাম সাইকেল চালানো। একবার সাইকেল চালানো শিখে ফেলতে পারলে এটা তোমার সারা জীবন কাজে লাগবে।
রান্নায় যদি তোমার আগ্রহ থাকে, ছুটিতে শিখে ফেলো সেটাও। মা কিংবা বাবার সাহায্য নিয়ে রান্না করে ফেলো নতুন কিছু। অল্প অল্প করে শেখা শুরু করলে কিছুদিনের মধ্যেই দেখবে, তুমি হয়ে গেছ বাসার সেরা শেফ।
প্রোগ্রামিং, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট, ভিডিও এডিটিং ও গ্রাফিক ডিজাইনের মতো বিষয়গুলো বাসায় বসে ইন্টারনেটে থাকা নানা কোর্স দেখে শেখা শুরু করতে পারো। ইউটিউব, কোর্সেরা ও ইউডেমির মতো নানা ওয়েবসাইটে খুব সহজেই পেয়ে যাবে কোর্সগুলো। প্রযুক্তির এ সময়ে এই দক্ষতাগুলো তোমাকে এগিয়ে রাখবে অনেকটা।
ঘুরে বেড়াও
সমুদ্র নাকি পাহাড়, তোমার পছন্দ কোনটি? পাহাড় হোক আর সমুদ্র, যেকোনো জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য দারুণ একটা মৌসুম শীতকাল। ছুটি আর শীত দুটো মিলে ব্যাগ গোছানোর জন্য যথাযথ সময় এটাই। পরিবার কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে ছুটিতে ঘুরে আসতে পারো আশপাশে কিংবা দূরে কোথাও।
ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে গিয়ে দেশের মধ্যে ঘুরেফিরে কয়েকটি নামই চলে আসে। তাই জনবহুল দর্শনীয় স্থানগুলো এক পাশে রেখে নতুন কোথাও ঘুরে আসতে পারো। বন্ধুরা মিলে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে খুঁজে বের করে ফেলো এমন কোনো স্থান।
ট্যুরে বড় কাউকে অবশ্যই সঙ্গে রেখো। এমন কোথাও ঘুরতে যেয়ো না, যেখানে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা আছে। নিরাপত্তা সবার আগে। খেয়াল রাখবে এমন কিছু যেন না হয়, যা তোমার ছুটি ও ট্যুরের আনন্দ নষ্ট করে দেবে।
আর হ্যাঁ, ঘুরতে গিয়ে স্থানীয় খাবার খেয়ে আসতে ভুলো না কিন্তু।
ঘুম
কেবল আরাম করে ছুটিটা কাটিয়ে দিলেও কিন্তু খুব একটা খারাপ হয় না। সারা বছর ক্লাস, হোমওয়ার্ক, পরীক্ষার পর এক মাস তো একটু আরাম করাই যায়। তবে ঘুমিয়ে ও ভিডিও গেমস খেলতে খেলতে স্বাস্থ্যের দিকেও খেয়াল রেখো কিন্তু। বিকেলে মাঠে খেলতে যেয়ো, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ো, মা-বাবাকে বাসার কাজে সাহায্য কোরো। এতে ছুটিতে আরামও হবে, শরীরটাও ঠিক থাকবে। আরামের ফাঁকে ফাঁকে যদি একটু বই পড়া, সিনেমা দেখা, রান্না করা যায়, তবে ছুটিটা একদম ‘পারফেক্ট প্যাকেজ’ হয়ে যাবে! ছুটিতে কী কী করলে, ছুটি শেষে আমাদের জানিয়ো কিন্তু!