এত ওজন নিয়েও সুমো কুস্তিগিরেরা সুস্থ থাকেন কীভাবে
চায়ের দোকানে দুজন মধ্যবয়সী লোকের গল্প চলছে। পেটে হাত বোলাতে বোলাতে একজন বলছেন, ‘বুঝলেন ভাই, ভুঁড়িটা খুব বেড়ে গেছে। ভাবছি, কাল থেকে ব্যায়াম শুরু করব।’ অপরজন মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন। বললেন, ‘আমিও আছি আপনার সঙ্গে। আমার হার্টের সমস্যা। ডাক্তার বলেছেন ওজন কমাতে।’
বর্তমানে কান পাতলেই এসব আলাপ শোনা যায়। ওজন অতিরিক্ত বেড়ে গেলে মানুষের বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। কিন্তু জাপানে সুমো রেসলারদের ওজন প্রায় ১৮০ কেজি। এরপরও তাঁরা সুস্থ থাকেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব সুমো রেসলারের ওজনের কারণে কোনো শারীরিক সমস্যা হয় না। এত বাড়তি ওজন নিয়েও কীভাবে তাঁরা সুস্থ থাকেন?
যাঁরা জাপানের ‘হিরো’
ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উন্মাদনা দেখার মতো। একইভাবে সুমো রেসলিং নিয়ে জাপানিদের আবেগ-উত্তাপের কমতি নেই। জাপানিরা সুমো রেসলারদের ‘হিরো’ হিসেবে গণ্য করেন। কিন্তু সুমো খেলার জন্য বিশালদেহী হওয়া কি জরুরি? তোমার ওজন, উচ্চতা কিংবা লিঙ্গ যা-ই হোক না কেন, তুমি চাইলে সুমো রেসলার হতে পারো। আগে সুমো রেসলার হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট ওজন এবং উচ্চতার প্রয়োজন ছিল। এখন আর সেই নিয়ম নেই। তবু কেন যেন সুমো রেসলারদের কথা শুনলেই মাথায় আসে বেশ স্বাস্থ্যবান কিছু লোকের চেহারা।
সহজভাবে বললে, সুমো রেসলিং একধরনের কুস্তি প্রতিযোগিতা। এই খেলায় দুজন সুমো রেসলার ‘দোহয়ো’ নামের একটি বিশেষ রেসলিং রিংয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে কুস্তি করে। সুমো খেলার প্রধান শর্ত হলো, কুস্তিগিরদের পায়ের তলা ছাড়া শরীরের আর কোনো অংশ দোহয়োর মাটি স্পর্শ করতে পারবে না। কুস্তি চলার সময়ে রেসলাররা একে অপরকে ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে রেসলিং রিংয়ের বাইরে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত দোহয়োর মধ্যে যে কুস্তিগির দুই পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন, তিনি বিজয়ী হন। হয়তো তুমি বুঝতে পারছ কী কারণে সুমো রেসলাররা প্রাণপণে ওজন বাড়ানোর চেষ্টা করেন। যাঁর ওজন যত বেশি, তাঁকে নড়ানোর জন্য তত বেশি বলপ্রয়োগের দরকার হয়। মানে, একজন সুমো রেসলার যত মোটা, তাঁর জন্য সুমো খেলা তত সহজ।
সুমো রেসলারদের সুস্থ থাকার ‘ওপেন সিক্রেট’
স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে চিকিৎসকেরা একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে এক দিনে ২ হাজার ৫০০ ক্যালরির বেশি খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু একজন সাধারণ সুমো রেসলার দিনে প্রায় ৭ হাজার ক্যালরির খাবার খান। দৈনিক এমন খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত সুমো রেসলারদের ওজন স্বাভাবিকভাবেই একজন সাধারণ লোকের থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি।
অতিরিক্ত ওজন অবেসিটি কিংবা স্থূলতার কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) নিশ্চিত করেছে, স্থূলতা থেকে বিভিন্ন ধরনের হৃদ্রোগ হয় আর হার্টের এসব অসুখ মৃত্যুর অন্যতম কারণ। তথ্য অনুযায়ী, ওজনের কারণে জাপানি সুমো রেসলারদের হরহামেশাই নানা ধরনের রোগবালাই লেগে থাকার কথা। কিন্তু বিশালদেহী জাপানি কুস্তিগিরদের শরীরে স্থূলতার কারণে কোনো অসুখ বাসা বাঁধে না। এর মানে কি সুমো রেসলারদের কাছে কোনো জাদুকরি ওষুধ আছে?
সাধারণত একজন মানুষের ওজন বেশি থাকলে ধরে নেওয়া হয়, তাঁর শরীরে চর্বি বেশি। কারণ, স্থূলতার অন্যতম কারণ গায়ে অতিরিক্ত চর্বি জমে থাকা। সুমো রেসলারদের শরীরে প্রচুর পরিমাণে চর্বি থাকে ঠিকই। কিন্তু এই চর্বি মূলত তাঁদের চামড়ার নিচে জমা হয়। ফলে সুমো রেসলাররা দেখতে বেশ নাদুসনুদুস, ফোলা ফোলা হয়ে থাকে। মানে, এই কুস্তিগিরদের শরীরে ভিসেরাল ফ্যাট নেই বললেই চলে। ভিসেরাল ফ্যাট হলো শরীরের ভেতরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গায়ে লেগে থাকা চর্বি। এ ধরনের চর্বি টাইপ-২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ বা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং ফ্যাটি লিভারের মতো জটিল অসুখের জন্য দায়ী। নিশ্চয়ই ভাবছ, সুমো রেসলাররা এমন কী ক্ষমতার অধিকারী যে তাঁদের শরীরে ভিসেরাল ফ্যাট জমে না?
কুস্তি করার জন্য অনেক শারীরিক কসরতের প্রয়োজন হয়। এমনকি কুস্তি করার আগে প্রস্তুতি নিতেও ভারী ব্যায়াম করা লাগে। প্রায় ১৮০ কেজি ওজনের পেশাদার সুমো রেসলাররা সারা দিন শুধু খাবার খান, এমন ধারণা ভুল। জাপানে ‘হেয়া’ নামের একটি জায়গায় ভোর পাঁচটা থেকে প্রশিক্ষণ শুরু করেন সুমো রেসলাররা। তাঁদের দৈনিক ট্রেনিং সেশন প্রায় পাঁচ ঘণ্টার হতে পারে। সুমো ম্যাচ খেলার সময়ও এসব কুস্তিগিরের অনেক খাটুনি হয়। এত কঠোর পরিশ্রমের ফলে সুমো রেসলারদের শরীরে একধরনের হরমোন নিঃসরণ বেড়ে যায়। এই হরমোনের নাম অ্যাডিপোনেকটিন। মানবদেহে ভিসেরাল ফ্যাট জমতে বাধা দেয় অ্যাডিপোনেকটিন। এ জন্য সুমো রেসলাররা স্থূলতার কারণে কোনো অসুস্থতায় ভোগেন না।
তাই বলে ভেবো না, প্রতিদিন বিরিয়ানি, কেক-পেস্ট্রি, বার্গার, আইসক্রিমের মতো মুখরোচক ফাস্ট ফুড খেয়ে একটু ব্যায়াম করে নিলেই সুস্থ থাকা যায়। এমন ধারণা একদম ঠিক নয়। সুমো রেসলাররা সাধারণ মানুষের থেকে অনেকটা ভিন্নধর্মী রুটিনে চলেন। এই যেমন বুটসুকারি-গেইকো নামের একটি ব্যায়াম করেন সুমো রেসলাররা। এই ব্যায়ামের সময় কুস্তিগিররা ক্লান্তি হয়ে মেঝেতে পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত একে অপরকে বারবার আঘাত করেন আর ধাক্কা দেন।
১৮০ কেজি ওজনের একজন কুস্তিগিরের সঙ্গে মারামারি করার ইচ্ছা না থাকলে নিজের খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।