জন্ম, জীবিকা, মৃত্যু— যে জাতির সবই সাগরে
সাভারের আশুলিয়া দিয়ে বাসে চেপে যাচ্ছিলাম। রাস্তার পাশে নদী। এক জায়গায় দেখলাম কিছু নৌকা বাঁধা। কাপড়চোপড় ঝোলানো। দুটি নৌকা থেকে ধোঁয়া উড়ছে। দেখে মনে হলো, তারা বেদে। নৌকায় যাদের জীবন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, নৌকায় বাস করে, এমন অনেক গোষ্ঠীই আছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে এমন যাযাবর গোষ্ঠীর দেখা মেলে। তারা এক জায়গায় বেশি দিন বাস করে না। সুবিধামতো জায়গা পাল্টায়। বিচিত্র যে যাযাবর গোষ্ঠীর খোঁজ পেলাম, তাদের নাম বাজাউ। তাদের জীবনযাত্রা খুবই বিস্ময়কর। কারণ, তারা বাস করে সমুদ্রে।
এশিয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের সমুদ্রে বাজাউদের বসবাস। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় পুরো সময় সাগরে কাটায় তারা। স্বনির্ভর এই গোষ্ঠী নিজেদের জীবনযাপন নিয়ে গর্ব করে। ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সাংবিধানিক আইন ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তারা কোনো দেশের নাগরিক হিসেবেই স্বীকৃতি পায়নি। কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড না থাকায় তাদের বলা হয় সি জিপসি বা সি নোম্যাড। আমরা বলছি সাগরের যাযাবর।
বাজাউদের ইতিহাস অনুযায়ী, প্রায় হাজার বছর আগে তারা ছিল জোহর রাজ্যের নৌপ্রহরী। একবার জোহর রাজ্যের রাজকন্যা ‘দায়াং আয়েশা’কে বিয়ে করার জন্য ব্রুনাইয়ের সুলতান জোহর রাজ্যের নৌবহরকে আক্রমণ করেন। অতর্কিত আক্রমণে জোহর রাজ্যের নৌবহরকে পরাজিত করে অপহরণ করেন রাজকন্যাকে। দেশে ফিরে রাজকন্যাকে বিয়ে করেন সুলতান। এতে বিপদে পড়ে পরিবারসহ কয়েক শ বাজাউ। দেশে ফিরলে জোহরের রাজা মেয়েকে হারানোর জন্য তাদের হত্যা করবে। প্রাণের ভয়ে তাই তারা আর দেশে ফেরেনি। মাটির সঙ্গে তাদের চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ হলো। সমুদ্রই হয়ে গেল তাদের ঘর। এভাবে শুরু। এরপর শত শত বছর ধরে দেশহীন যাযাবর হয়ে তারা ঘুরতে থাকে বিভিন্ন উপসাগরে।
বাজাউরা নিজেদের বয়স বলতে পারে না। আধুনিক এই যুগেও সময় কিংবা তারিখ সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট ধারণা নেই। সামুদ্রিক মাছের তেলের মশাল তাদের রাতের অন্ধকার দূর করে। সাগরের তীরবর্তী কিছু সাহায্যকারী গ্রাম তাদের জ্বালানি কাঠ, পানি ও জামাকাপড় দেয়। বিনিময়ে বাজাউরা দেয় মাছ। বাজাউরা বাঁশ ও কাঠ দিয়ে নির্মাণ করে অস্থায়ী ঘর। যার নিচ দিয়ে বয়ে যায় সমুদ্রের ঢেউ। বাজাউরা শিকার করতে ব্যবহার করে নিজেদের তৈরি এক বিশেষ তির ছোড়া বন্দুক।
বাজাউদের অনেক বৃদ্ধই কখনো মাটিতে পা রাখেননি। তাই জন্মের মতো বাজাউদের মৃত্যুও হয় সাগরে। নৌকায় করে গভীর সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয় মরদেহ।
বাজাউরা সাগরের তিমি, ডলফিনের মতোই প্রাকৃতিক ডুবুরি ও সাঁতারু। বাজাউ শিশুরা সাগরের খেলা করে। তাদের ফুসফুস পানির নিচে দীর্ঘ সময় থাকার জন্য পর্যাপ্ত বায়ু ধরে রাখতে সক্ষম। বাজাউ জনগোষ্ঠীর প্রাপ্তবয়স্করা এক দমে সাগরের ২৩০ ফুট নিচে গিয়ে মাছ, স্টিং রে, স্কুইড, অক্টোপাস শিকার করতে পারে। এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা পানির নিচে শ্বাস ধরে রাখতে পারে প্রায় ১০ থেকে ১৩ মিনিট। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক মেলিসা ইলার্ডো ও রাসমুস নিয়েলসেন বাজাউদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁদের গবেষণা থেকে জানা গেছে এসব তথ্য।
বাজাউরা যখন তাদের শ্বাস আটকে রাখে, তখন অক্সিজেন বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের হৃৎপিণ্ড কাজ করা কমিয়ে দেয়। তখন পালসরেট নেমে দাঁড়ায় প্রতি মিনিটে মাত্র ৩০ বার। বাজাউ জনগোষ্ঠীর প্লীহা (লসিকাতন্ত্র ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ) ও ফুসফুস সাধারণ মানুষের থেকে বড়। এর সংকোচও বেশি। প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য এই পরিবর্তন হয়েছে। শত শত বছর ধরে খাদ্য সংগ্রহের জন্য সমুদ্রের গভীরে যাওয়ার অভ্যাস বাজাউদের শ্বসনতন্ত্র এবং রক্ত সংবহনতন্ত্রে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এভাবে বাজাউরা সমুদ্রে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।