অক্টোবরে মাউন্ট ফুজিতে তুষার পড়ল না কেন
১৩০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম অক্টোবর মাসে মাউন্ট ফুজিতে তুষারপাত হয়নি। ১৩০ বছরেরও আগে কখনো এমন ঘটেছে কিনা জানা যায় না। কারণ, তুষারপাত শুরু হওয়ার রেকর্ড রাখা শুরুই হয়েছিল ১৩০ বছর আগে। মাউন্ট ফুজিতে দেরিতে হওয়া তুষারপাতের রেকর্ড ভেঙে গেছে। এই মৌসুমে মাউন্ট ফুজিতে তুষারপাত শুরু হয়েছে অক্টোবর পেরিয়ে নভেম্বরের দুই তারিখে।
জাপানে শীতের আগমনি বার্তা ঘোষণা করে মাউন্ট ফুজির তুষারপাত। সূর্যদয়ের দেশটিতে শীতের শুরু হয় ডিসেম্বরে। ঐতিহাসিক মাউন্ট ফুজিতে ২ নভেম্বর যখন তুষারপাত শুরু হলো, তখন গবেষকদের কপালে ছিল চিন্তার ভাঁজ। দর্শকেরা ৬ নভেম্বরের আগে ফুজির চূড়ায় তুষারক্যাপ দেখতে পাননি। গত ১৩০ বছরে একবারও এমন হয়নি, নভেম্বর এসেছে, অথচ তুষারহীন মাউন্ট ফুজির চূড়া।
গ্রীষ্মের তীব্র তাপপ্রবাহ জাপানের ক্ষেত্রে কোনো স্থানীয় ঘটনা না। সারা বিশ্বেই তাপমাত্রা বাড়ছে। এই গ্রীষ্মে টানা দ্বিতীয় বছরের জন্য বৈশ্বিক তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছে। ২০২৪ সাল রেকর্ডকৃত ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হতে যাচ্ছে।
সাধারণত অক্টোবরের প্রথম দিকে তুষারে ঢেকে যায় জাপানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট ফুজি। দেশটির অন্যতম জনপ্রিয় এই জায়গাটিতে কেন আবহাওয়াগত এমন পরিবর্তন দেখা গেল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এর উত্তর লুকিয়ে আছে জলবায়ু পরিবর্বতনের মধ্যে। গবেষকদের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন এই অঞ্চলের জীবনকে কঠিন করে তুলবে।
জাপানে এবার গ্রীষ্মকালীন পর্বতারোহণের মৌসুম শেষ হয়েছে ১০ সেপ্টেম্বর। দেশটির আবহাওয়া সংস্থা জানিয়েছে, সাধারণত ২ অক্টোবর মাউন্ট ফুজিতে তুষারপাত শুরু হয়। গত বছর ৫ অক্টোবর তুষারপাত শুরুর রেকর্ড করা হয়েছিল।
জাপানের কোফুর স্থানীয় আবহাওয়া অফিস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৪ সালে। তারপর থেকে প্রতি বছর ফুজিতে প্রথম তুষারপাতের ঘোষণা দিয়েছে তারা। এবার অস্বাভাবিক উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে তুষারপাত না হওয়ায় নভেম্বরের আগে তুষারপাতের ঘোষণা দেওয়ার সুযোগ পায়নি কোফু অফিস।
কোফু অফিসের আবহাওয়া কর্মকর্তা শিনিচি ইয়ানাগি সিএনএনকে বলেছেন, ‘জাপানে গ্রীষ্মকাল থেকে উচ্চ তাপমাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া বৃষ্টিপাত হওয়ায় এখানে কোনো তুষারপাত হয়নি। ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত তুষারপাত না হওয়ায় ১৯৫৫ ও ২০১৬ সালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই দুই বছর ২৬ অক্টোবর তুষারপাত হয়েছিল।’
১৮৯৮ সালে তুষারপাতের হিসাব রাখা শুরু হয়। এই হিসাবে পরিসংখ্যান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত এ বছরই জাপানে রেকর্ড করা হয়েছে সবচেয়ে উষ্ণতম গ্রীষ্ম। সংস্থাটি বলছে, জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৭৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। ২০১০ সালের আগের রেকর্ড তাপমাত্রা ছিল ১ দশমিক ০৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এবার ২০১০ সালের আগের রেকর্ডও ভেঙে গেছে।
অলাভজনক গবেষণা সংস্থা ক্লাইমেট সেন্ট্রালের বিশ্লেষণ অনুসারে, এ বছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জাপানের কমপক্ষে ৭৪টি শহরে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বা তার বেশি রেকর্ড করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জাপান গত অক্টোবরে অস্বাভাবিক তাপদাহের সম্মুখীন হয়েছে। এই তাপদহ আগের চেয়ে তিন গুণ বেশি।
গ্রীষ্মের তীব্র তাপপ্রবাহ জাপানের ক্ষেত্রে কোনো স্থানীয় ঘটনা না। সারা বিশ্বেই তাপমাত্রা বাড়ছে। এই গ্রীষ্মে টানা দ্বিতীয় বছরের জন্য বৈশ্বিক তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছে। ২০২৪ সাল রেকর্ডকৃত ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হতে যাচ্ছে।
এর জন্য এল নিনো বা প্রাকৃতিক জলবায়ুর প্রবণতা দায়ী। এল নিনোর প্রভাব তাপমাত্রা বাড়াতে সহায়তা করেছে, পাশাপাশি জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর মতো মানবসৃষ্ট কারণও জলবায়ু সংকটের মূল অনুঘটক। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর প্রভাব ঠেকাতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত ৪০ বছরে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের বেশিরভাগ অংশে তুষারপাত কমেছে। এরপর মাউন্ট ফুজিতে তুষারপাত না হওয়াকেও দেখা হচ্ছে জলবায়ু সংকটের প্রভাব হিসেবে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়া ও জলবায়ু কোন দিকে যাচ্ছে, তার নমুনা হতে পারে মাউন্ট ফুজি। উষ্ণ আবহাওয়া এবং তুষারপাতহীনতা প্রভাব ফেলেছে পর্যটনে। স্থানীয় অর্থনীতি, খাদ্য ও পানি সরবরাহ, এমনকি অ্যালার্জির ওপর প্রভাব ফেলছে।
জাপানের ইয়ামানাশি ও শিজুওকা অঞ্চলে অবস্থিত মাউন্ট ফুজির উচ্চতা ৩ হাজার ৭৭৬ মিটার। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে এটি পরিচিত। জাপানের প্রতীকও এই মাউন্ট ফুজি। সাধারণত বছরের বেশিরভাগ সময় তুষারে লেপা থাকে পর্বতটি। এই পর্বতটি আরোহণের জন্য বিখ্যাত। এর বিখ্যাত ঢাল থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী সূর্যোদয় দেখতে যান।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্বতটি অতিরিক্ত পর্যটনের শিকার হয়েছে। জাপানি কর্মকর্তারা এর আগে বলেছিলেন, দর্শনার্থীরা পর্বতে আবর্জনা ফেলছে। অনুপযুক্ত গিয়ার নিয়ে হাইকিং করেছে। যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটেছে। দর্শনার্থীরা আহত হয়েছেন।
গত জুলাই মাসে কর্তৃপক্ষ তাই নতুন ব্যবস্থা নিয়েছে। এমনকি কতজন প্রতিদিন পর্বতারোহণ করতে পারবে, তা–ও ঠিক করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এখন কর দিয়ে পর্বতে চড়তে হবে। বর্তমানে পর্বতারোহীদের জনপ্রতি ২ হাজার ইয়েন (১২.৪০ ডলার) দিতে হবে। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৪ হাজার পর্বতারোহী যেতে পারবেন।
সূত্র: সিএনএন