পৃথিবীর চাঁদ কয়টি
প্রশ্নটি দেখেই হয়তো মনে হচ্ছে, এটা আবার জিজ্ঞেস করার কী আছে? সারা জীবন তো চাঁদ একটাই দেখলাম। তবে এখানে একটা কিন্তু আছে। একসময় আমরা জানতাম না যে পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাকৃতিক উপগ্রহের অস্তিত্ব আছে। সব সময় জেনে এসেছি, পৃথিবীর উপগ্রহ একটাই। নাম চাঁদ। তাই এর অন্য কোনো নাম দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু কয়েক শতাব্দী ধরে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাকাশ অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমরা সৌরজগতে কয়েক শ চাঁদ আবিষ্কার করেছি। পৃথিবীর কয়টি চাঁদ আছে, এ প্রশ্নের ব্যাপারে তুমি যা যা ভাবতে পারো, ব্যাপারটা তার চেয়ে জটিল। চলো, সেই জটিল বিষয় সহজ করে জানা যাক। তবে তার আগে জানতে হবে, চাঁদ আসলে কী? চাঁদ হওয়ার শর্তই বা কী?
চাঁদ হওয়ার প্রথম বা বলা ভালো একমাত্র শর্ত হলো, নির্দিষ্ট কোনো গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হবে। চাঁদটি কত বড় বা ছোট, তা শর্তের মধ্যে পড়ে না। এখন প্রশ্ন হলো, চাঁদ (moon) ছাড়া আর কোনো বস্তু কি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে না? উত্তর—হ্যাঁ। প্রদক্ষিণ করে। একহিসাবে সেসব বস্তুকেও চাঁদই বলা যায়। তবে সেগুলো স্থায়ী চাঁদ নয়। পৃথিবীর চারপাশে নিয়মিত প্রদক্ষিণকারী একমাত্র বস্তুটি হলো চাঁদ। অর্থাৎ যেটাকে আমরা রাতের আকাশে খালি চোখে দেখতে পাই। সৌরজগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তু। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে বিভিন্ন গ্রহাণু, উল্কা পৃথিবীর চারপাশে প্রদক্ষিণ করে। তবে সেগুলো নিয়মিত নয়। কিছু কিছু গ্রহাণু আছে, যেগুলো হঠাৎ পৃথিবীর কক্ষপথে এসে পড়ে। ফলে বাধ্য হয়ে ঘুরতে হয় পৃথিবীর চারপাশে। আবার একসময় হারিয়েও যায় অন্তিম মহাবিশ্বে। এগুলো হলো অস্থায়ী চাঁদ। তবে হ্যাঁ, এগুলোকে নিয়মানুসারে চাঁদ বলা যায়।
এবার চিন্তা করে দেখো তো, অতীতে কি পৃথিবীর চাঁদ একটাই ছিল? উত্তরটা সহজ ও জটিল দুইভাবেই দেওয়া যায়। সহজ উত্তরটা হলো, পৃথিবীর চাঁদ সব সময় একটা ছিল। সেটা হলো মুন। অর্থাৎ, রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তুটি। জটিল উত্তরটা হলো, পৃথিবীর সৃষ্টির সময় কোনো চাঁদ ছিল না। সেটা আজ থেকে ৪৫০ কোটি বছর আগের কথা। পৃথিবী নামের গ্রহটি সদ্য সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে তখন কোনো প্রাণের অস্তিত্ব ছিল না। সেই অবস্থায় মঙ্গলের আকারের একটি গ্রহের সঙ্গে ধাক্কা লাগে পৃথিবীর। সেই গ্রহটির নাম ছিল থিয়া (Theia)। পৃথিবী ও থিয়ার সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল একটি নতুন বস্তু। সেটিই আমাদের আজকের চাঁদ।
এই নির্দিষ্ট চাঁদ ছাড়া কিছু অস্থায়ী চাঁদের কথা ওপরে বলেছিলাম। এসব অস্থায়ী চাঁদ আবার কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত। কিছু চাঁদ আছে, যারা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব কাটিয়ে চলে যাওয়ার আগে পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। এ রকম মাত্র দুটি বস্তুর কথা জানি আমরা। একটির নাম ‘২০০৬ আরএইচ১২০’। ২০ ফুট প্রস্থের এই গ্রহাণু ২০০৬ ও ২০০৭ সালে ৯ মাস ধরে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেছিল। এটা নিয়ে একটু দ্বিমতও আছে। অনেকেই মনে করেন, এটা আসলে ১৮ মাস পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেছিল। অন্যটির নাম ‘২০২০ সিডি৩’। ১১ দশমিক ৫ ফুটের এই গ্রহাণু ২০২০ সালের মার্চে পৃথিবীর কক্ষপথ ত্যাগ করে। বিদায়ের আগে অবশ্য পৃথিবীকে তিন বছর ধরে প্রদক্ষিণ করেছে গ্রহাণুটি।
অন্য আরেকটি গ্রুপ আছে। এই গ্রুপের বস্তুগুলো পৃথিবীর আশপাশে থেকে সূর্যের চারপাশে ঘোরে। এ রকম দুটি বস্তুর নাম ‘২০১০ টিকে৭’ ও ‘২০২০ এক্সএল৫’। এগুলো ট্রোজান নামে পরিচিত।
আরও একটি গ্রুপ আধা-উপগ্রহ নামে পরিচিত। এসব বস্তু পৃথিবীর কক্ষপথ অনুসরণ করে না। কিন্তু সেসব বস্তুও পৃথিবীর মতো ৩৬৫ দিনে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। ফলে সেগুলো পৃথিবীর মহাকর্ষীয় প্রভাবের বাইরে থাকা সত্ত্বেও মনে হয় যেন পৃথিবীর কক্ষপথেই আছে। এগুলো আধা-উপগ্রহ নামে পরিচিত।
এবার একটা মজার তথ্য দিয়ে শেষ করি। মাঝেমধ্যে জ্যোতির্বিদেরাও এই অস্থায়ী চাঁদ চিনতে ভুল করেন। ২০১৫ সালে জ্যোতির্বিদেরা ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁরা একটি অস্থায়ী চাঁদ আবিষ্কার করেছেন। চাঁদটি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে নিয়মিত ঘুরছে। অবশ্য ১৩ ঘণ্টা পর নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন তাঁরা। ওটা ছিল আসলে গায়া স্পেস টেলিস্কোপ। এটি ইউরোপ স্পেস এজেন্সির টেলিস্কোপ। প্রায় দুই হাজার কেজি ওজনের এই টেলিস্কোপ ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। জ্যোতির্বিদদের আশা, ২০২৫ সাল পর্যন্ত টেলিস্কোপটি কাজ করতে পারবে। এ ছাড়া ২০২০ সালে ‘এসও ২০২০’ নামে একটি অস্থায়ী চাঁদের কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন জ্যোতির্বিদেরা। এটিও ছিল ১৯৬০-এর দশকের একটি রকেট বুস্টারের অবশিষ্টাংশ।