কিছু লোক অনেক ওপর থেকে পড়েও কীভাবে বেঁচে যায়
কেউ অনেক উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে বেঁচে গেলে আমরা ঘটনাটিকে মিরাকল বলি। বেঁচে থাকা তখন মনে হয় বিস্ময়। ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। পড়ে গিয়ে হাড়গোড় ভেঙে না গেলে আমরা কী ভাবি? বিড়ালের হাড্ডি নাকি? এত ওপর থেকে পড়েও কিছু হলো না! চিকিৎসাগতভাবে অনেক উঁচু থেকে পড়ে বেঁচে যাওয়া একদম অসম্ভব না। কিছু মানুষ ঠিকই বেঁচে যায়। কিন্তু কীভাবে?
এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটায় একজন ১৩ বছর বয়সী ছেলে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের উত্তর রিম থেকে পড়ে যায়। প্রায় ১০০ ফুট নিচে পড়ে গিয়েও বেঁচে যায় ছেলেটি। ঘটনাটি সবাইকে চমকে দিয়েছিল। এটি একবারই ঘটেছে এমন না। তুমিও হয়তো জানো এমন কারও কথা, যে উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়ে আহত হলেও বেঁচে আছে। বছরের পর বছর ধরে এমন অনেককে পাওয়া যায়। খবর পাওয়া যায়, অমুক এলাকার এক বাসার ছাদ থেকে একজন পড়ে গিয়েও বেঁচে গেছে।
বিশ্বব্যাপী এরকম বেশ কিছু ঘটনা বিখ্যাত হয়ে আছে। ভেসনা ভুলোভিচ নামের একজন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট বিমান থেকে একবার পড়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭০ দশকের ঘটনা। সঙ্গে কোনো প্যারাসুট ছিল না। বিমান তখন ৩৩ হাজার ফুট উঁচুতে। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এত বেশি উচ্চতা থেকে পড়ে গিয়েও বাঁচা সম্ভব? কীভাবে? এর পেছনে কয়েকটি বিষয় আছে। প্রথম বিষয়টি হলো, লোকটি পড়ে যাওয়ার সময় ঠিক কতটা উচ্চতায় ছিল? ৪৮ ফুট (১৫ মিটার) উচ্চতা থেকে পড়ে গেলে (প্রায় চারতলার সমান) পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ বেঁচে যায়। যদি কেউ ৬০ ফুটের (১৮ মিটার) বেশি উচ্চতা থেকে পড়ে যায়, তাহলে সাধারণত মারা যায়। কেউ যদি ৮০ ফুট উচ্চতা থেকে পড়েও বেঁচে যায়, তবে এটি প্রায় অসম্ভব ঘটনা। অলৌকিকও বলা চলে। যাকে আমরা বলি ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে। কারণ, এত বেশি উচ্চতা থেকে পড়ে গেলে বেঁচে থাকার প্রায় কোনো সম্ভাবনাই থাকে না।
পড়ে গিয়ে বেঁচে যাওয়ার পেছনে আরেকটি বিষয় হলো, লোকটি মুক্তভাবে পড়ছিল কি না? বিষয়টি পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক নীতি দিয়ে বোঝা যায়। বেশি উচ্চতা থেকে পড়তে থাকলে কোনো বস্তু টার্মিনাল ভেলোসিটি বা প্রান্তিক বেগে পৌঁছায়। এই বেগের কারণে প্যারাসুট কাজ করে। পতনে প্রথম যে শক্তি কাজ করে তা হল মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। নিচের দিকে মধ্যাকর্ষণ শক্তি আমাদেরকে টানে বলেই আমরা পড়ে যাই। পড়ার সময় মধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে গতি বাড়তে থাকলে বাতাস নিম্নগামী গতিকে ক্রমশ বাধা দেয়। প্রান্তিক বেগে কিছু সময়ের জন্য এই বাতাসের প্রতিরোধ করে ও মধ্যাকর্ষণের ভারসাম্য বজায় রাখে। তখন মানুষটি একই গতিতে পড়তে থাকে। প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে নামার কিছু আগে এই কারণেই প্যারাসুট খোলা হয়।
বিমান থেকে প্যারাসুট নিয়ে লাফ দিলে প্যারাসুট খুলে বড় একটি জায়গা দখল করে। এতে প্যারাসুটের ক্ষেত্রফল বেড়ে যায়। প্যারাসুট বাতাসকে বাধা দেয়। এসময় একই গতিতে পতন হয়। ঘণ্টায় প্রায় ১৬ কিলোমিটার থাকে। বিমান থেকে ঝাঁপ দেওয়ার সময় নিরাপদে নামার জন্য এই গতি সহায়তা করে। কেউ যদি প্যারাসুট ছাড়া ঝাঁপ দেয়, তখন গতি হবে ঘণ্টায় প্রায় ২৪১ কিলোমিটার। পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে, এটি বড় একটি সমস্যা। মৃত্যুঝুঁকি আছে। লাফ দিয়ে নিচে নামার সময় গতির পার্থক্য থাকুক বা না থাকুক, কীভাবে মানুষটি অবতরণ করবেন, তা বেঁচে থাকার সম্ভাবনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কত দ্রুত নামছে এবং কত দ্রুত থেমে যাবে, এই দুইটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ।
কেউ ঢালু জায়গায় অবতরণ করে, তবে অবতরণ নিরাপদ হবে। নিচের দিকে স্লাইড করার সময় ধীরে ধীরে পতনের গতিশক্তি শেষ হবে। হঠাৎ থামার চেয়ে এটি নিরাপদ। আবার শরীরের কোন অংশ ব্যবহার করে অবতরণ করবে, তাও বিবেচনা করতে হবে। নিচে পড়ার সময় সবচেয়ে খারাপভাবে অবতরণের উপায় মাথা নিচের দিকে দিয়ে অবতরণ করা। যদি পা ব্যবহার করে নামা যায়, তাহলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি।
বয়সও বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করে। শিশুরা পড়ে গেলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি। ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুর তুলনায় ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষ একই উচ্চতা থেকে লাফ দিলে মৃত্যুর হার প্রায় পাঁচগুণ বেশি হয়। শিশুরা দ্রুত সুস্থ হয়। কারণ, শিশুদের হাড় অনেক বড় চাপ সহ্য করতে পারে। প্রান্তিক বেগ শিশুদের জন্য সহায়ক। শিশুদের শরীরপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফলের সঙ্গে ওজনের অনুপাত বেশি। তাই বাতাস বেশি বাধা দেয়।
কেউ যদি পতনের মতো দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে পড়ে, তখন তার কী করা উচিত? সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা করা খুব কঠিন। তবে সুযোগ থাকলে পতনকে দুর্বল করার চেষ্টা করা করতে হবে। কোনো গাছের ডাল, ডিসের লাইনের তার বা এরকম কিছু থাকলে সেগুলোতে বাধা পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পতনের সময় পা আগে ফেলার চেষ্টা করতে হবে। পা ভাঙলে চিকিৎসায় দ্রুত ভালো হয়। কিন্তু মাথায় বা মেরুদন্ডের গুরুতর আঘাত সারাজীবন শরীরকে অবশ করে রাখতে পারে।
এছাড়া হাত–পা ছড়িয়ে যত বেশি সম্ভব জায়গা দখল করা যায়। পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল যত বাড়বে, টার্মিনালের বেগ তত কমে আসবে। ঢিলেঢালা পোশাক প্যারাসুটের মতো কাজ করে। নরম কোনো কিছুর ওপর অবতরণ করা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। গাছের ঝোপ বা এমন কিছুতে অবতরণ করা যায়।
অনেক উচ্চতা থেকে পড়ে যাওয়ার সময় বা গাড়ির দুর্ঘটনায় পড়লে হৃৎপিণ্ড ফেটে যেতে পারে। হৃৎপিণ্ডের দেয়াল, পেশি বা ভালভগুলো আলাদা হয়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপ থাকলে এই সমস্যা বেশি হয়। তাই নিরাপদে প্যারাসুট ব্যবহার করে নামাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
*এই লেখাটি শুধু তথ্য জানার জন্য। চিকিৎসাবিষয়ক কিছু না।