বাংলায় প্রচলিত এক ধাঁধা আছে,
‘আমার এক লাল ঘোড়া
যা-ই দেয় তা খায়,
পানি দিলে মইরা যায়।’
বুঝতেই পারছ এর উত্তরটা কী হবে। হ্যাঁ, আগুন। কিন্তু আসলেই কি আগুন পানি পেলেই নিভে যায়?
দুর্ঘটনা হিসেবে অগ্নিকাণ্ড খুবই মারাত্মক। আগুন যত বড় হয়, তত সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। সামনে যা পায়, তা–ই পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আগুন নেভাতে কী দরকার? অনেকেই পানির কথা বলবে। পানি দিয়ে যে আগুন নেভানো যায়, সেটা খুবই সত্যি কথা, তবে সব ক্ষেত্রে নয়।
জ্বালানি বা আগুনের উৎসের ওপর নির্ভর করে আগুন নানা ধরনের হয়। আগুনের কিছু ধরন আছে, যেখানে পানি দিলে হিতে বিপরীত হয়। আগুন আরও বেড়ে যায়। বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, বলছি।
তার আগে আগুনের ধরন বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছি, সেটা পরিষ্কার করি। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, আগুন জ্বলার জন্য প্রয়োজন জ্বালানি। জ্বালানি বলতে শুধু যে গ্যাস বা তেলকে বোঝায়, তা নয়। যে জিনিসে আগুন লাগতে পারে, সেটাই আগুনের জ্বালানি। হতে পারে সেটা তেল, গ্যাস, কাঠ, লোহা, রাসায়নিক, বিদ্যুতের লাইন বা অন্য যেকোনো কিছু।
আগুন কোন ধরনের জ্বালানি পুড়িয়ে জ্বলছে, তার ওপর নির্ভর করে বিশেষজ্ঞরা আগুনকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। এসব ভাগকেই বলছি নানা ধরনের আগুন।
একেক ধরনের আগুন নেভানোর জন্য একেক রকম কৌশলের দরকার হয়। সেগুলো আজ আমরা একটুখানি জানব। তবে, তার আগে একটা সতর্কতা। কোথাও আগুন লাগলে সেখান থেকে দ্রুত নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবে। বড় কাউকে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে। নিজে নিজে আগুন নেভানোর চেষ্টা করার প্রয়োজন নেই। তোমরা নিরাপদে থাকো।
এবার মূল আলোচনায় যাই। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগুন প্রধানত পাঁচ ধরনের। ক্লাস এ, ক্লাস বি, ক্লাস সি, ক্লাস ডি এবং ক্লাস কে।
ক্লাস এ (জ্বালানি: কাঠ, কাগজ বা কাপড়ের মতো সাধারণ পদার্থ)
‘ক্লাস এ’ ধরনের আগুনের সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। কাগজ, কাঠ, কাপড়, আবর্জনা, প্লাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থ এই আগুনের জ্বালানি। চারপাশে এ ধরনের আগুনই বেশি দেখা যায়। সৌভাগ্যবশত, এ আগুন নেভানো সবচেয়ে সহজ। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফায়ার ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ‘ক্লাস এ’ ধরনের আগুন নেভানোর জন্য পানি বা অগ্নিনির্বাণ যন্ত্র থেকে নির্গত কার্বন ডাই–অক্সাইডের ফোম ব্যবহার করতে হবে।
ক্লাস বি (জ্বালানি: জ্বালানি তেল, অ্যালকোহল বা গ্যাসোলিন)
মার্কিন ফায়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতে, জ্বালানি তেল, অ্যালকোহল, প্রোপেন, গ্যাসের মতো অতি দাহ্য পদার্থ ‘ক্লাস বি’ ধরনের আগুনের জ্বালানি। সাধারণত এসব জ্বালানি যেখানে মজুত থাকে, সেখানে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
‘ক্লাস বি’ ক্যাটাগরির আগুন নেভানোর জন্য কোনোভাবেই পানি ব্যবহার করা উচিত নয়। এ আগুনের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। ফলে, পানি আগুনের উৎসে পৌঁছানোর আগেই বাষ্পে পরিণত হয়ে আগুনকে আরও বাড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এ ধরনের আগুন নেভাতে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের কার্বন ডাই-অক্সাইড বা অক্সিজেনের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, এমন রাসায়নিক ফোম ব্যবহার করা উচিত।
ক্লাস সি (বিদ্যুৎসংশ্লিষ্ট আগুন)
ইলেকট্রিসিটি বা বিদ্যুৎ–সংযোগ কোনো আগুনের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকলে সেটাকে ‘ক্লাস সি’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়। পুরোনো ও ত্রুটিযুক্তি বৈদ্যুতিক লাইন, ক্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ এ ধরনের আগুনের প্রধান উৎস। বাসাবাড়ি ও কল-কারখানায় বৈদ্যুতিক আগুন লাগতে পারে। অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্র–ভিত্তিক কোম্পানি স্ট্রাইক ফার্স্টের মতে, বৈদ্যুতিক বা ‘ক্লাস সি’ ধরনের আগুন লাগলে প্রথমেই উচিত বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। কাজটি করতে হবে অবশ্যই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। কারণ, বিদ্যুৎ নিজেই মানুষের জন্য প্রাণঘাতী।
‘ক্লাস সি’ ধরনের আগুন নেভাতে কার্বন ডাই-অক্সাইডযুক্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যায়, তাহলে ক্লাস সি ধরনের আগুন সাধারণত ‘ক্লাস এ’ ধরনের আগুনে পরিণত হয়।
বৈদ্যুতিক আগুন নেভাতেও পানি বা ফোমজাতীয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (foam extinguisher) ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে পরিস্থিতি আরও বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। কারণ, সেখানে বিদ্যুৎ পরিবাহী ধরনের পদার্থ থাকে।
ক্লাস ডি (ধাতব পদার্থ পুড়লে)
ধাতব পদার্থ গলাতে প্রচুর তাপের প্রয়োজন হয়। শিল্পকারখানায় অতি দাহ্য রাসায়নিক পুড়লে এ পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটসের এনভায়রনমেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি অফিসের বিশেষজ্ঞদের মতে, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম ও সোডিয়ামের মতো ক্ষারীয় ধাতু থেকে এ ধরনের আগুন তৈরি হয়। এসব পদার্থ বাতাস বা পানির সংস্পর্শে এলে জ্বলে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফায়ার ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ‘ক্লাস ডি’ ক্যাটাগরির আগুন নেভানোর জন্য শুধু ড্রাই পাউডার অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ব্যবহার করা উচিত। ফোম বা পানি এ ধরনের আগুনের তীব্রতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই সেগুলো ব্যবহার করা উচিত নয়।
ক্লাস কে (জ্বালানি: ভোজ্য তেল বা প্রাণীর চর্বি)
সাধারণত রান্নাঘর থেকে এ ধরনের আগুনের সূত্রপাত ঘটে। অসাবধানতায় রান্না করার সময় উচ্চ তাপে ভোজ্য তেলে আগুন লাগলে সেটাকে ‘ক্লাস কে’ ক্যাটাগরির আগুন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই ক্যাটাগরির আগুনকে অনেকেই ‘ক্লাস বি’ আগুনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, যেটা মোটেও ঠিক নয়। দুই ক্যাটাগরির আগুনের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। তবে, নেভানোর পদ্ধতিতে কিছুটা মিল আছে। ‘ক্লাস বি’ ধরনের আগুন নেভাতে যেমন পানি ব্যবহার করা একেবারেই উচিত নয়। তেমনি, ‘ক্লাস কে’ ধরনের আগুনেও পানি দেওয়া ঠিক নয়। এতে করে আগুন ছিটকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। গরম তেলে পানি পড়লে এই প্রভাব দেখা যায়।
‘ক্লাস কে’ ধরনের আগুন নেভানোর জন্য ভেজা রাসায়নিক বা কার্বন ডাই-অক্সাইডের ফোম নির্গমনকারী অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। বাণিজ্যিক রান্নাঘরে এ ধরনের যন্ত্র রাখা বাধ্যতামূলক।
রান্নাঘরের আগুন ছোট হলে মোটা তোয়ালে বা কাপড় ভিজিয়ে সেটা দিয়ে আগুন ঢেকে ফেলা যেতে পারে। এতে করে আগুনে বাইরে থেকে অক্সিজেনের সরবরাহ হয় না। ফলে আগুন নিভে যায়। তবে, মনে রাখা প্রয়োজন, এটা শুধু ছোট আগুনের ক্ষেত্রে প্রযেজ্য, যেটা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে ফেলা যাবে। অন্যথায় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে এবং প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে হবে।
আগুন যেমন ভয়ংকর, তেমনি দৈনন্দিন জীবনে আগুন আমাদের ভীষণ প্রয়োজন। বাড়িতে খাবার রান্না থেকে শুরু করে কারখানায় নানা পণ্য তৈরি, সবখানেই আগুনের ব্যবহার দেখতে পাবে। প্রয়োজনীয় এই আগুন আমাদের অসতর্কতার কারণেই ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
আগুনের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার বাঁধাধরা কোনো উপায় নেই। সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। ম্যাচ, লাইটার, রাসায়নিক পদার্থ, বৈদ্যুতিক সকেটের মতো আগুন লাগাতে পারে এমন জিনিস রাখতে হবে পরিবারের যারা ছোট, তাদের নাগালের বাইরে।