আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করে। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে বাস, লঞ্চ আর ট্রেন ভর্তি করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান শিক্ষার্থীরা। ধরো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার আগে রাজশাহীগামী বাস, ট্রেনের টিকিট পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
দক্ষিণ কোরিয়াতেও এ রকম এক ভর্তি পরীক্ষা হয়। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে এই পরীক্ষার কিছুটা মিল আছে। আমাদের দেশে পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পরীক্ষা হলেও অধিকাংশ পরীক্ষা হয় আলাদাভাবে। তবে আমাদের পরীক্ষার তুলনায় কোরিয়ার এই পরীক্ষা বেশ কঠিন। দক্ষিণ কোরিয়ার এই ভর্তি পরীক্ষার জন্য আধঘণ্টা বিমান উড্ডয়ন বন্ধ করে রাখা হয়!
পরীক্ষার সময় আমাদের দেশে যেমন বাবা-মায়েরা সন্তানের জন্য দোয়া করেন, কোরিয়াও তেমন। ৯ ঘণ্টার ম্যারাথন পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীরা অংশ নেন। অন্যদিকে স্বজনেরা ভিড় করেন প্যাগোডা, মন্দির বা ধর্মীয় উপাসনালয়ে। ‘আমার সন্তান পরীক্ষায় যেন ভালো করে’, এমন প্রার্থনা হয় দেশজুড়ে!
পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য শহরজুড়ে নেওয়া হয় বিশেষ ব্যবস্থা। রাস্তায় পরীক্ষার্থী বাদে অন্যদের গাড়ি তেমন দেখা যায় না। যানজট এড়িয়ে যেন পরীক্ষার্থীরা চলতে পারে, তাই এই ব্যবস্থা। রাস্তার দুই পাশে ছাত্রছাত্রীরা দাঁড়িয়ে পরীক্ষার্থীদের উৎসাহ দেন। পরীক্ষার্থীদের মনোবল বাড়াতে তাঁরা গান গান, প্ল্যাকার্ডে আর ব্যানারে অনুপ্রেরণামূলক কথা লিখে আনেন। স্বেচ্ছাসেবীরা ব্যস্ত সময় পার করেন যেকোনো দরকারে সাহায্য করার জন্য। টহল পুলিশের গাড়ি আর মোটরসাইকেল থাকে। যেন কোনো পরীক্ষার্থীর দেরি হলে দ্রুত কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে পারে।
প্রতিবছর নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা। কলেজ এন্ট্রান্স নামের এই পরীক্ষার স্থানীয় নাম ‘সুনেয়াং’। ইংরেজিতে সিএসএটি। ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর কোরিয়ায় এই পরীক্ষা হচ্ছে। পরীক্ষাটি পরিচালনা করে কোরিয়া সরকার। স্কুলে ১২ বছর পড়াশোনা করে কলেজ এন্ট্রান্স এই পরীক্ষায় অংশ নেওয়া যায়। কোরিয়ার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিতভাবে এই পরীক্ষা নেয়। লাখ লাখ শিক্ষার্থী এই পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষার ফলাফল বের হলে মেধাতালিকা অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ভর্তির সুযোগ পান তাঁরা।
এ বছর পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৬ নভেম্বর। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিট থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত এই পরীক্ষা চলেছে। দেশব্যাপী কেন্দ্র ছিল ১ হাজার ২৭৯টি। মোট ৫ লাখ ৪ হাজার ৫৮৮ জন এবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৩ লাখ ২৬ হাজার জন উচ্চমাধ্যমিক থেকে এবার পাস করেছেন। বাকিরা পুরোনো শিক্ষার্থী, নতুনভাবে অংশ নিয়েছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার জীবনযাত্রার মান বেশ উন্নত। তবে ক্যারিয়ার গড়ার বেলায় অনেক বেশি প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় শিক্ষার্থীদের। এ জন্য কোরিয়ান শিক্ষার্থীদের চেষ্টা থাকে, ভালো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি হওয়ার। কেউ এই পরীক্ষার জন্য পুরো এক বছর প্রস্তুতি নেন। কেউ কেউ তিন বছর ধরে পড়ে পরীক্ষায় বসেন। পাঁচটি বিষয়ে ৯ ঘণ্টা ধরে পরীক্ষা দিতে হয় সুনেয়াংয়ে। সঙ্গে আছে স্পিকিং এবং লিসেনিং টেস্ট। মূলত কোরিয়ান ভাষা, গণিত, ইংরেজি এবং কোরিয়ান ইতিহাস বিষয়ে পরীক্ষা হয়। এর সঙ্গে পঞ্চম বিষয় হিসেবে সমাজ, বিজ্ঞান, কারিগরি শিক্ষা বা বিদেশি ভাষা থেকে একটি পছন্দ করা যায়। লিসেনিং পরীক্ষাটা সারা দেশে একসঙ্গে শুরু ও শেষ হয়। এ সময়ই মূলত বিমান চলাচল বন্ধ থাকে। পরীক্ষার্থীদের মনোযোগ যেন নষ্ট না হয়, তাই এই ব্যবস্থা। জাতীয় বেতারে লিসেনিং পরীক্ষার প্রশ্ন সরাসরি সম্প্রচার করা হয়!
পরীক্ষার্থীদের সেবা দেওয়ার জন্য কাজ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে শুরু করে ব্যাংক, অফিস-আদালতসহ সব জায়গায় এই দিন কাজ শুরু হয় এক ঘণ্টা দেরি করে। যেন কাজ শুরুর আগেই পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে ঢুকে যেতে পারেন।
এই পরীক্ষা একজন কোরিয়ান নাগরিকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তাই তো পরীক্ষাটি নিয়ে এত কাণ্ড।