গণিত শিখে কী লাভ
গণিতবিদ ইউক্লিড প্রায়ই শিষ্যদের জ্যামিতির নানা বিষয় শেখাতেন, তাঁদের নিয়ে নতুন নতুন সিদ্ধান্তে (আমরা উপপাদ্য নামে জানি) পৌঁছাতেন। সে রকমই একদিন, তিনি শিষ্য পরিবেষ্টিত অবস্থায় আছেন। এমন সময় মিসরের মোটামুটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক লোক সেখানে এলেন। জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা, এই যে আপনি জ্যামিতির কথা বলেন। তারা যে শেখে। তো এটা শিখে লাভ কী?’
ইউক্লিড ওই লোকের দিকে তাকালেন। তারপর তিনি ভৃত্যকে ডেকে ভৃত্যের হাতে একটা মুদ্রা দিলেন। তারপর ভৃত্যকে বললেন, যাও। ওনাকে এই মুদ্রা দিয়ে আসো। উনি সবকিছু থেকে লাভ পেতে চান?
এ ঘটনাটা সত্য কি না, আমি ঠিক জানি না। ঐতিহাসিকেরাও একমত নন। তবে পৃথিবীর যেসব লোক সারাক্ষণই সব বিষয়ে লাভ খোঁজে, তাদের জন্য এ গল্পটি বহুল প্রচলিত।
অথচ যে সময়ের কথা ওই গল্পে বলা হয়েছে, তত দিনে কিন্তু ইউক্লিডের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রায়ই নীল নদের অববাহিকার লোকেরা তাঁকে বা তাঁর শিষ্যদের ডেকে নিয়ে যান। উদ্দেশ্য, বিবদমান গ্রুপের জমির হিসাব ঠিকঠাকমতো করে দেওয়া। প্রতিবছর বন্যার সময় নীল নদের অববাহিকা নতুন পলিমাটিতে আচ্ছাদিত হয়ে যেত। পানি নেমে যাওয়ার পর প্রত্যেকের জমি আলাদা করে চিহ্নিত করা কঠিন হতো। সে সমস্যার সমাধানেই ইউক্লিডের হাতে জ্যামিতির আনুষ্ঠানিক গোড়াপত্তন এবং এখনো আমাদের যে দাগ-খতিয়ান ব্যবস্থা, সেটা ওই জ্যামিতির ওপরই প্রতিষ্ঠিত।
গণনা দিয়ে শুরু
তবে গণিতের সূচনা জ্যামিতি দিয়ে নয়; বরং গণনা দিয়ে। সভ্যতার শুরুতে মানুষ যখন গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে জীবনযাপন শুরু করে, তখন তাদের মূল সম্পদ ছিল পোষ মানানো পশু। সেটার হিসাব রাখতে গিয়ে দরকার হলো গণনার। এই গোনাগুনতি শুরু হয় কাঠি দিয়ে। একটি পশু বোঝাতে একটি কাঠি এ রকম। যখন কারও কারও সম্পদের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেল, তখন তাঁরা হিসাব রাখতে সমস্যায় পড়তেন। আর তখনই নানা রকম সংখ্যা পাতন পদ্ধতি চালু হয়। সেই সময়কার একটা সংখ্যা পদ্ধতি এখনো চালু আছে—রোমান পদ্ধতি। এতে ১, ৫, ১০, ৫০, ১০০ বা ১০০০ বোঝানোর জন্য যথাক্রমে I, V, X, L, C ও M চিহ্ন বা প্রতীক ব্যবহার করা হয়। আর এগুলো পাশাপাশি বসিয়ে যোগ বা বিয়োগ করে উদ্দিষ্ট সংখ্যার মান নির্ণয় করা হতো। যেমন ৩০ বোঝানোর জন্য XXX কিন্তু ৪০ লেখা হয় XL। সেভাবে ২০২৫ সাল বোঝাতে হবে MMXXV। কিন্তু ঝামেলা হলো দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বড় বড় সংখ্যার প্রয়োজন দেখা দিল, যা কিনা রোমান হরফে লেখা অসম্ভব না হলেও পড়তে গেলে দিন চলে যায়!
এর মধ্যে শূন্য (০) আবিষ্কৃত হয় উপমহাদেশে। আর আর্যভট্ট সংখ্যা পাতনের এক নতুন, কিন্তু সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ফেললেন—দশমিক পদ্ধতি (Decimal System)। এই পদ্ধতিতে অঙ্ক (Digit) হলো ১০টি—০, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ ও ৯। এগুলো এদের নিজেদের মান। কিন্তু সংখ্যার মধ্যে এদের অবস্থানগত কারণে এই ডিজিটের স্থানীয় মান বদলে যায়। ফলে ‘১’–এর পাশে আরেকটি ‘১’ বসালে যে ‘১১’ হয়, সেটার মান রোমান পদ্ধতির মতো দুই না হয়ে হয় এগারো! এর ফলে আমরা পেয়ে যাই হাজার-কোটি-পরার্ধ কিংবা মিলিয়ন-বিলিয়ন-ট্রিলিয়নের তরিকা। এখন আমরা খুব সহজে ইলন মাস্কের ৪০০ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদের হিসাব করতে পারি। শুধু যে হিসাব সহজ হলো, তা নয়; বরং আর্যভট্টের দেখানো পথ ধরে আমরা পেয়ে গেলাম ০ আর ১ দিয়ে বাইনারি পদ্ধতি, যা কিনা কম্পিউটারের প্রাণভোমরা।
তোমারেই দেখিয়াছি নানা রূপে
সংখ্যা পদ্ধতি কিংবা জ্যামিতির উদ্ভবেই যে গণিতবিদেরা থেমে গেলেন, তা নয়; বরং তাঁরা এর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য আরও নানাভাবে খুঁজতে লেগে গেলেন। এর একটি হলো সংখ্যাকে মৌলিক (Prime) ও যৌগিক (Compound) হিসেবে চিহ্নিত করতে পারা। মৌলিক সংখ্যার কোনো সর্বজনীন সূত্র বের করা যায় কি না, সেটা নিয়ে গণিতবিদদের চেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে। ফাঁকতালে দেখা গেল, মৌলিক সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে কম্পিউটার নিরাপত্তাব্যবস্থা, ক্রিপ্টোগ্রাফির প্রচলন হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত কম্পিউটার ব্যবহার করে সবচেয়ে বড় যে মৌলিক সংখ্যাটি জানা গেছে, তাতে অঙ্কই (ডিজিট) আছে ৪ কোটি ১০ লাখ ২৪ হাজার ৩২০টি!
আবার ছোটবেলায় গণিতবিদ গাউসকে ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যা লিখে সেগুলোর যোগফল বের করার নির্দেশ দেন তাঁর স্কুলের শিক্ষক। গাউস একটা একটা যোগ না করে নিচের মতো করে একটা কিছু খাতায় দাঁড় করায়
যোগফল =১+২+৩+৪+. . . . +৯৭+৯৮+৯৯+১০০
যোগফল=১০০+৯৯+৯৮+৯৭+. . . ৪+৩+২+১
২ যোগফল=১০১+১০১+১০১+১০১+... ...+১০১
+১০১+১০১+১০১
আর এ থেকে ছোট্ট গাউস বের করে ফেলল এই যোগফল আসলে [(১০০×১০১)÷২]। আর এভাবে গাণিতিক ধারার যোগফল বের করার সূত্রটি আমরা পেয়ে গেলাম।
মূর্ত থেকে বিমূর্ত
শুরুর দিকে গণনা থেকে যে গণিত, সেটা কাজ করত মূর্ত বা বাস্তবের জিনিসপত্র নিয়ে। ফলে কোনো একটা গাণিতিক সমস্যার সমাধান হতো একটি। যেমন একটি ডিমের দাম যদি ১৮ টাকা হয়, তাহলে ১৮০ টাকায় তুমি ১০টি ডিমই কিনতে পারবে। যতভাবেই তুমি এই গাণিতিক সমস্যার সমাধান করো না কেন, ওই ১০টির বেশি ডিম তুমি কিনতে পারবে না।
অচিরেই গণিতবিদেরা দেখলেন, গণিতের হিসাব-নিকাশ করার জন্য বাস্তবের বিষয় না হলেও হয়। ১৮ টাকা একটি ডিমের দাম না হয়ে যদি একটি কলার দাম হয়, তাহলেও সমস্যার সমাধান একই থাকে। তখনই ধারণা হলো, মূর্ত ধারণা থেকে গণিতকে নিয়ে যাওয়া যায় বিমূর্ত ধারণায়। আর এভাবে আমরা পেয়ে যাই বীজগণিত (Algebra)।
পুরাকাল থেকে নানাভাবে বীজগণিতের প্রয়োগ দেখা গেলেও অষ্টম শতকে বাগদাদের গণিতবিদ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খারেজমিকে আমরা এখন বীজগণিতের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিই। তার আগের নানা কিছুকে তিনি আল-জবর (বীজগণিতের ইংরেজি Algebra—এই বইয়ের নাম থেকে এসেছে) নামে একটি বইয়ে সংকলিত, ব্যাখ্যা ও টীকা যোগ করেন এবং নিজেও নানা কিছু বের করেন। সেই প্রথম আমরা গণিতের নানা কিছু কোনো বাস্তব বা মূর্ত ছাড়াই সমাধান করে ফেলতে শিখলাম। জানলাম, কলা বা ডিমের পরিবর্তে আমরা ক, খ বা x, y ইত্যাদি প্রতীক ব্যবহার করতে পারি। আর এর মাধ্যমে আমাদের সামনে নতুন অনেকগুলো দরজা খুলে যায়। আমরা বর্গসংখ্যার বাইরে গিয়ে ঘনসংখ্যা হয়ে যেকোনো ঘাতে সংখ্যাকে প্রকাশ করতে শিখে ফেলি এবং জেনে যাই এ রকম নানা সমস্যা সমাধান করা যায়। এর সব সমাধান বাস্তবে না–ও থাকতে পারে। কিন্তু তাতে গণিতের সৌন্দর্য কোনোভাবে ম্লান হয় না; বরং সেটি উন্মোচন করে নতুন নতুন দিগন্ত।
ফার্মার শেষ উপপাদ্য ও পেরেলম্যানে কোটি টাকা না নেওয়া
আবার অনেক গণিতবিদ, যেমন পিয়েরে দ্য ফার্মা তাঁর খাতার মার্জিনে একটা সিদ্ধান্ত লিখে রাখেন, যা কিনা পরবর্তী ৩৫৮ বছর গণিতবিদদের আচ্ছন্ন করে রাখে। এটি ফার্মার শেষ উপপাদ্য নামে পরিচিত। এতে বলা হয়েছে, an + bn = cn সমীকরণে তিনটি ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যা a, b, ও c সম্ভব নয়, যখন n>2।
এটি দেখতে এত সহজ মনে হয় যে অনেকেই মনে করতেন, এটার সমাধান করা সহজ। ফলে প্রতিদিনই কেউ না কেউ এটির সমাধান করে পাঠাতেন। কিন্তু সেগুলোর কোনোটি যথাযথ সমাধান নয়। শেষ পর্যন্ত এটি সমাধান করেছেন ব্রিটিশ গণিতবিদ স্যার এন্ড্রু উইলস। কিন্তু তাঁর এই সমাধান খুব সহজভাবে বোঝা যায় না। এ জন্য ব্যবহার করতে হয়েছে কম্পিউটার!
এ রকম আরও একটি অমীমাংসিত গাণিতিক সমস্যা ছিল পঁকেয়ারের অনুমান। এই সমস্যার সমাধান করেন রুশ গণিতবিদ গ্রেগরি পেরেলম্যান। এই সমস্যার সমাধানের জন্য ক্লে ইনস্টিটিউটের মিলিয়ন ডলারের একটা পুরস্কার ঘোষিত ছিল। কিন্তু পেরেলম্যান এই টাকা নিতে অস্বীকার করেন এবং রাশিয়ায় খুবই সাধারণভাবে জীবন যাপন করেন।
গণিতবিদদের আনন্দ তাই গণিতের নানা ধরনের সমস্যা সমাধানে, যা কিনা পরবর্তী সময় আমাদের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে কাজে লাগে কিংবা উচ্চতর গবেষণার দুর্দান্ত উপকরণ হয়ে ওঠে। যেমন জটিল সংখ্যা (Complex number), যার একটি অংশ হলো কাল্পনিক সংখ্যা (Imaginary number)।
ঋণাত্মক সংখ্যার কারবার
১৫৪৫ সালে ইতালির গণিতবিদ জিরোলামো কার্ডানো প্রথম দুটি নতুন ধারণার কথা বলেন। এর একটি হলো ঋণাত্মক সংখ্যা (Negative number)। এটি সহজভাবে বোঝানো যায়। আমার কাছে যদি ১০০ টাকা থাকে, তাহলে আমি বলতে পারি আমার কাছে +১০০ টাকা আছে। কিন্তু আমার কোনো বন্ধু থেকে যদি আমি ২০০ টাকা ঋণ নিয়ে থাকি, তাহলে সেটা বোঝানো যাবে -২০০ টাকা হিসেবে। যদি আমি আমার কাছে থাকা ১০০ টাকা বন্ধুকে দিয়ে দিই, তাহলেও সে আমার কাছ থেকে ১০০ টাকা পাবে। সেটাই আমার হিসাবে -১০০ দেখানো যাবে। ঋণাত্মক সংখ্যা আবিষ্কারের ফলে আমরা সংখ্যারেখাকে পূর্ণতা দিতে পারলাম। এখন আমাদের সংখ্যারেখাকে ধনাত্মক-ঋণাত্মক দুই দিকেই অসীম পর্যন্ত বাড়ানো যায়। এর মাধ্যমে আমাদের জানা সব সংখ্যাকে আমরা এখানে বসিয়ে ফেলতে পারি।
আর যথারীতি ঋণাত্মক সংখ্যা আমাদের সামনে নতুনভাবে সমস্যা সমাধানের পথ দেখানো শুরু করে। যেমন একটা বিশ্বখ্যাত সমস্যা—নারিকেল জিনজিরায় পাঁচ বন্ধু, বানরটা ফাও-এর সমস্যা। ১৯২৬ সালের ৯ অক্টোবর দ্য স্যাটারডে ইভনিং পোস্ট–এ এটির একটি সংস্করণ প্রকাশিত হলে এ সমস্যাটি গণিতবিদদের নজরে আসে।
এই বিখ্যাত সমস্যায় দেখা যায়, পাঁচ বন্ধু একটি দ্বীপে হাজির হয়। সেখানে তারা দিনভর নারকেল কুড়িয়ে জড়ো করে। তারপর ঠিক করে, সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই ভাগ করে নেবে। কিছুক্ষণ পর জেগে উঠল একজন। ভাবল, সকালে যা পাব, তা তো পাবই, এখন বরং এক ভাগ আলাদা করে রাখি। দেখল, একটা বানরও সেখানে জেগে আছে। তখন সে সব নারকেল সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করল। দেখা গেল, একটা বাড়তি থাকে। বাড়তিটা বানরকে ঘুষ দিয়ে সে নিজের ভাগটা লুকিয়ে ফেলল। তারপর ঘুমাতে গেল! একটু পর আরেকজন ঘুম থেকে উঠল একই মতলব নিয়ে। সে–ও সমান পাঁচ ভাগ করল, একটা বানরকে দিল আর নিজের ভাগ সরিয়ে রাখল। এরপর বাকি তিনজনের প্রত্যেকে উঠে উঠে একই কাজ করল। প্রতিবার ভাগ পেয়ে বানরটাও খুশি থাকল। সকালে পাঁচ বন্ধু জেগে নারকেলগুলো সমান পাঁচ ভাগ করল এবং বাড়তিটা বানরটিকে দিয়ে দিল। প্রত্যেকে দেখেছে সকালে নারকেল অনেক কম, তবু চেপে গেছে। কারণ, নিজেরা তো জানে রাতে কী হয়েছে! প্রশ্ন হলো, ওরা কমপক্ষে কতটি নারকেল কুড়িয়ে ছিল?
আমাদের জানা পদ্ধতি ব্যবহারে এই সমস্যা সমাধান অনেক কঠিন (অসম্ভব নয়)। প্রথমে শোনার পর মনে হয়, সবশেষে ছয়টি নারকেল ছিল এটা ধরে নিয়ে পেছন দিকে গেলেই সমাধানটা করা যায়। চেষ্টা করে দেখতে পারো। আরেকটা বুদ্ধি হলো বীজগণিত ব্যবহার করে সমাধান, যা কিছুটা সহজ। কারণ, এটি শেষ পর্যন্ত একটি ডায়োফ্যান্টাইন সমীকরণে রূপ নেয়। সেটির সমাধানের নানা পদ্ধতি আছে। কিন্তু বিজ্ঞানী পল ডিরাক এই সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করলেন ঋণাত্মক সংখ্যা এবং খুব সহজ একটা সমাধান পেয়ে গেলেন। এখন তো আমরা হরদম নানা কাজে ঋণাত্মক সংখ্যা ব্যবহার করি।
কল্পনার সংখ্যাতে ঘোরে যখন পাখা
জিরোলামো কার্ডানো নতুন যে সংখ্যার ধারণা নিয়ে আসেন, সেটি ঋণাত্মক নয়, কাল্পনিক!!! তবে এটি ঋণাত্মক সংখ্যারই একটি সম্প্রসারণ বলা যায়। ঋণাত্মক সংখ্যাকে আমরা সংখ্যারেখায় বসাতে পারি। কিন্তু কার্ডানো ভাবলেন, এমন একটি সংখ্যাও সম্ভব, যা কিনা সংখ্যারেখার বাঁয়ে-ডানে বসবে না; বরং তা থাকবে এই রেখার উল্লম্ব তলে। আর এই সংখ্যার মূল সংখ্যাটাকে তিনি প্রকাশ করলেন -১ (ঋণাত্মক ১)-এর বর্গমূল হিসেবে (i দিয়ে প্রকাশ করা হয়)। তো, যে সংখ্যা বাস্তবে বিরাজ করে না, সেটা কেমন কাজে লাগে?
এই যে কম্পিউটারে আমি লিখছি, আমার বাসার ফ্যানটা ঘোরে বা বাতিটা জ্বলে—এ সবই চলে এসি বিদ্যুৎ দিয়ে। আর এসি বিদ্যুতের যে বৈশিষ্ট্য, সেটিকে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করতে আমাদের এই কাল্পনিক সংখ্যা ব্যবহার করতে হয়। দেখা যাচ্ছে, বাস্তবে ফ্যান ঘোরাতে নানা রকম ফন্দিফিকির করতে হয়। এ জন্য আমাদের কাল্পনিক সংখ্যা, জটিল সংখ্যার গণিত (Complex number and complex math) ব্যবহার করা লাগে।
এসি বিদ্যুতের সূচনা মাত্র দেড় শ বছর আগে। কিন্তু এর জন্য যে গণিত, সেটা ঠিকই গণিতবিদেরা বের করে ফেলেছেন সেই পৌনে ৫০০ বছর আগে! একইভাবে কম্পিউটারের যে বুলিয়ান গণিত, সেটাও আমরা পেয়েছি কম্পিউটার উদ্ভাবনের কয়েক শ বছর আগেই!
এভাবে গণিত আমাদের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। শুধু দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান নয়; বরং বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখারই গণিতের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে। এ কারণে অনেকে গণিতকে বিজ্ঞানের রানি (Queen of science) বলতে দ্বিধা করেন না।
তাহলে কেন গণিতে নোবেল পুরস্কার নেই
যে শাস্ত্র কিনা সব বিজ্ঞানের জন্য জরুরি, তাতে কেন বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান পুরস্কার দেওয়া হয় না? কথিত আছে, বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল যখন ডিনামাইট উদ্ভাবনে ব্যস্ত ছিলেন, তখন তাঁর ব্যস্ততার জন্য তিনি তাঁর প্রেমিকাকে সময় দিতে পারেননি। বীতশ্রদ্ধ প্রেমিকা নোবেলকে ত্যাগ করে একজন গণিতবিদকে বিয়ে করেন। সে জন্য আলফ্রেড নোবেল পদার্থ, রসায়ন বা চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের ব্যবস্থা করলেও গণিতকে বাদ দেন।
কিন্তু চলতি বছর পদার্থ ও রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করেন, এমন বিজ্ঞানীরা। আর কে না জানে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রাণভোমরা হলো গণিত আর গণিত। আর গণিতের এই মোহনীয় কারবারই এখন আমাদের জীবনকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে প্রতিনিয়ত।
ইউক্লিডের কাছে জানতে চাওয়া ‘জ্যামিতি শিখে কী লাভ’ প্রশ্নের জবাব দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম। শেষে এসে সেই প্রশ্নটার উত্তর তোমাদের জন্য রেখে দিলাম।
যারা উত্তরটা খুঁজবে, তাদের জীবনটা যেমন গণিতময় হবে, আর যারা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে না, তাদের জীবনটাও গণিতময় হবে।
তুমি কী করবে, সে সিদ্ধান্ত তোমারই।