বাবা চলে গেছেন...। বাড়ির ছোট ছেলেটার (চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়) তখনো বোঝার বয়স হয়নি যে তার বাবা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। মাত্র তিন বছর বয়সে কীই-বা বোঝার ক্ষমতা থাকে!
স্বামীকে হারিয়ে তখন থেকেই উত্তাল সাগরে জীবনের নাও ভাসিয়েছেন মা সেলিনা। দারিদ্র্যের মারপ্যাঁচে কোনো গতি না পেয়ে ছেলেদের মানুষ করতে ফুটপাতে দোকান দিয়ে শুরু করলেন চা বিক্রির কাজ। আর যা-ই হোক, ছেলে-মেয়েদের মুখে তো তুলে দিতে হবে দুমুঠো ভাত। বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাদের মানুষ করার স্বপ্ন। ১৫ বছর পর জীবন নামের সেই দুঃখের কালো ডায়েরিতে লেখা গেল স্বপ্নপূরণের গল্প।
বাংলাদেশকে গর্বিত করেছেন সেই ছোট ছেলে সাগর ইসলাম। নামটা চেনা চেনা লাগছে? ঠিকই ধরেছেন, বাংলাদেশ থেকে প্যারিস অলিম্পিকে খেলার সরাসরি টিকিট অর্জন করেছেন সাগর। তুরস্কের আনতালিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘২০২৪ ফাইনাল ওয়ার্ল্ড কোটা টুর্নামেন্ট’-এর রিকার্ভ পুরুষ এককের সেমিফাইনালে উঠে অলিম্পিকের টিকিট নিশ্চিত করেছেন এই আর্চার। রিকার্ভ ব্যক্তিগত ইভেন্টে সেমিফাইনালে অলিম্পিকে কোটা প্লেসের পাশাপাশি দেশের হয়ে রৌপ্যপদকও জিতেছেন সাগর। অথচ সাগরের শরীর থেকে এখনো যায়নি কৈশোরের ঘ্রাণ। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন তিনি। ১৮ বছর বয়সেই নিশানা ভেদে দেখিয়েছেন মুনশিয়ানা।
চায়ের দোকানে বিক্রি হওয়া শৈশব
রাজশাহী শহরের ছোট বনগ্রামের একটা ভাড়া বাসায় সাগরদের বসবাস। ২০০৯ সালে বাবা শাহ আলমকে হারান তিনি। পেশায় টেম্পোমিস্ত্রি ছিলেন তাঁর বাবা। বাবার অকালমৃত্যুতে আর্থিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়ায় বাসার পাশেই চায়ের দোকান খুলে বসেন তাঁর মা। সেই দোকানেই কেটেছে সাগরের শৈশব। বলা যায়, সেখানেই বিক্রি হয়ে গেছে তাঁর শৈশবটা!
কাকডাকা ভোরে দোকান খুলতেন মা সেলিনা। মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে জোগালি হিসেবে দিন শুরু হতো সাগরের। এর মধ্যে ছোট বনগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা। দোকানেই খাওয়ার ব্যবস্থা থাকায় বাড়িতেও যাওয়া হতো না। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত শুরু হতে থাকলে সারা দিনের ক্লান্তি শেষে দোকানের বেঞ্চেই ঘুম। ঘুমের ঘোরে বেঞ্চ থেকে কতবার যে পড়ে গিয়েছেন, তার হিসাব নেই। ছেলেকে মশা জেঁকে ধরলে দোকানের চুলার কাঠ নিয়ে এসে ধোঁয়া দিয়ে তাড়ানোর ব্যবস্থা করে দিতেন মা। রাত বাড়লে একেবারে মায়ের সঙ্গে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরা।
সারা দিন দোকানে থাকা অবস্থায় পাশের স্ট্যান্ডার্ড বাংলাদেশ আর্চারি ক্লাবে ঢুঁ মারতেন সাগর। তাতে মায়ের পক্ষে থেকে কোনো বাধা ছিল না। ছেলে তির-ধনুকের প্রেমে পড়ে গেছে, সে প্রেমে সায় দিলেন মা। ছেলে যেহেতু সারা দিন খেলা খেলা করে, তাই মা-ও বলে দিলেন, ‘ঠিক আছে সবাই যখন তির মারে, তুইও তির মার গিয়ে!’ ব্যস, ক্লাস থ্রিতে পড়া অবস্থায় শুরু হলো তির-ধনুক অধ্যায়। ঢাকা থেকে বিকেএসপি দল সেখানে গিয়েছিল খেলোয়াড় বাছাইয়ের জন্য। সেখান থেকেই ২০১৭ সালে বিকেএসপির অধীনে ক্যাম্পে অংশ নেওয়া। তারপর ২০১৯ সালে বিকেএসপিতে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হন সাগর।
বিকেএসপিতে ভর্তি ও বাঁকবদল
শৈশবের জীবনটা তাঁর দুঃখের কালো ডায়েরি। সে জীবনে রং লাগে ২০১৯ সালে বিকেএসপিতে এসে। কোচ ও শিক্ষকেরা মগজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন, শৃঙ্খলিত জীবন মেনে লক্ষ্য পূরণ করতে পারলেই স্বপ্নের হাতছানি। জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে পারলে যাওয়া যায় বিদেশে। আর তত দিনে আর্চারি খেলাটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া ছাড়িয়ে অলিম্পিকের আঁকিবুঁকি শুরু হয়ে গেছে।
প্রথম দুই বছর নূরে আলম, সজীব হোসেন ও রিনা চাকমার অধীনে অনুশীলন। শুরুতে প্লাস্টিকের ধনুক দিয়ে অনুশীলন করানো হতো। একটা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে প্লাস্টিকের ধনুক দিয়েই ৩০০ স্কোর করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন সাগর। সাধারণত প্লাস্টিকের ধনুক দিয়ে অন্যরা যেখানে ২৫০ থেকে ২৬০ স্কোর করলেই বিশাল ব্যাপার, সেখানে সাগরের স্কোর শিটে ৩০০। বিকেএসপিও প্রতিদান দিতে ভুল করল না। প্রতিষ্ঠানের কঠোর পরিশ্রমী কোচ হিসেবে খ্যাত নূরে আলম তাঁর ভবিষ্যৎ ‘অর্জুন’-এর হাতে তুলে দিলেন কার্বন ও অ্যালুমিনিয়ামের যৌথ মিশ্রণে তৈরি রিকার্ভ বো বা ধনুক।
ক্লাস নাইনে পড়া অবস্থায় দক্ষিণ কোরিয়ান কোচ লি ইয়ুং হুর হাতে পড়লেন। সাগর যেন পেলেন পরশপাথর! শুরু হলো সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনি। জোর দেওয়া হলো আর্চারির মৌলিক বিষয়ের ওপর। ধনুক থেকে তির বা অ্যারো ছোড়াটা ভালো ছিল না সাগরের; অর্থাৎ তিরটা ছাড়ার সময় টান টান থাকত না। এখন সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা গেছে।
আরও পড়ুন
কোরিয়ান কোচের অধীনে কীভাবে অলিম্পিক পর্যায়ে উঠে এলেন, সেই গল্প শোনালেন সাগর, ‘আমার একটা বিষয় অন্যরা খুব পছন্দ করেন। যে হাত দিয়ে সামনে ধনুক ধরে রাখতে হয়, আমার সেই হাত সোজা থাকে। অন্যরা তির ছোড়ার সময় নিচু হয়ে যায়। কিন্তু আমার হাত থাকে সোজা। এটা কোরিয়ান কোচের অধীনে অনুশীলন করতে করতে এখন অটোমেটিক হয়ে গেছে। তিনি আমার তির ছোড়ার স্টাইলটাই বদলে দিয়েছেন।’ কোরিয়ান কোচের অধীনে অনুশীলন করেই ৬৬০ স্কোর করে ২০২২ সালে জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন বলেও জানান তিনি। আর জাতীয় দলের জার্মান কোচ মার্টিন ফ্রেডরিকের হাতে পড়ে সাগর হয়েছেন আরও শাণিত ও আত্মবিশ্বাসী।
ছেলের ভবিষ্যতের জন্য রক্ত বেচতেও প্রস্তুত ছিলেন মা
ছেলে বাড়ি (রাজশাহী) ছেড়ে ঢাকায় চলে যাচ্ছে। একে তো ছেলে দূরে চলে যাওয়ার কষ্ট, সেই কষ্টের সঙ্গে যোগ হলো ছেলেকে বিকেএসপিতে পড়াশোনা করানোর বাড়তি খরচের দুশ্চিন্তা।
সাগরের মা সেলিনা চায়ের দোকান করে সংসার চালান। চায়ের দোকান করে কীভাবে ছেলেকে বিকেএসপিতে পড়াশোনা করানোর এই বাড়তি অর্থের জোগান দেবেন! সাগরের মাকে এলাকাবাসী খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘ছেলেকে যে ঢাকায় পড়তে ও খেলতে পাঠাচ্ছ, খরচ চালাতে পারবা তো?’ ছেলে সাগরের ছিল স্বপ্ন আর ছেলের স্বপ্ন পূরণের জন্য মা সেলিনার ছিল অদম্য জেদ। সেলিনা বলেছিলেন, ‘গায়ের রক্ত বেঁচে হলেও ছেলেকে খেলাব। ছেলে যখন বড় খেলোয়াড় হতে চায়, আমি ওকে খেলাবই। গায়ের রক্ত বেচে হলেও খেলাব।’ ২০১৯ সাল। ২০২৪ সালে এসে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি অলিম্পিকে জায়গা করে নিয়েছেন সাগর। মায়ের পরিশ্রমের সার্থকতা বুঝি একেই বলে। ২০০৯ সালে সাগরের বাবা স্ট্রোক করে মারা যাওয়ার পর শুরু হয় সেলিনার সংগ্রাম। বাড়ির পাশেই রাস্তার ফুটপাতে চায়ের দোকান খুলে বসেন তিনি। ভোর ৫টা থেকে শুরু করে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে চা-দোকানি সেলিনার সংগ্রাম। তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সাগর তৃতীয়। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সাগরের বড় ভাই মাঝেমধ্যে তাঁর মায়ের চায়ের দোকানে সহায়তা করেন।
আরও পড়ুন
মাকে দৈনিক ১৭-১৮ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে চায়ের দোকান করতে দেখেছেন সাগর। এখন মায়ের কষ্টের মূল্য চুকাতে শুরু করেছেন তিনি। তাঁর ছোড়া প্রতিটি তির যেন মায়ের শ্রমের দামে লেখা। ছোট সাগর এখন বড় হয়ে অবাক হয়ে পেছনে ফিরে তাকিয়ে ভাবেন, এই চায়ের দোকান করে মা কীভাবে তাঁর আবদারগুলো মিটিয়েছেন। সংগ্রামী মায়ের থেকেই অনুপ্রেরণা পান সাগর, ‘আমার আম্মুর কথাগুলো আমাকে সব সময় অনুপ্রাণিত করে। সব সময় বলে, “চেষ্টা করো।” হেরে গেলে বলে, “তুমি তো এখনো ছোট। তুমি শুধু চেষ্টা করো। তুমি পারবা।’’ ছেলের স্বপ্ন পূরণে চায়ের কাপে কাপে যে মমতা ছড়িয়েছেন সেলিনা, সেটা জানান দিতে হবে তো সাগরকে। আসন্ন প্যারিস অলিম্পিকই হতে পারে সাগরের বিশালতা প্রকাশের দারুণ সুযোগ।