ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল ব্যক্তিদের একজন আলবার্ট আইনস্টাইন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘টাইম’-এর হিসাবে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মানুষ তিনি। জন্মের পর থেকে তাঁর প্রতিভার লক্ষণ দেখা গেছে। কারণ, তিনি এমন একটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যার সদস্যরা ছিলেন শিক্ষিত ও স্মার্ট।
আইনস্টাইনের বাবা হারম্যান ছেলেবেলায় স্কুলে ভালো শিক্ষার্থী ছিলেন। গণিতে ছিলেন দুর্দান্ত। কিন্তু হারম্যানের বাবা, মানে আইনস্টাইনের দাদার আর্থিক সমস্যার কারণে তিনি কলেজে পড়তে পারেননি। অল্প বয়সে পড়ালেখা ছেড়ে এক চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে মিলে একটা কোম্পানি তৈরি করেন। তাঁদের কোম্পানি বিছানা তৈরি করত। কিন্তু বেশি দিন টেকেনি সে ব্যবসা। এরপর নিজের ভাই জ্যাকবের (আইনস্টাইনের চাচা) সঙ্গে মিলে আরেকটি নতুন ব্যবসা শুরু করেন হারম্যান। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরি এবং গ্যাস সরবরাহ করতেন তাঁরা। হারম্যান বেশি পড়ালেখা করতে না পারলেও জ্যাকব পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
আইনস্টাইনের মা পলিন ছিলেন ধনী পরিবারের মেয়ে। তাঁর বাবা (আইনস্টাইনের নানা) শস্য বিক্রি করে ধনী হয়েছিলেন। পলিন তখনকার দিনে মডেল স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। সুশিক্ষিত ছিলেন। সেকালে ভালো স্কুল খুব কম ছিল। ভালো পড়াশোনা হবে, এটা ভাবা ছিল কঠিন। তখনো সেভাবে মেয়েদের জন্য স্কুল শুরু হয়নি। কিন্তু পলিন সেই সমাজে থেকেই স্কুলে গিয়ে পড়ালেখা করেছেন। বেশ হাস্যরসিক ছিলেন তিনি। গান গাওয়া এবং ছবি আঁকা বেশ পছন্দ ছিল তাঁর।
হারম্যান ও পলিনের প্রথম সন্তান আলবার্ট আইনস্টাইন। ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জার্মানির উল্ম শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শুরু থেকেই আইনস্টাইনের মধ্যে একটা অন্য রকম ব্যাপার ছিল। জীবনের প্রথম কয়েক বছর তিনি খুব কম কথা বলতেন। বেশির ভাগ শিশু যেখানে ২ বছরের মধ্যে দিব্যি প্রচুর কথা বলে, আইনস্টাইন সেখানে নিরিবিলি বসে থাকতেন।
অবশেষে আইনস্টাইন যখন কথা বলতে শুরু করেন, তখন তাঁর মধ্যে একটা অদ্ভুত অভ্যাস দেখা যায়। খুব ধীরে ধীরে এবং নরমভাবে বাক্যগুলো বলতেন তিনি। শুনে মনে হতো, তিনি বাক্যগুলো শুধু নিজের জন্য বলছেন। নিজে ছাড়া অন্যরা শুনতে পেত না। মনে হতো, যেন নিজের বলা কথাটা আগে নিজেই শুনে পরীক্ষা করে নিচ্ছেন আইনস্টাইন। যদি সব ঠিক মনে হতো, তাহলে বাক্যটা আরেকটু জোরে অন্যদের বলতেন। এই অভ্যাসের কারণে আশপাশের অনেক মানুষ কষ্ট পেতেন। বিশেষ করে আইনস্টাইনের মা।
আইনস্টাইনের পরিবারে একজন গৃহকর্মী নিয়োগ করা হয়েছিল। তিনি আইনস্টাইনকে ‘ডোপি ওয়ান’ বলতেন। মানে বোকা বা মূর্খ। কিন্তু অল্পদিনেই বোঝা গেল আইনস্টাইনকে যতটা বোকা বা মূর্খ ভাবা হচ্ছে, ততটা বোকা যেকোনো স্বাভাবিক শিশুই হতে পারে। শুধু কথাটা তিনি ধীরে এবং কম বলতেন।
আলবার্টের শৈশবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর একটা ঘটেছিল পাঁচ বছর বয়সে। তিনি সে সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুদিন কাটাতে হয় বিছানায়। অসুস্থ ছেলেকে খেলার জন্য একটা কম্পাস উপহার দিলেন বাবা হারম্যান। শিশু আইনস্টাইন কম্পাস পেয়ে মহা খুশি। কম্পাসটি নেড়েচেড়ে দেখলেন। এর কার্যকারিতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কোনো অদৃশ্য শক্তিবলে কম্পাসের কাঁটা ঘুরে যায়। সব সময় একটা নির্দিষ্ট দিকে থাকে কম্পাসের কাঁটা। কোনো বস্তুকে স্পর্শ করলে কিংবা কম্পাসটি একটু নড়াচড়া করলেও কম্পাসের কাঁটা নড়ে যায়। এ কাণ্ড দেখে ছোট্ট আইনস্টাইন অবাক হতেন। বাবাকে জিজ্ঞেস করতেন, কেন এমনটা হয়। কেন কম্পাসের কাঁটা সব সময় এক জায়গায় থাকে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি বাবা। তবে আরও অনেক পরে আইনস্টাইন নিজেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করবেন। তখন এ ব্যাপারে আমরা আরও বিস্তারিত জানব। তবে এখানে ছোট্ট করে একটু বলে রাখি, কম্পাস কী। আর কেনই–বা কম্পাসের কাঁটা সব সময় উত্তর-দক্ষিণমুখী হয়ে থাকে।
আগে দিক নির্ণয়ের জন্য কম্পাস ব্যবহৃত হতো। নাবিকেরা সমুদ্রের দিক নির্ণয় করতে ব্যবহার করতেন কম্পাস। এর কাঁটা সব সময় উত্তর-দক্ষিণে থাকে। কারণ, পৃথিবীর একটা চৌম্বকক্ষেত্র আছে। সেই চৌম্বকক্ষেত্রের দিকে সব সময় মুখ করে থাকে কম্পাসের কাঁটা। নিচের ছবিটা দেখলে বুঝতে সুবিধা হবে।
যা–ই হোক, কম্পাসের এই ব্যাপারটা আইনস্টাইনের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তিনি বুঝেছিলেন, অনেক সাধারণ জিনিসের মধ্যেও রহস্য লুকানো থাকে। সেই রহস্য জানার ইচ্ছা জেগে ওঠে তাঁর মনে। আর এই কম্পাসের কারণেই তৈরি হয় সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করার আগ্রহ। সবকিছু নিয়ে তিনি শুধু জানতে চাইতেন। কিন্তু কে দেবে এসব প্রশ্নের উত্তর? কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতেন তাঁর চাচা জ্যাকব। কিন্তু বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারত না। তখন আইনস্টাইন নিজেই একটা ব্যাখ্যা তৈরি করতেন।
আইনস্টাইনের মাথায় চিন্তা করার এই ভূত চাপার কারণে তাঁকে কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। ওই বয়সটা সবার খেলাধুলার বয়স। দৌড়াদৌড়ি করবে, খেলবে। কিন্তু অন্য শিশুদের মতো আইনস্টাইন এগুলো করতেন না। তিনি বসে বিজ্ঞের মতো ভাবতেন। ফলে তাঁর বয়সী অন্য শিশুদের সঙ্গে তাঁর মিলত না। মাথার মধ্যে শুধু প্রশ্ন কিলবিল করত। এটা কেন হয়, ওটা কেন হয়—এমন নানা প্রশ্ন। তবে শুধু প্রশ্ন করেই থেমে থাকতেন না পাঁচ বছরের আইনস্টাইন। নিজের মনে সেগুলোর একটা যুক্তিসংগত উত্তর তৈরি করতেন। সব কটির উত্তর যে ঠিক হতো, তা নয়। তবে তাঁর এই চিন্তা বা কল্পনা করার কারণে একদিন তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন হবেন। এ সম্পর্কে পরে আরও জানব।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনস্টাইনের চিন্তাভাবনাও বাড়তে শুরু করে। আগের চেয়ে আরও জটিল জিনিস নিয়ে তিনি ভাবেন। একটা উদাহরণ দিই। ধরো তুমি লিফটে উঠেছ। হঠাৎ লিফটের দড়ি ছিঁড়ে গেল। ওপর থেকে পড়তে শুরু করেছে লিফট। এমন সময় তুমি কী করবে? হয়তো চিৎকার করে উঠবে বা শক্ত করে ধরবে কাউকে। কিন্তু এমন একটা অবস্থা কল্পনা করে আইনস্টাইন ভাবলেন, লিফট নিচে পড়ার সময় কি তাঁর ওপর মহাকর্ষ বল আগের মতো কাজ করবে নাকি বদলে যাবে? লিফটে কি স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে নাকি মানুষ শূন্যে ভাসবে? নাকি লিফটের সঙ্গে চুম্বকের মতো আটকে থাকবে? এমন সব প্রশ্ন তাঁর মাথায় আসত, যার উত্তর দেওয়া কঠিন ছিল। অনেক প্রশ্নের উত্তর তখনো কারও জানা ছিল না। সেগুলো পরে আইনস্টাইন নিজেই খুঁজে বের করবেন। এভাবে চিন্তা বা কল্পনা করতে করতে একদিন তিনি আবিষ্কার করবেন ‘থিওরি অব রিলিটিভিটি’। আর তাতে বদলে যাবে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক কিছু।
আচ্ছা, মহাকর্ষ কী, সেটাই তো তোমাদের বলা হয়নি। মহাকর্ষ এমন একটা বল, যার কারণে পৃথিবীর সবকিছু কেন্দ্রের দিকে আকর্ষিত হয়। তুমি একটা টেনিস বল ওপরের দিকে ছুড়ে মারলে ওটা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে মহাকর্ষ বলের কারণে। আবার চাঁদ যে পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে কিংবা পৃথিবী সূর্যের চারপাশে—এ সবই হয় মহাকর্ষ বলের কারণে। এই বল আছে বলেই আমরা উড়ে চলে যাই না। মহাকর্ষ বল না থাকলে হাঁটতে গিয়ে আমরা উড়ে যেতাম। বইয়ের ভাষায় মহাকর্ষ হলো মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বল।
যা–ই হোক, আমরা আইনস্টাইনের শৈশবে ফিরে যাই। শৈশবে আইনস্টাইন নিজের খেলনাগুলো নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলতেন। এর মধ্যে একটা ছিল বিল্ডিং ব্লক। আমাদের দেশের শিশুরাও এগুলো নিয়ে খেলে। একটার সঙ্গে একটা ব্লক মিলিয়ে নতুন কাঠামো তৈরি করতে হয়।
খেলার জন্য একটা ছোট বাষ্পচালিত ইঞ্জিনও ছিল। চাচা জ্যাকব আইনস্টাইনকে উপহার দিয়েছিলেন। আইনস্টাইন এই ইঞ্জিন চালিয়ে অনেক সময় বসে থাকতেন। আর বোঝার চেষ্টা করতেন, কেন ইঞ্জিনটা চলছে। অবস্থা এমন হয়েছিল, এটাই যেন ছোট্ট আইনস্টাইনের একমাত্র কাজ ছিল।
আরেকটু বড় হওয়ার পর আইনস্টাইনকে স্কুলে ভর্তি করানো হলো। তখনো তিনি জানতেন না, পরিবার ছেড়ে বোর্ডিং স্কুলে একা থেকে পড়াশোনা করতে হবে। কারণ, আইনস্টাইনের বাবা ও চাচার যৌথ ব্যবসায় ধস নেমেছিল। প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল তাঁদের পরিবার। ফলে বাধ্য হয়ে আইনস্টাইনের বাবা পরিবার নিয়ে ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেখানে গিয়ে জ্যাকবের সঙ্গে আবার ব্যবসা শুরু করবেন। কিন্তু মুশকিল হলো, আইনস্টাইন ইতালি যেতে পারবেন না। কারণ, জার্মানির স্কুল থেকে তাঁর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করতে হবে। এর দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, আইনস্টাইন ইতালির ভাষা জানতেন না। তাই সেখানকার স্কুলে পড়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, আইনস্টাইন যেহেতু জার্মানির নাগরিক, তাই ১৬ বছর বয়স হলেই তাঁকে মিলিটারি সার্ভিস শেষ করতে হবে। ইতালি বা বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন, মিলিটারিতে এই সেবা তাঁকে দিতেই হবে। তাই তাঁর বাবা ছেলেকে জার্মানিতে রেখে যাওয়ার সিদ্ধন্ত নেন। তাঁকে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি রেখে যাওয়া হলো।
আইনস্টাইনের খুব মন খারাপ হলো। একে তো পরিবার নেই, একমাত্র খেলার সঙ্গীও চলে গেছে। ছোট বোন মারিয়াই ছিলেন একমাত্র খেলার সঙ্গী। একে তো আইনস্টাইন চুপচাপ ছিলেন বলে কোনো বন্ধু ছিল না। তাঁরা ছিলেন ইহুদি। ফলে অন্যরা আইনস্টাইনের সঙ্গে মিশত না।
আইনস্টাইনের দুই বছরের ছোট বোন মারিয়াকে নিয়েও মজার ঘটনা আছে। আইনস্টাইন যখন প্রথমবার মারিয়াকে দেখেন, তখন বোনকেও কম্পাসের মতো খেলনা গাড়ি ভেবেছিলেন। আর জানোই তো আইনস্টাইনের প্রশ্ন করা স্বভাব। সে একটু টেনে টেনে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই গাড়িটির চাকা কোথায়?’ আইনস্টাইন মারিয়াকে খুব ভালোবাসতেন। তবে রেগে গেলে মারতেও দেরি করতেন না। এমন একজন খেলার সঙ্গী চলে যাওয়ায় সত্যিই একা হয়ে গেলেন তিনি। ফলে জার্মানিতে পরিবার ছাড়া একাই বেড়ে উঠতে লাগলেন আলবার্ট আইনস্টাইন।
আজ এখানেই শেষ করি। আগামী পর্বে আইনস্টাইনের স্কুলজীবন নিয়ে বলব। স্কুলের পড়া শেষ হওয়ার আগেই আইনস্টাইন বুদ্ধি খাটিয়ে স্কুল ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। কীভাবে কাজটা করেছিলেন? সব ঘটনাসহ বাকি গল্প পরের পর্বের জন্য তোলা রইল।
সূত্র: ডি কে প্রকাশনীর লাইফ স্টোরিস সিরিজের ‘আলবার্ট আইনস্টাইন’ বই অবলম্বনে